দেশের খবর: কভিড-১৯ অন্যান্য ভাইরাস থেকে অপেক্ষাকৃত বড় এবং ভয়ানক ছোঁয়াচে। মানুষ থেকে মানুষে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ প্রবাসী নাগরিকদের দেশে প্রত্যাবর্তন; বিনোদন বা পরিজনের সঙ্গে সময় যাপনের নিমিত্তে আগমন। কভিড-১৯-এর উপসর্গ হচ্ছে জ্বর, কফ-কাশি, হাঁচি, মাংসপেশির বেদনা, গলাদাহ, যা ২ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে ফুসফুসের সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রুত চিকিৎসা না হলে স্পঞ্জি ফুসফুস শ্নেটের মতো শক্ত হয়ে যায়। ১৭ মার্চ পর্যন্ত ৭৫শ’র অধিক কভিড-১৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে ১৭০টি দেশে এবং আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। সবচেয়ে বেশি রোগী আছে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, ইরান, ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সে। বাংলাদেশে প্রমাণিত কভিড-১৯ রোগী মাত্র ১৭ জন এবং একজন মারা গেছেন। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা যে লাফিয়ে বেড়ে যাবে না, তার নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে না। সংক্রমণ প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশে কভিড-১৯-এর সম্ভাব্য বিস্তার পথ ভারত সীমান্ত :ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৫০০ কিলোমিটারের অধিক সীমান্ত রয়েছে। কয়েকশ’ পথে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করা যায়। তদুপরি রয়েছে প্রতিদিন কয়েকশ’ ভারতীয় ট্রাকের বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ট্রানজিট ব্যবহার। প্রতিদিন কয়েক হাজার ভারতীয় স্থলপথে বাংলাদেশে প্রবেশ ও প্রত্যাবর্তন করে। বাংলাদেশ থেকেও প্রতিদিন কয়েক হাজার বাংলাদেশি চিকিৎসা, বিনোদন ও হুন্ডি ব্যবসার নিমিত্তে ভারতে আসা-যাওয়া করে। এ যাতায়াত বন্ধে সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
কারাগার :বাংলাদেশের সব কারাগারের মিলিত বন্দি ধারণক্ষমতা ৪০ হাজারের কিছু বেশি। কিন্তু কারাবন্দি আছে প্রায় ৯০ হাজার। কারাগারের জনাকীর্ণতা কভিড-১৯-এর জন্য উন্মুক্ত দ্বার সৃষ্টি করতে পারে। প্রতিকার হিসেবে সরকারের উচিত হবে ফাঁসির আসামি, যাবজ্জীবন ও ১০ বছরের অধিক দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য দণ্ডপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মুক্তি দেওয়া এবং বুঝিয়ে বলা- পরিবারের বাইরে যেন বেশি বিচরণ না করে।রোহিঙ্গা ক্যাম্প :রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অত্যন্ত জনাকীর্ণ এবং ক্যাম্পে সাধারণ জীবনযাপনের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নেই। রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে না আসে, সেদিকে যেমন লক্ষ্য রাখতে হবে, একইভাবে স্থানীয় জনসাধারণেরও ক্যাম্পে প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
উপাসনালয় :মসজিদ-মন্দিরের প্রবেশপথে ভক্তদের ৬-১০ ইঞ্চি দূর থেকে ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা নির্ণয় করা উপযুক্ত কাজ হবে। জুমার খুতবায় কভিড-১৯ সম্পর্কে ভক্তদের তথ্য দিতে হবে। বাড়ির সবাইকে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধোয়া ও কনুই পর্যন্ত ধুয়ে অজু করার পদ্ধতি অনুসরণ করতে সবাইকে অনুপ্রাণিত করতে হবে। হাত মেলানো ও আলিঙ্গন পরিহার করতে হবে। বাস-ট্রেন স্টেশন, বন্দর, বাজার ও লঞ্চঘাটে যাত্রীদের তাপমাত্রা পরীক্ষা করার উদ্যোগ নিন হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটার দিয়ে এবং বাড়ি ফিরে সাবান দিয়ে ভালোভাবে হাত ধুতে হবে।বিদেশ প্রত্যাগত নাগরিক : প্রবাসী বাংলাদেশিরা বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জোগানদার। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর মধ্যে ২৫ লাখ চিকিৎসক, ইঞ্জিনিয়ার, ফার্মাসিস্ট, আইটি পেশাজীবী, শিক্ষক, ব্যবসায়ী স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাস করেন। দেশে পাঠান না। বাকি প্রায় ৭৫ লাখ সাধারণ শ্রমজীবী প্রবাসী বাংলাদেশি। পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশে বাংলাদেশিরা কঠিন শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। ৩-৪ বছর পরপর তারা স্ত্রী-পুত্র-পরিজন ও আত্মীয়দের দেখার জন্য দেশে ফেরেন ১০ থেকে ৪০ ঘণ্টা বিমান ভ্রমণ করে। কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধের নিমিত্তে বিমানবন্দরে পৌঁছার পর তাদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা বিজ্ঞানসম্মত। তারা যদিও ‘নবাবজাদার অভ্যর্থনা’ প্রত্যাশা করেন না; তবে সরকারের নৈতিক দায়িত্ব হবে, তাদেরকে ১৪ দিন আহার-বিশ্রামের জন্য ফাইভ স্টার অভ্যর্থনা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া। যারা আত্মীয়স্বজনের কাছে ফিরে যাচ্ছেন, তাদেরকে আইসোলেশনের বৈজ্ঞানিক কারণ ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া, যাতে বাড়ির বাইরে ১৪ দিন ঘোরাফেরা না করেন। জরিমানা করা অমানবিক কাজ।
সরকারি ব্যবস্থাপনা :পৃথিবীর সব দেশ কঠিন সমস্যায় পতিত হয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে দুর্বলতা হচ্ছে হাসপাতাল, ক্লিনিক নামক অজস্র বিল্ডিং আছে; কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত জনবল নেই ভুল নীতিমালার কারণে। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরে রিভার্স পলিসারজ চেইন রিমত্র্যাকসন পরিচালনায় দক্ষ ৫০ জন ভাইরোলজিস্ট, অ্যানাটোমোলজিস্ট, মাইক্রোবায়োলজিস্ট নেই। সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ল্যাবরেটরিতে উন্নতমানের পিসিআর নেই। তদুপরি বাংলাদেশে মেডিকেল যন্ত্রপাতির ওপর অদ্ভুত ধরনের অতিরিক্ত শুল্ক্ক ও বিবিধ ট্যাক্স প্রয়োগের নিয়ম প্রযোজ্য। তদুপরি বিভিন্ন কর্মকর্তার খুশি করার জন্য অন্যান্য উপরি ব্যয় তো আছেই। কর ধার্যে সব মেডিকেল যন্ত্রপাতি, প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট ও সামগ্রীর ওপর শূন্য শতাংশ (জিরো ট্যাক্স) করা সরকারের আশু দায়িত্ব। সব প্রবেশপথে পর্যাপ্ত স্ক্যানার ছাড়াও কমপক্ষে ২০-৩০টা হাতে ধরা ইনফ্রারেড থার্মোমিটারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিন শিফটে কাজ হওয়ার মতো স্বাস্থ্যকর্মীর ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রস্তুতি থাকতে হবে মাসে কয়েক লাখ সম্ভাব্য রোগীর নমুনা পরীক্ষার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সাময়িকী দি ল্যানসেটে প্রকাশিত হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের মধ্যে কভিড-১৯ ভাইরাসের বিস্তৃতির তথ্য। অনতিবিলম্বে আগামী এক মাসের মধ্যে এক লাখ চিকিৎসক ও দুই লাখ নার্স, টেকনিশিয়ান, প্যারামেডিক ও ফিজিওথেরাপিস্টকে কয়েক ঘণ্টা করে করোনা রোগের ধরন, উপসর্গ বিস্তৃতি, রোগ নির্ণয় পদ্ধতি ও প্রতিরোধক ব্যবস্থা, ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, আলিঙ্গন বা হ্যান্ডশেক না করে সালাম দেওয়ার অভ্যাস করা ও সম্ভাব্য রোগীকে দেখে ভয়ে পালিয়ে না যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করতে হবে।
দেশি বিজ্ঞানীদের সহায়তা : সরকারি সহযোগিতা পেলে গণস্বাস্থ্য এক মাসের মধ্যে কভিড-১৯ নির্ণায়ক গণস্বাস্থ্য র্যাপিড ডট রট বাজারজাত করবে। ড. বিজন কুমার শীল, যিনি সিঙ্গাপুরে ২০০৩ সালে সার্স ভাইরাস নির্ণায়ক র্যাপিড ডট রট উদ্ভাবন দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন, তিনি বর্তমানে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণস্বাস্থ্য অধ্যাপক ও ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী। ড. বিজন কুমার শীল ও তার সহকারী ড. নিহাদ আদনান, ড. ফিরোজ আহমদ ও ড. বায়জিদ, জমির উদ্দীন গণস্বাস্থ্য ল্যাবরেটরিতে অ্যান্টিবডিএসেজ (ইমমিউনোগ্লোবিন-এ, ইমমিউনোগ্লোবিন-জি ও ইমিউনোগ্লোবিন-এম ইমমিউনোত্রসেজ) পদ্ধতি ব্যবহার করে কভিড-১৯ ভাইরাস নির্ণায়ক পদ্ধতি র্যাপিড ডট রট উদ্ভাবন করেছেন। সরকার দ্রুত বিভিন্ন করোনাভাইরাস অ্যান্টিবডি, নিউ ক্লোপ্রোটিন, স্পাইন গ্লাইকোপ্রোটিন, করোনাভাইরাস এনভেলাপ প্রোটিন প্রভৃতি ইংল্যান্ড থেকে সংগ্রহের অনুমতি দিলে বাজারজাতকরণের জন্য পর্যাপ্ত র্যাপিড ডট রট প্রস্তুত হবে আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে। প্রতিটির উৎপাদন খরচ হবে দুইশ’ টাকা। সরকার শুল্ক্ক, বিভিন্ন প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাট মওকুফ করে দিলে জনগণ মাত্র তিনশ’ টাকায় পরীক্ষা করে কভিড-১৯ সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারবে। পিসিআর পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ভিজিট কন্ট্রোল র্যাপিড ডট রট উদ্ভাবনের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং গণস্বাস্থ্যের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
শেষ কথা- সঠিক তথ্য দিন, গুজব ছড়াবেন না। বাংলাদেশের জনগণের ওপর আস্থা রাখুন। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মীসহ সবাই সাবান দিয়ে বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। হ্যান্ডশেক নয়, সালাম দিন। ‘আল্লাহর আজাব’ থেকে নিশ্চয় সবাই মুক্তি পাবেন।
ট্রাস্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র