সত্তরের দশকে যখন গোলাম মোস্তফা, ইকবাল বাহার চৌধুরী, সৈয়দ হাসান ইমামদের হাত ধরে এদেশে আবৃত্তির সুচারু এক বাতাবরণ সৃষ্টি হয় তখনও ধ্রুপদী সংগীত ও আবৃত্তি চর্চা ছিল উচ্চমার্গীয় শ্রেনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ।কিন্তু আশির দশকের গোড়ার দিকে এদেশে সামাজিক রুপরেখা ও শিল্পরুচির পরিবর্তন দেখা দিলে আবৃত্তি তার সীমাবদ্ধতার খোলস ছেড়ে গনমানুষের হতে শুরু করে।
কয়েকজন নামি বেনামি নবীন প্রবীনের মিশেলে স্বল্প সংখ্যক আবৃত্তিপ্রেমির হাতেই জ্বলে ওঠে এই শিল্পের গণমুখী মশাল, শুরু হয় প্রাচীনতম অভিজাত শিল্পটির এই দেশে নতুন রুপে অগ্রযাত্রা।তৎকালীন সেই অগ্রনায়কদের মধ্যে ছিলেন একজন নবীন কিশোর।
যিনি সু-শীলনের মাধ্যমে এবং পারিবারিক শিল্পধারা তার অন্তর্গত রক্তে প্রবাহিত হওয়ার কারনে সেই কৈশোরকালীন বয়সেই বোধের হাতুড়ি ও কন্ঠের ছেনি দিয়ে কবিতাকে ভাষ্কর্য বানিয়ে ফেলতে পারতেন অনায়াসে। বোধের ক্যানভাসে কন্ঠতুলি দিয়ে সুনিপুন ভাবেই আঁকতে পারেন কবিতার শরীরকে।কবিতার বিশুদ্ধতা ও শব্দের শুচিতাকে হৃদয়ঙ্গম করে অন্তর্নিহিত বিষয়ের প্রগাঢ় মানে করে দেন কণ্ঠ দ্যোতনায়, যা আজও চলমান। কবিতার গ্রাম অঞ্চলে আজ আবৃত্তির যতটুকু আধিপত্য এবং জয়যাত্রা সেই জয়রথের অন্যতম সারথিও ছিলেন তিনি।
বলছি বাংলা আবৃত্তিকুলের মহাপ্রাণ ব্যক্তি শিমুল মুস্তাফার কথা যার আজ ১৭ অক্টোবর জন্মদিন।ইতিহাস সাক্ষ দেয় এদেশের স্বাধিকার ও স্বাধীনতায় রক্ত সম্ভ্রম ও প্রানের বিনিময়ে বাঙালির যে সফলতা সেখানে রাজনৈতিক আন্দোলন সঞ্জীবনিশক্তি পেয়েছে মুলত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাছ থেকেই।
উচ্চারনের মাধ্যমে শব্দের বিষ্ফোরণ ঘটলে সেটাযে কতটা শক্তিশালী হয়ে ভিতর কে বাইরে টেনে এনে জাগ্রত করে তোলে সেটা দেখিয়েছেন তর্জনী উঁচিয়ে ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু, এক উচ্চারনেই যেন একদেশ। বাংলাদেশ কবিতার দেশ শব্দ’ই বাঙালির শক্তি উচ্চারন’ই বাঙালির ক্ষেপণাস্ত্র সেটা প্রমান করেছে এদেশের কবিরা ও আবৃত্তিশিল্পী শিমুল মুস্তাফারা।
সৈরাচার বিরোধি আন্দোলনে এক অন্য শিমুল মুস্তাফাকে দেখে বাংলাদেশ আবৃত্তিই হয়ে ওঠে তার প্রতিবাদের ভাষা,সমাবেশে মঞ্চে তিনি প্রোজ্জ্বল, প্রদীপ্ত ও উচ্চাবচ কন্ঠে ক্ষেপন করতেন কবিতাকে আর প্রতিটা শব্দ উৎসুক জনস্রোতে গিয়ে মিশতো শক্তিসেল হয়ে সে উত্তেজনা উন্মাদনার যারা সাক্ষী তারাই জানে সে মাদকতা কতটা প্রকট।কবিতায় আরোপিত দাড়ি, কমা, যতি, বিরাম অনুযায়ি আবৃত্তি হতে হবে বিষয়টা এমন না আবৃত্তি স্বতন্ত্রশিল্প,এখানে শিল্পীর স্বতন্ত্র অধিকার আছে সে অধিকার সাধনায় লব্ধ করতে হয়।
শব্দের আভিধানিক অর্থের যথার্থ প্রকাশই সবসময় একজন দক্ষ আবৃত্তিশিল্পীর লক্ষ হতে পারে না হলেও সেটা দায় সারা। অনেক সময় শব্দের অভিপ্রেত অর্থ সেই শব্দ বা কবিতাকে অন্যরুপেও প্রকাশ করায়। এই জন্য স্থান কাল পাত্র ভেদে একই কবিতা অন্তঃসার অক্ষুন্ন ভিন্ন রুপে শিমুল মুস্তাফার কন্ঠে শোভা পায়, প্রেমের কবিতাও তার কন্ঠে কখনো হয়ে ওঠে প্রতিবাদি। এজন্য তিনি গনমানুষের আবৃত্তিশিল্পী। সে সময় আবৃত্তিশিল্পের সম্ভাবনা দেখে অনেকেই এই শিল্পে ঝোঁকে,
কিন্তু সীমাহীন বিশাল এই শিল্পের তল খুজে না পেয়ে আশাহত হয়ে অনেকেই গুটিয়ে নেয় নিজেকে আবার কেউ কেউ এই শিল্পে নিজেকে জড়িয়ে রাখে যথাসাধ্য। শিল্প সন্তানের মত তাকে ধারন করতে হয় সন্তান তুল্যে যেটা শিমুল মুস্তাফা সহ আরও অনেকেই করতেন কিন্তু সমস্যা হল নব্বয়ের দশকে আবৃত্তির জোয়ার যখন কিছুটা কমে তখন দিশাহীন হয়ে পড়ে অনেকেই এই শিল্প মাথার বালিশ পেটের ভাত যোগান দিতে পারবে কিনা সেই সন্দিহানে অনেকেই বাক শিল্পের ভিন্ন ভিন্ন কলায় নিজেদের নিযুক্ত করে যেখানে যার সুবিধা সে সেখানে। কেউ মঞ্চাভিনয়ে কেউ টেলিভিশন নাটকে আবার কেউ রাজিনীতিতে, আবৃত্তি তাদের লালিত্য পেলেও সেটা অনাদরে। কিন্তু শিমুল মুস্তাফা? আবৃত্তিই তার একমাত্র শিল্পসন্তান।
হোক এই সন্তান প্রতিবন্ধী, না দিক ভবিষ্যতের স্বস্তি ও পেটের ভাতের আশ্বাস তবু কিভাবে তাকে ছেড়ে যাবে আর কেনইবা যাবে। সন্তানতুল্য যে শিল্পকে সে ধারন করেছে তাকেই সে লালন করবে এটাই যে তাঁর ব্রত। শুরু হয় তাঁর সাধনার জীবন। ৪১ বছরের এই সাধনা যজ্ঞের শুরুটা হয়েছিল দৃষ্টি দিয়ে মাঝ পথে পেয়েছেন অন্তর্দৃষ্টি পরিশেষে পেয়েছেন দিব্যদৃষ্টি হয়েছেন দিব্যজ্ঞ্যানী, হয়ে উঠতে পেরেছেন পুরাদস্তুর আবৃত্তিশিল্পী, এসব’ই তার সাধনার ফল। দীর্ঘ্য এই পথপরিক্রমায় সহোযগী হিসেবে কাউকে কাউকে কখনও পেয়েছেন তাদের কেউ আবার হারিয়ে গেছেন কেউ আবার অকালে পৃথিবী ছেড়েছেন তিনি হয়েছেন একা তবুও তিনি দমেননি হতাশ হননি লক্ষ অটুট রেখে এগিয়ে নিয়েছেন নিজেকে কোন কিছুর আশায় না শুধুমাত্র ভালবাসার তাগিদে।নব্বয়ের দশকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবৃত্তিপ্রেমিদের ঘরে ঘরে পৌছে গিয়েছিল তার আবৃত্তির ক্যাসেট। অনেকেই তাঁকে শুনে শুনে কবিতা পড়া শিখেছে।
শিল্পব্যাঞ্জনা ও কন্ঠদ্যোতনা দিয়ে তিনি পৌছেছেন আবৃত্তিপ্রেমিদের অনুভুতির একেবারে শেষসীমানায়।বহু জনপ্রিয় ব্যান্ড সঙ্গীতের স্রষ্টা লতিফুল ইসলাম শিবলী তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন আবৃত্তির রকস্টার নামে।তিনি দুই বাংলাতেই সমান জনপ্রিয় তাঁর শিল্প, সাধনা ও আবৃত্তিশৈলিকে যথার্থ মর্যাদার চোখে দেখে এপার ওপার দুইবাংলার প্রতিথযশা বাচিক ও আবৃত্তিশিল্পিরা।কবি কাজি নজরুল ইসলাম যিনি গান ও কবিতা লিখে গাড়ি কিনেছিলে আর একমাত্র শিমুল মুস্তাফা যিনি কবিতা পড়ার টাকা দিয়ে গাড়ি কিনেছেন সেই প্রথম জীবনেই।
এখানে সহজেই অনুমেয় বরাবর’ই তিনি এই শিল্পের কোথায় অবস্থান করে এসেছেন।তাঁর হাতে গড়া আবৃত্তি সংগঠন বৈকুণ্ঠ এদেশের শীর্ষস্থানীয় আবৃত্তিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেখান থেকে প্রতিবছর শতশত ছেলে মেয়েরা আবৃত্তি শিক্ষা নিচ্ছে,হচ্ছে বাকশিল্পে দক্ষ, সেই সাথে পাচ্ছে যাপিত জীবনের দীক্ষাও।দেশ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল বা বিদেশে অবস্থানরত তাঁর কাছে শিক্ষাপ্রার্থীদের কথা ভেবে তিনি শুরু করেছেন “শিমুলের পাঠশালা” নামে অনলাইন ভিত্তিক আবৃত্তিশিক্ষা কার্যক্রম সেখানেও তাঁর শিক্ষার্থির সংখ্যা সহস্রাধিক।
দেশপ্রেমিক চীরকাল ভয়ডরহীন এবং দেশের স্বাধীনতা ও ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক এমন কোন কিছুর সাথে আপোষহীন শিমুল মুস্তাফা’র বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে যে কেও নতজানু হয়ে যায়।কবিতার পথে এখনো তিনি বিরামহীন ক্লান্তিহীন, প্রতিবছর রবীন্দ্রসদনে এক টানা সাত আট ঘন্টা ৭১ টা কবিতা পড়ে দশহাজারেরও অধিক শ্রোতাকে তিনি নিমগ্ন রাখেন।আবৃত্তিশিল্প আজ আবার মাথা উঁচু করে দাড়িয়েছে,দেশের অনেক প্রাজ্ঞ বাচিকরা এখন এই শিল্পে অধিকার স্থাপনে তৎপর।
কিন্তু শিমুল মুস্তাফা তিনি বাচিক নন তিনি পুরাদস্তুর আবৃত্তিশিল্পী, তাঁকে আমার আবৃত্তি দিয়েই চিনি,শিল্প প্রকাশের তাঁর আর অন্যকোন মাধ্যম নেই তিনি প্রমান করেছেন শুধুমাত্র কবিতা পড়েই শিমুল মুস্তাফা হওয়া যায় নামের পাশে শিল্পীর অভিধা অর্জন করা যায়,নির্দিষ্ট শিল্পের প্রতি ভালবাসা সাধনা আর একগ্রতা থাকলে সফলতা সম্ভব প্রকৃতিই কৃপাময়ি হয়ে তুলে ধরে তাঁকে।শিমুল মুস্তাফার তৈরি এই রুপরেখায় এখন অনেকেই নিজেকে সঁপে এগিয়ে যাচ্ছেন।দেশে প্রাজ্ঞ বাচিকের সংখ্যা নেহাত কম না। কিন্তু প্রাজ্ঞ আবৃত্তিশিল্পী নেহাতই কম বলা বাহুল্য বাচিক আর আবৃত্তিশিল্পী এক নন। বাচিক হল তিনি যিনি বাক শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেন। যেমন শম্ভুমিত্র তিনি কিংবদন্তী বাচিক কারন তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে সমমর্যাদায় কাজ করতেন কিন্তু সেখানে কিংবদন্তী আবৃত্তিশিল্পী এখনো পর্যন্ত দুইজন কাজী সব্যসাচি এবং প্রদীপ ঘোষ কারন তাঁদের শিল্প প্রকাশের প্রধান মাধ্যম আবৃত্তি। তেমনি আমাদের দেশেও সম্মানি ও জনপ্রিয় বাচিক অনেকেই আছেন কারন শুধুমাত্র কবিতাকে আঁকড়ে ধরে শিল্প সাধনার দুঃসাহস সবার ছিলনা। এজন্য মনে করি দেশের আবৃত্তি শিল্পকে সম্মান দিতে হলে একজন শিমুল মুস্তাফাকে অবশ্যই মুল্যায়ন করতেই হবে কারন তিনি পুরাদস্তুর আবৃত্তিশিল্পী
দেশে আবৃত্তিকর্মি হবে প্রতিবছরই,আবৃত্তিকারও হবে প্রতিনিয়ত যুগে যুগে আবৃত্তি শিল্পীও সৃষ্টি হবে।কিন্তু কবিতার পথে হাটতে হাটতে ক্লান্ত হয়ে কবিতার উপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে আবার কবিতার উপর জেগে উঠে বিরামহীন কবিতার পথে হেটে চলা শিমুল মুস্তাফাকে এ পৃথিবী হয়তো একবারই পায় বারবার পায়নাকো।
জন্মদিনে এই মহান শিল্পীকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা
তাঁর দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ কামনা করি।তাঁর কন্ঠে কবিতারা স্বস্তিতে থাক আরও অনেক দিন।
লেখকঃ-সাহিত্য ভঞ্জ চৌধুরী(আবৃত্তিকার, সাতক্ষীরা)