দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনী কার্যক্রম পুরোদমে শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্ব এখনো তৃণমূলকে কোনো নির্দেশনা দিতে পারেনি। নির্বাচনে যাওয়া-না যাওয়া নিয়েও মতবিরোধ আছে দলে; যদিও বলা হচ্ছে এ সপ্তাহেই ধোঁয়াশা কেটে যাবে।
নির্বাচনের আমেজ ক্ষমতাসীন দলে
সংলাপ সফল না হওয়া সত্ত্বেও বিরোধী পক্ষের কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ায় অনেকটাই নির্ভার আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটির মনোযোগ এখন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে। এ মাসের মধ্যেই দলীয় মনোনয়নপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে ভোটের মাঠে নেমে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ১৩-১৫টি আসন ছেড়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগ। আর অন্য মিত্রদের জন্য ৬০-৬৫টি আসন রাখার পরিকল্পনা আছে দলটির। অর্থাৎ ১৪ দলের শরিক ও অন্য মিত্রদের ৭০-৮০টি আসন ছেড়ে দিয়ে বাকি ২২০-২৩০টি আসনে দলীয় প্রার্থী দিতে পারে আওয়ামী লীগ। তবে সব কিছু নির্ভর করছে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি কী হয় তার ওপর। বিএনপি ভোটে না এলে ১৪ দলের শরিকদের আসন আরো বাড়তেও পারে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী, সম্পাদকমণ্ডলী ও সদস্য সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের কয়েকজন সদস্য এবং ১৪ দলের শরিক কয়েকটি দলের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ওই নেতারা বলেন, বিএনপি এখন আর নির্বাচনে না এসে পারবে না বলেই তাঁরা মনে করছেন। আর বিরোধী পক্ষ শেষ পর্যন্ত আন্দোলনে গেলে আলোচনার পাশাপাশি প্রশাসনিক পদক্ষেপও নেওয়া হবে। তবে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত আলোচনার দরজা খোলা রাখতে চায় ক্ষমতাসীনরা। এরপর প্রয়োজন হলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা জানান, সুষ্ঠুভাবে সংলাপ করতে পারায় তাদের শীর্ষ নেতৃত্ব উচ্ছ্বসিত। দলটির নীতিনির্ধারকরা এই ভেবে বেশ স্বস্তিতে আছেন যে সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁদের আন্তরিকতা প্রকাশ করার কিছু বাকি নেই। যা যা করা দরকার ছিল সব করা হয়েছে। সংলাপে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মত নেওয়া হয়েছে। প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রাধান্য থাকা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে দুই দফা সংলাপে সামগ্রিক বিষয়ে কথা বলেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেছেন, সংলাপ শেষ হলেও আলোচনার দরজা এখনো খোলা রয়েছে। তাই বিরোধী দল বিএনপি চাইলে এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের এ চেষ্টা আন্তর্জাতিক মহল ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বলে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসে কথা বলে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এখন বিএনপি নেতাদের কর্মকাণ্ডে মনে হচ্ছে তাঁরা নির্বাচনে আসবে। আমাদের পুরো মনোযোগ এখন নির্বাচন ঘিরে। নেতাকর্মীদের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। আগামী কয়েক দিন আমরা নির্বাচনে জোটের শরিকদের মনোনয়ন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করব।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পূর্ণ আন্তরিকভাবেই সংলাপে বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বারবার বলেছেন, যা কিছু করা দরকার তা সংবিধানের মধ্যে থেকেই করতে হবে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশন বৃহস্পতিবার জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যদি আরো কিছু করার প্রয়োজন হয়, নির্বাচন কমিশন তা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করবে।’
জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কী করতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। গত মঙ্গলবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবং গতকাল রাজশাহীতে তাদের জনসভা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে ক্ষমতাসীন দল। রাজশাহীর জনসভায় যাননি ফ্রন্টের শীর্ষনেতা ড. কামাল হোসেন। তাই আলোচনার পথ এখনো খোলা রয়েছে বলে বিশ্বাস আওয়ামী লীগ নেতাদের। আন্দোলনের পাশাপাশি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আবার আলোচনায় এলে ক্ষমতাসীনরা নিরুৎসাহিত করবে না। তবে সংবিধানের মধ্যে থেকেই করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজনে খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় ঠাঁইও হতে পারে বিরোধী পক্ষের দু-চারজনের। সেই প্রস্তুতিও সরকারের আছে। পাশাপাশি বিএনপি যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ না পায় সে লক্ষ্যে চাপ অব্যাহত রাখতে নাশকতার বিভিন্ন মামলায় আসামি গ্রেপ্তার অভিযান চালাবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে তাদের পক্ষ থেকে আর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হবে না। ঐক্যফ্রন্ট আলোচনা করতে চাইলে কেন্দ্রীয় নেতা পর্যায়ে তা হতে পারে। আলোচনা চলতে থাকলে এর অগ্রগতি জেনে সিদ্ধান্ত দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নির্বাচনী কাজে পুরো মনোযোগ: বর্তমানে আওয়ামী লীগ নির্বাচনী কাজে পুরোপুরি মনোযোগী। দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতাদের মধ্যে গতকাল থেকে দলীয় ফরম বিতরণ ও জমা নেওয়া শুরু হয়েছে। আগামীকাল রবিবার বিকেলে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক ডাকা হয়েছে। ওই বৈঠকের মাধ্যমে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত করার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু হবে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আগেই তা শেষ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে হাতে আছে মাত্র ১৯ দিন। এই ১৯ দিনের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিতরণ ও জমা নেওয়া, মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, একসময়ের মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টি, নতুন মিত্র এ কিউ এম বদরুদ্দৌজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার বাংলাদেশ জাতীয় জোট ও তৃণমূল বিএনপি এবং ১৪ দলের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে আসন বণ্টনের বিষয় রয়েছে।
মিত্রদের দেওয়া হতে পারে ৭০-৮০টি আসন: আওয়ামী লীগের সদস্য সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের একাধিক সদস্য এবং ১৪ দলের শরিক কয়েকটি দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা জানান, আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোকে ১৩-১৫টি আসন ছেড়ে দিতে পারে। আর অন্য মিত্রদের জন্য ৬০-৬৫টি আসন ছেড়ে দিয়ে ২২০-২৩০টি আসনে দলীয় প্রার্থী দিতে পারে আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপি ভোটে না এলে ১৪ দলের শরিকদের আসন আরো বাড়বে।
ওই নেতারা জানান, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) চার থেকে ছয়টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি চার থেকে ছয়টি, বাংলাদেশ জাসদ দুটি, জাতীয় পার্টি (জেপি) এক-দুটি, তরীকত ফেডারেশন একটি আসনে ১৪ দলের মনোনয়ন পেতে যাচ্ছে।
১৪ দলের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘জোটের শরিকরা যার যার মতো দলীয় মনোনয়নপত্র বিতরণ করতে শুরু করেছে। আমরাও আমাদের মনোনয়নপত্র বিতরণ করছি। এরপর একটা তালিকা নিয়ে আমরা শরিকদের সঙ্গে বসব। দেখব কোথায় কার যোগ্য প্রার্থী আছে।’ গতবারের চেয়ে এবার শরিকদের বেশি আসন ছেড়ে দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে মোহাম্মদ নাসিম বলেন, ‘আমার মনে হয় না তাদের আসন আর বাড়বে। গতবার যা ছিল তার কাছাকাছিই থাকবে।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘১৪ দলের শীর্ষ নেতারা মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। আমরা ৭০-৮০টি আসন মিত্রদের ছেড়ে দেব। এই আসনগুলো ১৪ দলের শরিক, জাতীয় পার্টি এবং অন্যদের কারো সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের মধ্যে ভাগ হবে।’
আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলেন, ‘১৪ দলের শরিকদের অনেকেই অনেক বেশি আসন দাবি করছেন। বাস্তবতা হলো দু-তিনটি দল ছাড়া অন্যদের শক্ত কোনো প্রার্থী নেই। কিন্তু প্রায় সব দলই ১৫-২০টি করে আসন দাবি করেছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘এটুকু বলতে পারি, বিএনপি নির্বাচনে এলে গতবারের চেয়ে এবার শরিকদের বেশি আসন ছেড়ে দেওয়ার সম্ভাবনা কম।’
১৪ দলের একাধিক সূত্র মতে, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ জাসদ, জেপি, তরীকত ফেডারেশন—এ পাঁচটি দলের প্রার্থীরা ১৪ দলের মনোনয়ন পেতে যাচ্ছেন। সাম্যবাদী দল, ন্যাপ, গণতন্ত্রী পার্টি, কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ-আজাদী লীগ, বাসদ—এ দলগুলো কোনো আসন পাচ্ছে না। তবে সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া চট্টগ্রাম থেকে একটি আসনে মনোনয়ন পেতে জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গণতন্ত্রী পার্টি এবং ন্যাপও অন্তত একটি করে আসন পেতে আগ্রহী।
বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসন ছাড়া জাসদের তিনজন সদস্য আছেন। তাঁরা হলেন জাসদ সভাপতি হাসানুল ইক ইনু, দলের সাধারণ সম্পাদক শিরীন আখতার ও দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য রেজাউল করিম তানসেন। আরো অন্তত ১৫ নেতার মনোনয়নের জন্য জোর দাবি জানাবে দলটি। তাঁদের মধ্যে আছেন সাবেক সংসদ সদস্য শাহ জিকরুল আহমেদ, জায়েদুল কবির, কুমারেশ রায়, শফিকুল ইসলাম মিন্টু ও শহীদুল ইসলাম। তবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একাধিক সদস্য জানান, জাসদের বর্তমান তিন সংসদ সদস্যের বাইরে আর এক-দুজনকে মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা আছে।
বর্তমান সংসদে সংরক্ষিত আসন ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টির ছয়জন সদস্য আছেন। তাঁরা হলেন দলটির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা, পলিটব্যুরোর সদস্য মোস্তফা লুৎফুল্লাহ, ঠাকুরগাঁও জেলা সভাপতি ইয়াসিন আলী, নড়াইল জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান ও বরিশাল জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান। এ ছাড়া দলের পলিট ব্যুরোর সদস্য নূর আহমেদ বকুল ও ইব্রাহিম খলিলের মনোনয়নের জন্য জোর দাবি জানিয়েছে দলটি। তবে ওয়ার্কার্স পার্টিকে চার-ছয়টি আসন ছেড়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগ।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে জাসদ ভেঙে একটি অংশ বাংলাদেশ জাসদ গঠন করে। বর্তমান সংসদে দলটির দুজন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা হলেন দলটির কার্যকরী সভাপতি মইন উদ্দীন খান বাদল ও সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান। এবার দলটির পক্ষ থেকে আরো তিন-চারটি আসনে মনোনয়ন চাওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরিফ নুরুল আম্বিয়া নড়াইল-১, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক আনিচুজ্জামান আনিচ বরিশাল-২ আসনে নির্বাচন করতে চান। তবে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানিয়েছে, এবার বাংলাদেশ জাসদকে দুটির বেশি আসন ছাড়া হবে না।
বর্তমান সংসদে জেপির দুজন সদস্য আছেন। আসন্ন নির্বাচনে দলটির চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মনোনয়ন নিশ্চিত হলেও আর কোনো আসন ছেড়ে দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ।
বর্তমান সংসদে তরীকত ফেডারেশনের দুজন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা হলেন দলের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী আর সাবেক মহাসচিব এম এ আউয়াল। আউয়াল কিছুদিন আগে নতুন দল গঠন করেন। আগামী নির্বাচনে তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যানকে একটি আসন ছেড়ে দেবে আওয়ামী লীগ। যদিও দলটির পক্ষ থেকে অন্তত দুটি আসনের জন্য দর-কষাকষি চলছে।
জোটের মনোনয়ন নিয়ে সম্প্রতি গণভবনে ১৪ দলের সঙ্গে এক বৈঠকে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সিট চান অসুবিধা নাই। কিন্তু চিন্তা করে দেখেন কোথায় জিততে পারবেন। যেখানে জিততে পারবেন—এমন আসন চান। আমরা মনোনয়ন দেব। হারলে কিন্তু আপনাদের দায়িত্ব নিতে হবে।’
নির্দেশনা নেই বিএনপির, তৃণমূলে হতাশা
এ মুহূর্তে অনেকটাই দিশাহারা বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বর্তমানে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাবন্দি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান লন্ডনে অবস্থান করছেন। ফলে বিএনপি চলছে দলের স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে। আর সিদ্ধান্তগুলো আলোচনা হচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে। কিন্তু যাদের দিয়ে আন্দোলন বা নির্বাচনের সুফল ঘরে তুলতে হবে, বিএনপির সেই তৃণমূলের নেতাকর্মীরাই বুঝতে পারছে না কী করতে হবে। আবার নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে কেন্দ্রে মতবিরোধও রয়েছে। এর ফলে কর্মীদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, সুনসান নীরবতার মধ্য দিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানোর মতো এবার আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ, নাকি ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া হবে—এ নিয়ে কেন্দ্র থেকে পরিষ্কার কোনো বার্তা পৌঁছেনি বিএনপির তৃণমূলে। এ অবস্থায় দ্রুত সিদ্ধান্ত চায় বিএনপির তৃণমূল।
জানা গেছে, বিএনপির প্রার্থী বাছাই এবং নির্বাচনী ইশতেহার প্রায় চূড়ান্ত আছে। তারেক রহমানের তত্ত্বাবধানে প্রার্থী বাছাইয়ের কার্যক্রম মূলত শেষ হয়েছে।
বিএনপি নেতারা বলেছেন, চলতি সপ্তাহেই এই ধোঁয়াশা কেটে যাবে। কারণ আজ শনিবার জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। তবে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বৈঠকে নির্বাচনে তফসিল পেছানো ও খালেদা জিয়ার মুক্তির পন্থা বের করতেই বেশি মনোযোগী হবেন নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘আমরা নির্বাচনে থাকছি, নাকি আন্দোলনের কর্মসূচি কঠোর করছি, তা চলতি সপ্তাহের মধ্যেই পরিষ্কার হবে। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সমন্বয়ক মোহাম্মদ শাহজাহান ও যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, তফসিল পেছানো ও চেয়ারপারসনের মুক্তির বিষয়ে আমরা বেশি মনোযোগ দেব।’
কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আজকালের মধ্যে দেখা করার চেষ্টা করবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ সিনিয়র নেতারা। এর পরই দলের সিদ্ধান্ত আসবে। অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে বেশির ভাগ সদস্য নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন।
অন্যদিকে শীর্ষ দুই নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনে যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন দলকে। এখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। বিষয়টি নিয়ে আজ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, ২০ দলীয় জোট ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হবে। শেষ দুটি বৈঠক হবে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে আর প্রথম বৈঠকটি হবে মতিঝিলে গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন বা বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের চেম্বারে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তফসিল পেছানোর দাবিতে আরো কয়েক দিন আন্দোলনের মাঠে থাকবে বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের দলগুলো। সাত দফার মূল দাবিগুলো থেকে সরে এ দুই দফায় তাদের আন্দোলন চলবে কয়েক দিন।
দলের নেতারা বলছেন, সাত দফার মূল দাবি যেহেতু মানা হয়নি, তাই খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং তফসিল পেছালে তাদের নির্বাচনের পথ খুলবে। গতকাল রাজশাহীর সমাবেশেও এই সুরে কথা বলেছেন নেতারা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ শুক্রবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। বিএনপিকে বাইরে রেখে আবারও নির্বাচন করার সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্যই বিএনপি আন্দোলনে যাবে। নির্বাচন আন্দোলনেরই একটি অংশ। সরকারের লক্ষ্যই হলো বিএনপি যেন নির্বাচনে না যায়। সুতরাং তাদের এই লক্ষ্য সিদ্ধ হতে দেব না। আমরা এবার নির্বাচনে যাওয়ার জন্য পুরোপুরি তৈরি হয়ে আছি।’
তবে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ‘সরকারের কাছে যদি আমরা এভাবে আত্মসমর্পণ করি তাহলে তো হলো না। কারণ সরকার সাত দফার কোনোটাই তোয়াক্কা করে না।’
বাগেরহাট জেলা বিএনপির সহসভাপতি ও বাগেরহাট-৩ আসনের মনোনয়ন প্রার্থী ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, ‘আন্দোলন ও নির্বাচন দুই ধরনের বার্তা দিয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। তবে আন্দোলন নাকি নির্বাচন, বিষয়টি পরিষ্কার করা হয়নি। এর পরও আমরা তৃণমূল অতীতের মতো প্রস্তুত আছি।’
কক্সবাজার জেলা বিএনপির সদস্য ও সদর আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী লুৎফর রহমান কাজল বলেন, ‘কেন্দ্র আমাদের মতামত নিচ্ছে আন্দোলন করব, নাকি নির্বাচন করব। বেশির ভাগ বলছেন, খালেদার মুক্তি ছাড়া যাওয়া সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্র কোনো সিদ্ধান্ত দেননি।’
বরিশাল জেলা উত্তর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বরিশাল-১ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, ‘আমাদের মতামতের ভিত্তিতে খুব দ্রুত কেন্দ্রীয় নেতারা সিদ্ধান্ত দেবেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে।’
কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নীরবতা: এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম বিক্রির প্রথম দিন যেমন জমজমাট ছিল, ঠিক তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। নয়াপল্টনের এই কার্যালয়ের সকাল ১১টায় সংবাদ সম্মেলন করেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী। সেখানে দলের কয়েকজন নেতাকর্মী ছিল। বিএনপির কার্যালয়ে নির্বাচনকেন্দ্রিক কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।
সকাল ও দুপুরে কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন গণমাধ্যমের কয়েকটি গাড়ি বিএনপির কার্যালয়ের সামনে রাখা। অল্প দূরে দাঁড়িয়ে আছে দাঙ্গা পুলিশের একটি দল। আর সাদা পোশাকে থাকা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কার্যালয়ের আশপাশে অবস্থান করছিলেন।
দুপুরে সংবাদ সম্মেলন শেষে গণমাধ্যমকর্মীরা কার্যালয় ত্যাগ করলে সেখানে নেমে আসে সুনসান নীরবতা। শুক্রবার সরকারি বন্ধের দিন হওয়াতে আশপাশের অফিসগামী মানুষও ছিল না। কয়েক নেতাকর্মী ও অফিসের স্টাফরা দপ্তরে বসে বিকেলে পর্যন্ত কাজ করেন। পরে দপ্তরের দায়িত্বে থাকা রিজভী ও দু-একজন নেতা ছাড়া বাকিরা কার্যালয় ত্যাগ করেন।