অনলাইন ডেস্ক : টেকনাফে তল্লাশি পোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মুহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার সময় কক্সবাজার জেলায় পুলিশ সুপার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এ বি এম মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগপত্রে সুপারিশ করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। আলোচিত এই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র্যাব-১৫-এর সহকারী পুলিশ সুপার খায়রুল ইসলাম কক্সবাজারের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৪-এর বিচারক তামান্না ফারাহর আদালতে দাখিল করা অভিযোগপত্রে এই সুপারিশ করেন।
রোববার (১৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এলিট ফোর্সটির মুখপাত্র লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ তথ্য জানান।
সিনহা হত্যা মামলার পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ বি এম মাসুদ হোসেনকে রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। এখনো তিনি সেখানেই দায়িত্ব পালন করছেন। অপরদিকে কক্সবাজার জেলার নতুন পুলিশ সুপার হিসেবে যোগ দেন ঝিনাইদহ জেলার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান।
সিনহা হত্যার পর তৎকালীন পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের একটি অডিও প্রকাশ পেয়েছিল। সে বিষয়ে তদন্তে কি মিলেছে এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাব মুখপাত্র বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার আগে থেকেই ওসি প্রদীপ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে এসেছিল। তা নিয়ে এসপি মাসুদ অত্যন্ত উদাসিন ছিলেন। পাশাপাশি স্থানীয় সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফাসহ স্থানীয়দের নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যম আসার পরেও পুলিশ সুপার সম্পূর্ণ উদাসিন ছিলেন। তাছাড়া ঘটনা ঘটার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন না করে এবং আহত মেজর সিনহাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা না করা সহ বিভিন্ন বিষয় তদন্ত কর্মকর্তা আমলে এনেছেন।
পুলিশ সুপারের অপেশাদার আচরণ এবং দায়িত্ব পালনে আরো বেশি সতর্ক হওয়ার দরকার ছিল বলে মনে করেন তদন্ত কর্মকর্তা।
লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, সার্বিক ঘটনা বিবেচনায় একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ পুরা ঘটনা তদারকিতে ঘাটতি ছিলো। এই পরিপেক্ষিতে তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদের আচরণের বিরুদ্ধে এবং দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে একটি বিভাগীয় ব্যবস্থা বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে চার্জশিটে উল্লেখ করেছেন।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে জানিয়ে র্যাব মুখপাত্র বলেন, জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে থানায় বসে ওসি প্রদীপ (তৎকালীন টেকনাফ থানার ওসি) সহ পাঁচজন মিলে এই হত্যার পরিকল্পনা করেন। পরে তা বাস্তবায়ন করেন ১৫ জন মিলে।
গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরে এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। দুই বছর আগে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া রাশেদ ‘লেটস গো’ নামে একটি ভ্রমণ বিষয়ক ডকুমেন্টারি বানানোর জন্য গত প্রায় একমাস ধরে কক্সবাজারের হিমছড়ি এলাকায় ছিলেন। ওই কাজেই তার সঙ্গে ছিলেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শিক্ষার্থী সাহেদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথ।
কক্সবাজারের পুলিশ সে সময় বলেছিল, সিনহা তার পরিচয় দিয়ে ‘তল্লাশিতে বাধা দেন’। পরে ‘পিস্তল বের করলে’ চেক পোস্টে দায়িত্বরত পুলিশ তাকে গুলি করে। পুলিশ সেদিন ঘটনাস্থল থেকেই সিফাতকে গ্রেপ্তার করে। পরে নীলিমা রিসোর্ট থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শিপ্রাকে। সিনহা নিহতের ঘটনায় এবং গাড়ি থেকে মাদক উদ্ধারের অভিযোগে টেকনাফ থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ, যাতে সিনহা এবং তার সঙ্গে থাকা সিফাতকে আসামি করা হয়। আর নীলিমা রিসোর্ট থেকে শিপ্রাকে গ্রেপ্তার করার সময় মাদক পাওয়া যায় অভিযোগ করে তার বিরুদ্ধে রামু থানায় মামলা করা হয়।
কিন্তু পুলিশের দেওয়া ঘটনার বিবরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত ২ আগস্ট উচ্চ পর্যায়ের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে গঠিত ওই কমিটি এরই মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ ৬৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রশাসনিক ওই তদন্তে কক্সবাজারে চেকপোস্টে পুলিশের ভূমিকা অপেশাদার ও হটকারী বলে মন্তব্য করা হয়। ভবিষ্যতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে বেশকিছু সুপারিশ করেন তারা।
সিনহার বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস ৫ আগস্ট ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ নয় জন পুলিশ সদস্যকে আসামি করে আদালতে মামলা করলে র্যাবকে তদন্তভার দেন বিচারক। তাদের মধ্যে সাতজন পরদিন কক্সবাজারের আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। সিনহা হত্যার ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন জন সাক্ষী এবং শামলাপুর চেকপোস্টের দায়িত্বরত আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ানের (এপিবিএন) তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। টেকনাফ থানার সাবেক কনস্টেবল রুবেল শর্মাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। মামলায় গ্রেপ্তার ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। তাদের মধ্যে ওসি প্রদীপ ও কনস্টেবল রুবেল ছাড়া ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই ১৪ জনের বাইরে টেকনাফ থানার সাবেক এএসআই সাগর দেবকে অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশের করা মামলায় সিনহার সঙ্গী সিফাত ও শিপ্রা এখন জামিনে আছেন।
ওসি প্রদীপ, পরিদর্শক লিয়াকতসহ গ্রেপ্তার পুলিশ সদস্যদের ইতোমধ্যে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনার পর কক্সবাজারের পুলিশকে নতুন করে সাজানো হয়। এসপি থেকে কনস্টেবল- প্রায় সব পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়েছে অন্য জেলায়। এদিকে সিনহার বোনের করা মামলা ‘অবৈধ’ দাবি করে তা বাতিল চেয়ে রিভিশন আবেদন করেছেন মামলার প্রধান আসামি পরিদর্শক লিয়াকত আলী। রোববার এ বিষয়ে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।