অনলাইন ডেস্ক: প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন জাহিদ হাসান আকাশ। যিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদভুক্ত ‘গ’ ইউনিটে ফেল করেছিলেন। এজন্য তার প্রথম হওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিষয়ে তদন্ত ও যাচাই শেষে সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানিয়েছে। এদিকে, ওই শিক্ষার্থীর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টার ইউসিসির কানেকশন পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাবির বিভিন্ন ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি হচ্ছে। এর সঙ্গে ইউসিসির জড়িতের খবর বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ঢাবির বিভিন্ন ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির সঙ্গে ইউসিসি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল বলে ওই বছর আটক শিক্ষার্থীরা স্বীকারোক্তি দেন। সেই সময় কোচিং সেন্টারটির যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের ম্যানেজার অরুণ কুমার দাসসহ ইউসিসির কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা ও শিক্ষক এ অসাধু কাজে জড়িত বলে অনুসন্ধানে বের হয়ে আসে।
জানা গেছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হওয়া জাহিদ হাসান আকাশ ইউসিসির উত্তরা ব্রাঞ্চের ছাত্র ছিলেন। ক্লাসে আশানুরূপ ফলাফল করতে না পারলেও তিনি ইউনিটটিতে রেকর্ড ১১৪ দশমিক ৩০ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছেন, যা গত ২০ বছরেও কেউ পাননি। এরপর তাকে নিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচারে নামে ইউসিসি।
জাহিদ হাসান আকাশের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তিনি বাংলায় ৩০ এর মধ্যে ৩০, ইংরেজিতে ৩০ এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৩০, সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ বিষয়াবলিতে ২৮ দশমিক ৩০ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ২৫ দশমিক ৫০ পেয়েছেন। অথচ তিনি নিজের ব্যবসায় শাখার ‘গ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় বিশাল ব্যবধানে ফেল করেন। গ ইউনিটে পান মাত্র ৩৪ দশমিক ৩২ নম্বর। যেখানে বাংলায় ১০ দশমিক ৮, ইংরেজিতে ২ দশমিক ৪০, হিসাব বিজ্ঞানে ৫ দশমিক ২৮, ব্যবসায় নীতিতে ৬ দশমিক ৭২ এবং ফিন্যান্সে ৯ দশমিক ৮৪ নম্বর পান।
গতকাল ফল প্রকাশের পরই নিজেদের ফেসবুক পেজে ইউসিসি একটি স্ট্যাটাস দেয়। যেখানে লেখা ছিল- ‘আলহামদুলিল্লাহ, এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ‘ঘ’ ইউনিট থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেছে ইউসিসির কৃতী শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান আকাশ (ব্যবসায় শিক্ষা)। বিস্তারিত পরে জানানো হবে। দুই ঘণ্টার মধ্যে তাকে নিয়ে লাইভে আসছি…’।
এর কিছুক্ষণ পর তাকে নিয়ে লাইভে আসেন ইউসিসির পরিচালক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী। যেখানে তিনি নিজের কোচিংয়ের সফলতা জাহির করেন এবং জাহিদকে মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রমাণ করতে শুরু করেন। সুকৌশলে জাহিদকে দিয়ে নিজের কোচিং সেন্টারের সাফল্য প্রচার করেন কামাল পাটোয়ারী। এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আজ ইউসিসির প্রচারিত বিজ্ঞাপনেও জাহিদকে হাইলাইট করা হয়।
জানা গেছে, ইউসিসি চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে চড়ামূল্যে নিজেদের কোচিংয়ে শিক্ষার্থী টানে। বিভিন্ন সময় ডিজিটাল জালিয়াতিতে অভিযুক্তদের দিয়েও বিজ্ঞাপন প্রচার করে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার সন্দেহের তালিকায় থাকা ‘ঘ’ ইউনিটে প্রথম হওয়া জাহিদ হাসান আকাশকেও বিজ্ঞাপনে নিয়ে আসে।
এর আগেও ২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে ‘ঘ’ ইউনিটে জালিয়াতি করে তৃতীয় হওয়া অয়ন কুমার দাস, পঞ্চম স্থান লাভ করা তাজরিন আহমেদ মেধা এবং ৭৮তম স্থান লাভ করা নূর মাহফুজা দৃষ্টিকে দিয়ে ইউসিসি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিল। তাদের মধ্যে অয়ন কুমার ইউসিসি যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের ছাত্র এবং ওই ব্রাঞ্চেরই ম্যানেজার অরুণ কুমার দাসের ছেলে ছিলেন। ছেলের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন অরুণ কুমার পরীক্ষার দিন সকালে সরবরাহ করেছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল।
অন্যরা ইউসিসি বগুড়া ব্রাঞ্চের শিক্ষার্থী ছিলেন। ওই ব্রাঞ্চের জীববিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক অর্ণব চৌধুরী মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের প্রশ্ন সংগ্রহ করেছিলেন বলে তখন স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন শিক্ষার্থীরা।
এবার প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান আকাশের সঙ্গে ইউসিসির সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোচিং সেন্টারটির পরিচালক কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘জাহিদ ইউসিসি কোচিংয়ের উত্তরা ব্রাঞ্চের ছাত্র ছিল। তবে কেউ অপরাধ করলে তো কোচিংকে ধরার সুযোগ নেই।’
অভিযুক্তদের কিংবা সন্দেহের তালিকায় যারা আছেন, তাদের দিয়ে কেন বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে আমাদের উত্তরা ব্রাঞ্চে এসেছিল, সেখান থেকে আমরা তাকে ফার্মগেট নিয়ে আসি এবং ফেসবুক লাইভে আসি।’
বিভিন্ন সময় ডিজিটাল জালিয়াতির সঙ্গে তার কোচিংয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগের বিষয়ে কামাল উদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, ‘কেউ প্রতিষ্ঠানের ভেতরে থেকে অপরাধ করলে প্রতিষ্ঠান কীভাবে দায়ী থাকে? তারপরও এর আগে যখন যাত্রাবাড়ী ব্রাঞ্চের অরুণের কথা শোনা যায়, আমরা তখন তাকে বরখাস্ত করেছিলাম। এখনও যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’
এদিকে, গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত হওয়া ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নফাঁস হয়নি জানিয়ে বলেন, এটা ডিজিটাল জালিয়াতি। এরপর সোমবার ফল প্রকাশ স্থগিত করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার ফল প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা যায়, ‘ঘ’ ইউনিটে নিকট অতীতে সর্বোচ্চ ফলাফল হয়েছে, যা ক্ষেত্র বিশেষে দুই থেকে তিনগুণ। ২৬ দশমিক ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী এতে পাস করেছেন।
প্রথম হওয়া শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান আকাশের বিষয়ে ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও ‘ঘ’ ইউনিটের সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, ‘আমরা তাকে ভর্তি করিনি। তার ফল প্রকাশ হয়েছে। তার বিষয়ে তদন্ত ও যাচাই শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে এবং প্রমাণ হলে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
এর মাধ্যমে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ জোরালো হলো কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এটা প্রশ্নফাঁস নয়, ডিজিটাল জালিয়াতি। যারাই অভিযুক্ত হবে তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান হবে এবং ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
১২০ নম্বরের মধ্যে ১১৪ দশমিক ৩০ পাওয়ার বিষয়ে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানকে প্রশ্ন করা হয়। সে সময় তিনি বলেন, ‘কারও মেধা নিয়ে আমরা প্রশ্ন করতে পারি না। তবে কাউকে সন্দেহ হলে ডিন তাদের ব্যাপারে পুনরায় যাচাই করতে পারেন।’