আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত
– শেখ মফিজুর রহমান
আমি শহর আলী
সেই যে গাঁয়ের পাশে হাটের মোড়ে
মনোহারীর দোকান, নাম যার
পরী ভ্যারাইটিজ স্টোর !
সুগন্ধি তেল, বাসনা সাবান, লাল ফিতা
কালো ক্লিপ, হরেক রকম সোনার মত
ঝকমকে নকল সোনার গহনার পসরা সাজাতাম।
স্কুল – কলেজ ছুটি শেষে হাসি হাসি মুখের
সবুজ পাতার মত সতেজ মেয়েরা কলবল
করতে করতে আমার দোকানে ঢুকতো
আর এটা দেখান, সেটা দেখান বলে
অস্থির করে তুলতো।
সন্ধ্যায় আসতো কেবল গোঁফের রেখা দেখা যায়
নতুন প্রেমিক আর খুশি খুশি চেহারার নতুন বর।
সবার মনের মানুষের জন্য মনোহারীর জিনিস
দিয়ে নিত্য বাজার শেষে গরম জিলাপী
হাতে বাড়ি ফিরতেই চার বছরের পরী আমার
লাফিয়ে উঠতো আব্বা এসেছে বলে।
বাজারের ব্যাগের সাথে একপাতা লাল টিপ
বউয়ের মুখে আনতো সলজ্জ হাসি আর
গরম জিলাপি পেয়ে পরী আমার খুশিতে
বাড়ি মাতিয়ে তুলতো। মায়ের পাশে বসে
ওষুধের প্যাকেট দিতেই বলে উঠতো যা হাত – মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নে,
সারাদিন কত খাটাখাটি !
সেই সুখের দিনে আসলো যেন করোনা নামের ঝড়।
কি এক অদৃশ্য শত্রু কেড়ে নিল আমাদের নিত্য দিনের সব ছোট ছোট সুখ স্মৃতি।
স্কুল – কলেজ বন্ধ হলো, বন্ধ হলো পাখির মত কিচিরমিচির করা সতেজ মেয়েদের আনাগোনা।
সন্ধ্যার পর দোকান বন্ধ, নতুন প্রেমিক আর নতুন বরের আসা বন্ধ, বন্ধ আমার পরী ভ্যারাইটিজ স্টোর।
মানুষের যেখানে একমুঠো খাবারের জন্য হাহাকার
সেখানে কে কিনবে সুগন্ধি তেল,
স্নো-পাউডার?
কিন্তু আমার? আমার কি উপায়?
মাঠে জমি নেই, যা ছিল সব দিয়েছি
সেই মনোহারীর দোকানে।
এখন নেই কোন ক্রেতা, নেই কোন টাকা
কিভাবে চলবে আমার সংসার? পরীর খাবার?
দুঃখের কষ্টের জীবন আমার
কিন্তু তাই বলে কখনো কারো কাছে হাত পেতেছি
মনে পড়ে না কখনো, গায়ে খেটে ঘাম ঝরিয়েছি
তাতে যা পেয়েছি জীবন চলেছে জীবনের মতো।
কিন্তু আজ কার কাছে হাত পাতবো?
কে এক মুঠো চাল দিয়ে ছবি তুলে ছড়িয়ে দেবে
আর আমার দোকানে আসা সেই হাসি হাসি মুখ করা মেয়েটি
বা সদ্য গোঁফ উঠা তরুণের মোবাইলে
যাবে চলে! জানি না তারা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবে কোনদিন দু’টাকা ছাড় দিই নি বলে!
নাকি করুণায় অন্ধ হয়ে সহানুভূতির কমেন্টে ভরে ফেলবে?
কোথায় যাবো আমি? চেয়ারম্যান, মেম্বার কারো কাছে কখনো ঘেঁষিনি, ভয়ে ভয়ে চলেছি এড়িয়ে
হাত – পা ভালো আমার, সুস্থ ব্যক্তি কার কাছে যাবো আজ এই মহাদূর্দিনে হাত পাততে?
সঞ্চয় বলতে আমার সঞ্চিত আছে শুধু লজ্জা
বিরাট ব্যবসায়ী বা দিন মজুর নই, তাই পাবো না কোন ঘোষিত আর্থিক সহায়তা।
মেয়েটার কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছি, মায়ের
অসুখের কাতরধ্বনি, বউ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে
হাতে তার চকচকে নতুন কাঁচি, শুনলাম মুক্তার
ভায়ের মাঠে ভালো ধান হয়েছে, করোনা থেকে
বাঁচার নামে লজ্জা থেকে বাঁচতে মুখে কাপড় বেঁধে সেখানেই যাবো ভাবছি
যদি ধান কেটে কিছু টাকা পাই, খেতে পাবে তবে সবাই।
আমি যে বড় চিত্তের কম বিত্তের নিম্ন মধ্যবিত্ত!
বিত্তের থলি শূণ্য হলেও চিত্তের থলিতে লজ্জা
ভয় আর সংকোচের ছড়াছড়ি !
লেখক: জেলা ও দায়রা জজ, সাতক্ষীরা।