যাঁরা একাত্তর জানেন, তাঁরা সবাই বলবেন, যে ধর্ষণ করত সে-ই লুট করত। কেউ ধর্ষণ করে চলে যেত না। যাওয়ার সময় ঘটি-বাটি, সোনা-দানা যা হাতের কাছে পেত তা নিয়ে যেত। সেটা পাকিস্তান আর্মি হোক অথবা রাজাকার হোক। ওই চিত্র এখনো পাল্টায়নি। লুটেরা আর ধর্ষক দুইটাই পাষণ্ড, জানোয়ার, বিশ্বাসঘাতক ও রাজাকার। বাংলাদেশ এদের দখলে!
২. সারা দেশে অনেকেই বনানীর হোটেলে দুটি মেয়ের ‘ধর্ষণ’ নিয়ে কথা বলছে। কেউ কেউ এর মধ্যে কেবল যৌন নির্যাতন খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা কেবল আসামি পরিচয় ধারণকারী নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের পারিবারিক, সামাজিক ও ক্ষমতার পরিচয়। তাদের বাপ ও পরিবারের সামর্থ্য আছে এই বড়লোকি জীবনযাপন নিশ্চিত করার। বিপদে পড়লে রক্ষা করার।
৩. যে আসামিদের নাম বলা হচ্ছে, তাদের অর্থনীতি চিনিয়ে দেয় এরা হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতাবানগোষ্ঠীর সদস্য। এই ক্ষমতাবান গোষ্ঠী সে যে দলেরই হোক, যা খুশি করার কমবেশি অধিকার রাখে। কিন্তু এদের ধরা যাচ্ছে না। পুলিশের ভূমিকা এতটাই হাস্যকর হয়ে গেছে, মানবাধিকার কমিশন পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছে।
পুলিশের কাছ থেকে কেউ কিছু আশা করে না। কারণ সবাই জানে, পুলিশ চাইলেই অপরাধীদের ধরতে পারবে। কিন্তু এই চাওয়াটা হতে হবে। সেটা তৈরি করতে প্রশাসনিক আদেশ, ইচ্ছা লাগে। সেটা এখনো সম্ভবত রান্না হচ্ছে। তাই তাদের ধরা হচ্ছে না। তাদের রক্ষা করার মতো টাকা-পয়সা তাদের বাবা-মায়ের আছে।
৪. আমাদের দেশে রাজাকারি নির্যাতনটা ক্ষমতাবান শ্রেণি করেই যাচ্ছে। কারণ, তাদের শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই। একাত্তর সালে মুক্তিযোদ্ধারা ছিল। কিন্তু এখন দেশ তো কমবেশি রাজাকারদেরই হাতে। এখানে আর অপরাধ করে শাস্তি পেতে হয় না। দেশ এখন রাজাকারের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
৫. যে লোকটি ব্যাংকের টাকা লুট করে, বিদেশে পাচার করে, দুর্নীতি করে, সে লোকটাকে রাজাকার কেন বলা হয় না, এটা বড় প্রশ্ন। এই কারণেই বলা হয় না কারণ, তাহলে তো আমরা অনেকেই রাজাকার হয়ে যাব। একাত্তর সালে বেশির ভাগ রাজাকার ছিল গরিব মানুষ। কিন্তু তাদের হাতে যখন অস্ত্র উঠে যায়, তখন তারা ধর্ষক ও ডাকাতে পরিণত হয়। পরিস্থিতিই মানুষের চরিত্র নির্ধারণ করে। দেশের এমন অবস্থা, যেকোনো ক্ষমতাবান মানুষের পক্ষে লুটেরা হওয়া সহজ। তাই বেশির ভাগ বড়লোকই এই রাজাকার শ্রেণির হয়ে গেছে।
ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে অনেকেই আক্রোশ প্রকাশ করেছেন সামাজিক মাধ্যমে। কেউ কেউ আবার অভিযুক্তদের পক্ষে। তাদের যুক্তি, ওই মেয়েরা হোটেলে গেল কেন? ধরা গেল অপরাধটা তাদের। কিন্তু তাতে করে ধর্ষণের অপরাধ, ভিডিওচিত্র ধারণ করার অপরাধটা বাদ পড়ে যায় কী করে? যাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে, তারা নির্দোষ হলে এতদিনে ধরা দিয়ে বিচারের সামনে দাঁড়াত। তার কিছুই হয়নি।
পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিনতম শত্রু জঙ্গিদের পুলিশ একের পর ফেলে দিচ্ছে। কিন্তু দু-তিনজন অপরাধীকে পুলিশ ধরতে পারছে না সেটা কী করে হয়? যে অশুভ ধ্বনিটা শুনছি সেটা হচ্ছে, এরা সবাই শাসক শ্রেণির অংশ। তাদের তো আবার কোনো জবাবদিহিতা নেই। অতএব সামাজিক গণমাধ্যম ছাড়া মানুষ তার রাগ আর ক্ষোভ নিয়ে আর যাবে কই?
বাংলাদেশ এমন দেশ, যেখানে সব কিছুই শেষ হয়ে যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠে না কেবল রাজাকারি ছাড়া। গ্রামের মানুষ পিটিয়ে যাদের মেরেছে একাত্তর সালে, তাদের সন্তানরাই এখন আমাদের জমিদার।
লেখক আফসান চৌধুরী : সাংবাদিক ও গবেষক