অনলাইন ডেস্ক : চিত্রনায়িকা পরীমনির মামলার ক্ষেত্রে রিমান্ডের অপব্যবহার হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, পরীমনির মামলায় তৃতীয় দফা রিমান্ডের প্রয়োজন ছিল না। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আবেদন করলেন আর বিচারক (ম্যাজিস্ট্রেট) রিমান্ড মঞ্জুর করলেন, এটা তো সভ্য সমাজে হতে পারে না।
বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এসব কথা বলেন।
ঢাকাই সিনেমার নায়িকা পরীমনির রিমান্ড বিষয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রেখে হাইকোর্ট বলেন, রিমান্ডের উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিল, আপনি (ম্যাজিস্ট্রেট) মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না। রিমান্ড অতি ব্যতিক্রমী বিষয়।
১৯ আগস্ট পরীমনির জামিন আবেদন নাকচ করেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত। এর বিরুদ্ধে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে জামিন আবেদন করেন পরীমনি। এই আদালত ১৩ সেপ্টেম্বর শুনানির দিন রাখেন। পরদিন আবেদন ‘আর্লি হিয়ারিং’ বা নির্ধারিত সময়ের আগে শুনানি চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবী। এতে ফল না পেয়ে ২২ আগস্টের ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং অন্তর্বর্তীকালীন জামিন চেয়ে ২৫ আগস্ট হাইকোর্টে আবেদন করেন পরীমনির আইনজীবী।
শুনানি নিয়ে ২৬ আগস্ট হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে জামিন আবেদন শুনানির জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করে মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া আদেশ কেন বাতিল ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। জামিন আবেদনের শুনানি দ্রুত (আর্লি হিয়ারিং) তথা দুদিনের মধ্যে করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয় রুলে। সেই সঙ্গে ১ সেপ্টেম্বর রুল শুনানির তারিখ রাখা হয়।
এর ধারাবাহিকতায় আজ বিষয়টি শুনানির জন্য ওঠে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় পরীমনিকে তিন দফায় সাত দিন রিমান্ডে নেওয়ার প্রেক্ষাপটে স্বতঃপ্রণোদিত রুল চেয়ে ২৯ আগস্ট একই বেঞ্চে একটি আবেদন দাখিল করে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। আজকের শুনানিতে পরীমনির রিমান্ডের বিষয়টি ওঠে।
আসকের নির্বাহী সদস্য ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না শুনানিতে বলেন, রিমান্ডে নেওয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা আছে। নির্দেশনা অনুসরণ না করে পরীমনিকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। রিমান্ডের ক্ষেত্রে যাতে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা নিম্ন আদালত অনুসরণ করেন, এটিই প্রার্থনা।
আদালত বলেন, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন আছে। এরপরেও তা শুনছেন না।
পরীমনির আইনজীবীর মো. মজিবুর রহমানের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে কিছু বলতে চান কী?’
তখন আইনজীবীর মজিবুর রহমান বলেন, ‘তৃতীয় দফায় রিমান্ডের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭ ধারা ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মানা হয়নি।’
আদালত বলেন, ‘দ্বিতীয় দফায় কত দিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়?’
তখন পরীমনির আইনজীবী বলেন, ‘দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়। আর প্রথম দফায় চার দিন ও তৃতীয় দফায় এক দিন রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।’
ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৫ ও ৪৩৯ ধারার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আদালত ধারাটি পড়তে বলেন। তখন ৪৩৫ ধারা তুলে ধরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল বলেন, নিম্ন আদালতের নথি তলব করার ক্ষমতা বিষয়ে বলা আছে। হাইকোর্ট বিভাগ বা দায়রা জজ তার এখতিয়ারের মধ্যে থাকা কোনো নিম্নতম ফৌজদারি আদালত কর্তৃক লিপিবদ্ধ করা বা প্রদত্ত অভিমত শাস্তি বা আদেশের নির্ভুলতা, বৈধতা বা যৌক্তিকতা এবং ওই আদালতের কার্যক্রমের নিয়মানুগতা সম্পর্কে সন্তুষ্ট হওয়ার জন্য ওই আদালতের কোনো মামলার নথি তলব বা পরীক্ষা করতে পারবেন।
আইনজীবীদের উদ্দেশে আদালত বলেন, তাহলে আমরা পরীক্ষা করতে ও রেকর্ড দাখিল করতে বলতে পারি।
জেড আই খান পান্না বলেন, পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা যেন অনুসরণ করা হয়।
এ সময় আদালত রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য শুনতে চান। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল বলেন, পরীমনিকে তিনবার রিমান্ডে নেওয়ার যৌক্তিকতা দেখি না।
হাইকোর্টের দেওয়া রুল (পরীমনির জামিন আবেদন শুনানি প্রশ্নে) উল্লেখ সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, ২০ দিন পর জামিন আবেদন শুনানির দিন ধার্য প্রশ্নে রুলের বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।
রুলের অপর অংশ উল্লেখ করে আদালত বলেন, ‘৪৯৮ ধারায় জামিন আবেদন মেট্রো সেশন জজ কত দিনের মধ্যে শুনবেন, এ বিষয়ে গাইডলাইন দেব। এটি কি এক মাস পরে, না দুই মাস পরে, নাকি তিন দিনের ভেতরে শুনবেন, এ বিষয়ে গাইডলাইন দেব।’
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আবেদনে জামিন সংক্রান্ত অংশটুকু অকার্যকর হয়ে গেছে। তাকে রিমান্ড নেওয়া নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। অভিযুক্ত আবেদনকারীকে (পরীমনি) তিনবার রিমান্ডে নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে রিমান্ড শেষ হয়ে গেছে।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, রিমান্ডে নাই, তবে রিমান্ডে নেওয়ার কি উপাদান ছিল, এর জবাব দেখতে চাই। আপনি ক্ষমতার অপব্যবহার করলেন, কেন করলেন?
ওই মামলায় প্রথম দফায় চার দিন রিমান্ডের পর দ্বিতীয় দফায় রিমান্ডের প্রয়োজন ছিল কিনা, তদন্ত কর্মকর্তাকে সিডিসহ উপস্থিত হতে এবং দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে কি উপাদান ছিল, সে বিষয়ে জানাতে বলা হবে বলে মত প্রকাশ করেন আদালত।
সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মিজানুর রহমান বলেন, ওই রিমান্ড বিচারাধীন নেই। আদালত বলেন, উপাদান ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা প্রার্থনা দিল, আপনি মঞ্জুর করে দিলেন। এগুলো কোনো সভ্য সমাজে হতে পারে না। রিমান্ড অতি ব্যক্তিক্রম বিষয়।
পরে আদালত বেলা দুইটায় সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য বিষয়টি রাখেন।
মধ্যাহ্ন বিরতির পর বেলা দুইটার দিকে আদালতের কার্যক্রম শুরু হলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবু ইয়াহিয়া দুলাল বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন। উনার সঙ্গে কথা হয়েছে। উনি (অ্যাটর্নি জেনারেল) বলেছেন, নট টুডে (বুধবার নয়) চাইতে।’
আদালত বলেন, কারও হাজিরা তো দিচ্ছি না। কারণ দর্শাতে বলতে পারব না।
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটি আদালতের বিবেচনা ও এখতিয়ার।’
পরীমনি আইনজীবী মজিবুর রহমানের উদ্দেশে এ সময় আদালত বলেন, ‘অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানি করবেন। সরকারপক্ষ থেকে নট টুডে চাওয়া হয়েছে। এটি মঞ্জুর করা হলো। জ্যেষ্ঠ আইনজীবীকে (জেড আই খান পান্না) জানিয়ে দেবেন।’