অনলাইন ডেস্ক: আপানার মনে হচ্ছে আপনি যাকে ভালোবাসেন বা যার সাথে আপনি আপনার জীবন পাড় করছেন সেই জীবন সঙ্গী বা সঙ্গীনি হয়তো পুরোপুরি সৎ নন। আপনার ধারণা সঠিক হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মিথ্যা কথা বলা একটি সহজাত ও স্বাভাবিক ব্যাপার। সবাই মিথ্যা বলে। আপনি আমি জীবনে চলতে যেয়ে কম বেশি মিথ্যা বলেছি আর বলছিও। কিন্তু যদি ব্যপারটা এমন মনে হয় যে আপনার সঙ্গীর অসততা আপনার সুখ ও বিশ্বস্ততার উপর হানা দিচ্ছে, তাহলে আপনার জন্য উচিৎ হবে তার অসততার প্রমাণ তার সামনে হাতেনাতে তুলে ধরা।
আপনার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গীনি যদি একাধিক মানুষের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক রাখেন তাহলে আপনার পক্ষে তা জানা সম্ভব নয় আর বিজ্ঞান তা আপনাকে বলে দিতে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হল প্রতারক জীবন সঙ্গী বা সঙ্গীনিকে হাতে-নাতে ধরা। এছাড়া বিকল্প কোনো উপায় আপনার কাছে থাকতে পারে না।
আপনার জীবন সঙ্গী বা সঙ্গীনি আপনার সঙ্গে প্রতারণা করছে কিনা তা বুঝতে পারার জন্য খুবই সাধারণ ৭টি উপায় আপনাদের সামনে তুলে ধরবো যেগুলোর মাধ্যমে বুঝতে পারবেন আপনার প্রিয় মানুষটি প্রতারক কিনা-
১. কোনো বন্ধুকে জিজ্ঞেস করুন
অন্য লোকদের এমনকি অচেনা পথচারিরও কোনো নারী-পুরুষের সম্পর্কে গোলমাল আছে কিনা তা বুঝার এক অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে।
বিওয়াইইউ মনোবিজ্ঞানীরা কয়েকটি দম্পতিকে একসঙ্গে করতে হয় এমন কাজ করতে দিয়ে এই ধারণাটির সত্যতা নির্ণয়ে একটি পরীক্ষা চালান। প্রতিটি যুগলের একজনকে কাজটি কীভাবে করতে হবে সে সম্পর্কে আগে থেকেই দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। আর অপরজনকে সে ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা হয়। এরপর পুরো বিষয়টি ভিডিওতে ধারণ করা হয়। কাজটি শুরু করার আগে প্রতিটি যুগলের সদস্যদেরকে আলাদা আলাদা ভাবে তাদের সম্পর্ক নিয়ে গোপনে কিছু প্রশ্ন করা হয়। তারা তাদের সঙ্গী বা সঙ্গীনির সাথে কখনো যৌন বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন কিনা তাও জিজ্ঞেস করা হয়।
এরপর গবেষকরা কয়েকজন অচেনা পথচারিকে ওই ভিডিও দেখিয়ে অনুমান করতে বলেন, কোন যুগলের সদস্যরা তাদের সঙ্গী বা সঙ্গীনির সাথে প্রতারণা করেছেন। অচেনা স্বেচ্ছাসেবিরা বিস্ময়করভাবে সঠিক অনুমানটিই করেছেন।
গবেষণায় প্রমাণিত হয়, একত্রে করতে হয় এমন কোনো কাজ কোনো দম্পতিকে করতে দিয়ে তাদের আচার আচরণ পর্যবেক্ষণ করেই বলে দেওয়া সম্ভব তারা অসুখি কিনা বা পরস্পরের সঙ্গে যৌন বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন কিনা।
২. অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময় বিষয়টি নিয়ে ভাবুন
কারো চরিত্র সম্পর্কে সচেতনভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে দিলে লোকে সাধারণত বেশিরভাগ সময়ই ভুল করেন। কিন্তু যখন আমরা অবচেতনে হুটহাট কারো তৎপরতার বিচার করি তখনই আমার সত্যটা অনুধাবন করতে পারি।
২০১৩ সালের একটি গবেষণায়ও তেমনটিই প্রমাণিত হয়েছে। ওই গবেষণায় মনোবিজ্ঞানীরা একদল শিক্ষার্থী বিচারককে লোকের সাক্ষ্য দেওয়া প্রত্যক্ষ করে কে সত্য বলেছেন আর কে মিথ্যা বলেছেন তা নির্ণয় করতে বলেন। যেসব শিক্ষার্থী খুবই অল্প সময়ের মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তারা মিথ্যবাদিদেরকে সহজেই শনাক্ত করতে পেরেছেন।
এই গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়, মানুষের মন সত্য এবং প্রতারণার মধ্যে পার্থ্যক্য করায় অক্ষম নয়। তবে অচেতনভাবেই শুধু মানুষের মন এই পার্থ্যক্য নির্ণয়ে সবচেয়ে বেশি সক্ষম থাকে।
৩. যেসব শব্দ ব্যবহার করে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনুন
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় যুক্তরাজ্যের সাউদার্ন মেথোডিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জেমস ডব্লিউ পেনিবেকার একটি টেক্সট অ্যানালাইসিস প্রোগ্রাম থেকে সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি এবং তার সহকর্মী ডিয়ানে বেরি ওই তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন।
গবেষণায় তারা দেখতে পান, ভাষার বিশেষ কিছু কাঠামো পর্যবেক্ষণ করে কেউ সত্য এড়িয়ে গেছেন কিনা তা অনুমান করা সম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে, মিথ্যাবাদিরা এই তিন ধরনের শব্দ খুব কমই ব্যবহার করেন:
প্রথম ব্যক্তি শব্দ: “আমি”, “আমাকে”, বা “আমার”। জ্ঞানীয় শব্দ: “উপলব্ধি” বা “চিন্তা”। বর্জনকর শব্দ: “কিন্তু” বা “ব্যাতীত”। তবে তারা এই ধরনের শব্দগুলো বেশি ব্যবহার করেন। নেতিবাচক আবেগ প্রকাশক শব্দ: “ঘৃণা”, “রাগ”, বা শত্রু
গতি ক্রিয়া: “হাঁটা”, বা “চলা”
৪. গলার স্বরের আকর্ষণীয়তা পর্যবেক্ষণ করুন
কানাডার গবেষকরা সম্প্রতি একটি গবেষণায় একদল স্বেচ্ছাসেবি লোককে একজোড়া গলার স্বর শুনতে দিয়ে কে কতটা আকর্ষণীয় আওয়াজ করছেন তার মূল্যায়ন করতে বলেন। এরপর গবেষকরা তাদেরকে ওই দুজনের প্রত্যেকে কোনো রোমান্টিক সম্পর্কে কতটা প্রতারণা প্রবণ হবেন তারও মূল্যায়ন করতে বলেন।
নারী সেচ্ছাসেবকদের বেশিরভাগই বলেছেন, নিচু আওয়াজের গলার স্বর সম্পন্ন পুরুষরা তাদের সঙ্গীনিদের সাথে যৌন বিশ্বাসঘাতকতা করবেন। আর পুরুষদের বেশিরভাগই অনুমান করেছেন যে, উঁচু আওয়াজের গলার স্বর সম্পন্ন নারীরা তাদের সঙ্গীর সাথে যৌন প্রতারণা করবেন।
গবেষণায় আরো দেখা গেছে যেসব পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরন হরমোন নিঃসরনের হার বেশি তাদের গলার স্বর অনেক বেশি গভীর এবং ভরাট হয়। আর যেসব পুরুষের দেহে টেস্টোস্টেরন হরমোনের পরিমাণ বেশি তারা যৌন বিশ্বাসঘাতকতাও করেন বেশি।
৫. সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহারের অভ্যাস পর্যবেক্ষণ
আপনার সঙ্গী বা সঙ্গীনি কি আপনার সাথে কথা বলার চেয়ে বরং স্নাপচ্যাট করেই বেশি সময় ব্যয় করেন? সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ফেসবুক এবং টুইটার এই দুটি সামাজিক গণমাধ্যমে বেশি সক্রিয় তারা সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার সংশ্লিষ্ট সংঘাতে বেশি জড়ান। যার ফলে তাদের মধ্যে “যৌন অবিশ্বস্ততা”, “সম্পর্ক ভাঙ্গা” এবং বিয়ে বিচ্ছেদের মতো ঘটনা ঘটার হারও বেশি দেখা যায়।
৬. আচার-আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন লক্ষ্য করুন
মুখের অভিব্যক্তি থেকে শুরু করে কথা বলার ধরণসহ দেহভঙ্গিগুলোতে হঠাৎ পরিবর্তন প্রতারণাপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্টেরই লক্ষণ প্রকাশ করে। এমনটাই বলেছেন একসময় এফবিআইয়ে আচরণ বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করা গবেষক লিলিয়ান গ্লাস।
মিথ্যা বলার সময় স্নায়বিক দুর্বলতা ও টেনশনে ভোগার কারণে দেহভঙ্গিগুলোতে এই পরিবর্তন দেখা দেয়। লিলিয়ান গ্লাস তার লিখিত বই “দ্য বডি ল্যাঙ্গুয়েজ অফ লায়ারস”-এ এ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
৭. নীরবতা, ব্যক্তিগত আক্রমণ, বা প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি
লিলিয়ান গ্লাস বলেন, মিথ্যা বলার একটি স্পষ্ট লক্ষণ হলো হঠাৎ করেই কথা বলায় অক্ষমতা। এটা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই ঘটে। কারণ মিথ্যা বলার সময় যে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয় তার প্রতি আমাদের স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র প্রায়ই মুখের ভেতর লালা নিঃসরণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে।
প্রতারক চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো, জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বরং ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসবে। সিআইএ সদস্য ফিলিপ হাউস্টন, মাইকেল ফ্লয়েড এবং সুসান কার্নিসেরো তাদের সাম্প্রতিক বই “স্পাই দ্য লাই”-তে এমনটাই বলেছেন।
২০১১ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেসের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আর এডওয়ার্ড গিজেলম্যান দেখতে পান যারা মিথ্যা বলেন তারা কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়ার আগে সে প্রশ্নটি পুনরাবৃত্তি করার প্রবণতা প্রদর্শন করেন। সম্ভবত মিথ্যা কোনো উত্তর তৈরি করতে নিজেদেরকে সময়-সুযোগ করে দেওয়ার জন্যই তারা এমনটা করে থাকেন।