গণমাধ্যমে নির্বাচনী সংবাদ ও ফলাফল সংগ্রহ এবং প্রচার বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়ন নিয়ে মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে নির্বাচন কমিশন-ইসিকে।
নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাবিত নির্দেশনাগুলোর সমালোচনা ও সংশোধন দাবি করেন বেশিরভাগ সাংবাদিক। বিশেষ করে নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি, ভোট কেন্দ্রে দায়িত্বরত কোনো কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টের সাক্ষাৎকার প্রচার না করার নির্দেশনার সরাসরি বিরোধীতা করেন সাংবাদিকরা।
এমন বিরোধীতার মুখে তাৎক্ষণিকভাবে ‘পোলিং এজেন্টদের সাক্ষাৎকার নেয়া যাবে না’ এমন অলিখিত নির্দেশনা তুলে নেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ।
মতবিনিময়ে সাংবাদিকদের জন্য পেশাগত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন নীতিমালা না করার আহ্বান জানিয়ে ভোটকেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য আচরণবিধি, নীতিমালা করার জোর দাবি জানানো হয়।
নির্বাচনী সংবাদ প্রচারের অভিজ্ঞতা থেকে এই দাবি উত্থাপন করে সাংবাদিকরা অভিযোগ করেন, নির্বাচন কেন্দ্রগুলোতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে তাদের নানা ভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়।
মঙ্গলবার রাজধানীতে নির্বাচন ভবনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় ভোটের মাঠে কাজ করা সাংবাদিক এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের বক্তব্যে এসব বিষয় উঠে আসে।
এই মতবিনিময় সভার কার্যপত্র অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের মতে ভোট কেন্দ্রে শৃঙ্খলা, ফলাফল নিয়ে বিভ্রান্তি যেনো না হয় সেজন্য একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রয়োজন। কোনো আনুষ্ঠানিক নীতিমালা করা হয়নি জানিয়ে ভবিষ্যতে নীতিমালার ইঙ্গিত দিয়ে ১০টি নির্দেশনা তুলে ধরা হয়।
তবে মতবিনিময়ে বেশিরভাগ সাংবাদিক জানান, এসব নির্দেশনা সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে গণমাধ্যমের সামনে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে এবং ইতোমধ্যে হতেও শুরু করেছে।
সাংবাদিকদের জন্য প্রস্তাবিত ১০টি নির্দেশনার মধ্যে ৮ম নির্দেশনাটি হচ্ছে: ভোট কেন্দ্রের ভিতরে নির্বাচনে দায়িত্বপালনরত কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী, পোলিং এজেন্টের সাক্ষাৎকার নিতে পারবেন না।
বেসরকারি টেলিভিশন ‘বাংলা ভিশন’ এর বার্তা প্রধান মোস্তফা ফিরোজ এমন নির্দেশনার সমালোচনা করেন।
এ নির্দেশনা নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হবে মন্তব্য করে তিনি বলেন: এরকম কোন নির্দেশনা আগে তো কখনো ছিল না। নির্বাচন ভালো না মন্দ হচ্ছে এটা মিডিয়া কর্মীরা নিজে মুখে বলতে পারে না, সেটা বলার জন্য যারা দায়িত্বপালন করছেন তাদের বক্তব্য প্রচার করতে হয়। তাদের সাক্ষাৎকার প্রচার না হলে দেশের মানুষ বুঝতে পারবে না নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে কিনা। এরকম হলে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সংবাদে নির্বাচনের খবর প্রচার করার কোনো অর্থ থাকবে না।
আরও কয়েকজন সাংবাদিক প্রস্তাবিত ৮ নং নির্দেশনা নিয়ে সমালোচনা করায় তাৎক্ষণিকভাবে এই ধরনের নির্দেশনা দেয়ার চিন্তা থেকে সরে আসার কথা জানান নির্বাচন কমিশন সচিব।
অতীত নির্বাচন নিয়ে নিজের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, নির্বাচন কেন্দ্রে সহিংসতা হলে এখন সাংবাদিকরা দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের প্রশ্ন করতে পারবে না, প্রিজাইডিং কর্মকর্তা বলে দিতে পারবেন না আমার কথা বলা যাবে না, আমি কিছু দেখিনি। নির্বাচনে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে প্রিজাইডিং অফিসাররাইতো গণমাধ্যমে সেসব তুলে ধরবেন। তার যদি সেই অধিকার না থাকে তাহলে তো তার দরকারই নেই।
তবে নির্বাচনের সময় এবং ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রের শৃঙ্খলার স্বার্থে বর্তমান সময়ে কিছু বিধি আরোপের বাস্তবতাও এড়াননি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।
তাদের মতে, যদি সাংবাদিকরা সাংবাদিকতার পেশাগত নীতি মেনে চলতো তাহলে নির্বাচন কমিশনকে আলাদা করে নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহের কোনো নির্দেশনা, নীতিমালার করার কথা ভাবতে হতো না।
নির্বাচনী সংবাদ প্রচারে আর কোনো ক্ষেত্রে লিখিত নীতিমালা না হলেও ফলাফল প্রচারে নীতিমালা আরোপের আহ্বান জানান চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক ও চ্যানেল আই অনলাইনের সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান।
সাংবাদিকের পেশাগত নীতির বরখেলাপ হচ্ছে এমন ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, আমরা এতো নীতিনিষ্ঠ যে, সব কিছুতেই আমাদের জন্য একটি নীতিমালা লাগে। আমার মতে সাংবাদিকরা যদি সাংবাদিকতার নীতি মেনে চলেন, তাহলে ইসিকে আলাদা কোনো নীতি প্রণয়ন করতে হয় না। সেক্ষেত্রে নিশ্চয়ই আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যেও নীতিগত ত্রুটি আছে।
প্রস্তাবিত নির্দেশনার ‘ঘ’ বা ৪ নম্বরের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্ট করার আহ্বান জানিয়ে জাহিদ নেওয়াজ খান বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী বা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিত্ব থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। এই নির্দেশনা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের প্রতি নাকি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকের প্রতি? কারণ সাংবাদিকরা পেশাজীবী হিসেবে বিভিন্ন প্রার্থীকে সমর্থন জানাচ্ছেন। গাজীপুরে একদল এবং খুলনায় একদল সাংবাদিক নেতা সরাসরি প্রার্থীদের সমর্থন জানিয়ে গণসংযোগে নেমেছেন।
মতবিনিময় সভায় কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও মাঠ পর্যায়ের সংবাদকর্মীদের উপস্থিতি ছিল পত্রিকার তুলনায় বেশি। এতে নির্বাচন কমিশন সচিব ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন নির্বাচন কমিশনের যুগ্ম-সচিব মিজানুর রহমান, যুগ্ম-সচিব (জনসংযোগ) এস এম আসাদুজ্জামান প্রমুখ।