প্রত্যুষের নির্মল বাতাসের নির্জনতা ভেঙ্গে বাড়ির ছোট্ট আঙিনায় ধবধবে সাদা কাপড়ে ঢাকা। ক্লান্তি শেষে যেনো একাকী নিরালায় বিরাম। চির নিদ্রায়। মাথায় সাদাকালো চুল। মুদিত চক্ষু মুখমন্ডলে নেই হাসির ফোয়ারা। হাতে নেই রং, নেই তুলি। নেই তুলির আঁচড়ে অবিরাম বাংলাদেশ। চিরায়ত বাংলাদেশ। এ কোন জলিল?
পলাশপোলের বাড়ি ঘিরে রেখেছে শত মানুষ। মুখে তাদের কেবলই স্মৃতি কথা, ভালবাসার কথা, ভালো লাগার কথা, গল্প আড্ডার কথা। রাজনীতি সমাজ সংস্কৃতি শিল্প সাহিত্য সাংবাদিকতা চারুকলা কারুকলা ঘিরে যার ছিল অবাধ বিচরণ সেই এমএ জলিলের কথা।
সকাল থেকে গভীর রাত অবধি চিত্র শিল্প নিয়েই ব্যস্ত থেকেছেন এমএ জলিল। দিনভর আড্ডা জমতো তার ঈষিকায়। জলিল দুই নেত্রে দেখতেন সমাজকে। আর অন্তর নেত্র দিয়ে দেখতেন আরেক সমাজকে। এভাবে নিজের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতেন তুলির আঁচড়ে। আড্ডায় আসতো চা-সিগারেট, চপ-সিঙ্গাড়াসহ গরম গরম মুখরোচক খাবার। বৃষ্টি বাদলার দিনে আরও বেশি করে জমতো এ আসর। রংয়ে রংয়ে ভরে উঠতো ঈষিকাঘর। হাসি তামাসা হৈ হুল্লোড় করে মেতে থাকতেন তারা। এই শিল্পীর রং তুলিতে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ। বাংলার প্রকৃতি, ফুল পাখি বিস্তীর্ন নদী ধান ক্ষেত সবই দেখা দিয়েছে তার তুলির আঁচড়ে। উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় দিবস, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের ইতিহাসও। ঈষিকা অর্কেস্ট্রার এমএ জলিল এমন একক চিত্র প্রদর্শনী উপহার দিয়েছেন বারবার। ছেলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। ফিরছে না কেনো এই উদ্বেগ নিয়েই কাটছে মায়ের দিন। বাংলাদেশকে গ্রাস করছে দুর্নীতি সন্ত্রাস মাদক জঙ্গিবাদ। এদের পরাভূত করতে না পারলে কেমন বাংলাদেশ হবে তা নিয়ে প্রদর্শিত হয়েছে তেল রং চিত্র। তার একক প্রদর্শনীতে এসেছে ৫২ এর ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ মিছিল, প্রথম শহীদ মিনার, উনসত্তরে আসাদের আত্মত্যাগ, তর্জনী উচিয়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা, ৭১ এ গণহত্যা, নির্যাতিত শরণার্থীদের দেশ ত্যাগের করুণ চিত্র, রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুবিনাশী সংগ্রাম।তার তুলি দিয়েছে মহান বিজয় দিবসে মাতৃভূমিতে উল্লাসের চিত্র। সেই সাথে সাথে লাল সবুজের পতাকার উজ্জ্বল ছবিও উপহার দিয়েছেন তিনি। ছবিতে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতির আশংকার দৃশ্য। প্রয়াত জলিলের ৪৪ বছরের বন্ধু সাংসদ মুস্তফা লুৎফুল্লাহ বলেন, স্বৈরাচার বিরোধী সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঈষিকা ছিল আমাদের বাতিঘর। আন্দোলন সংগ্রামে তার ভূমিকা অসামান্য,কারও কোনো হুমকিতে ঈষিকার দরজা বন্ধ করেন নি তিনি। তার এখান থেকেই সংগঠিত হতাম আমরা। তার অকাল প্রয়াণে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গভীর শোক প্রকাশ করে জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, তার মৃত্যুতে শিল্প সংস্কৃতি ও চারুকলা অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি হলো। তাকে অনুকরণ ও অনুসরণ করে শৈল্পিক জগতে যারা প্রবেশ করে নিজেদের গড়ে তুলবে তারা বঞ্চিত হলো । চিত্রকর এমএ জলিলের সকল চিত্রকর্মকে সংরক্ষণ করা দরকার, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্ম তার কাছ থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
এমএ জলিলের চিত্রকলায় বারবার উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, জননেতা মওলানা ভাসানি, বৃটিশ বিপ্লবী মাষ্টারদা সূর্য সেন, নারী জাগরনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া, বীর কন্যা প্রীতিলতাসহ মনিষীদের তেজোদীপ্ত অবয়ব। আছে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক স্বৈরাচার নিপাত যাক’ দৃশ্যও। মার্কসবাদী চেতনা ধারণকারী শিল্পী এমএ জলিল ছিলেন একজন সমৃদ্ধ মানুষ। বিশুদ্ধ সাংস্কৃতিক চেতনার সাথে তার পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাকে একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসাবে তুলে ধরেছে। ১৯৮৭ সালে শিল্পী এমএ জলিলের প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় সাতক্ষীরা কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী মিলনায়তনে। জ্ঞান তাপস অধ্যক্ষ অসিত কুমার মজুমদার এই একক প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন। সেদিনের চিত্র প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল ভই লেনিন, কার্ল মার্কস, ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, মাও সে তুং এর প্রতিকৃতি। এ ছাড়া স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মজলুম জনেেনতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানি প্রমূখের প্রতিকৃতি সেদিন তুলে ধরেছিলেন তিনি। ১৯৯০ তে আরও একবার একক চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেন তিনি। এরপর ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে আরও দুই বার নিজের একক চিত্র উপহার দিয়ে চিত্রকর এমএ জলিল শৈল্পিক জগতে দৃঢ় স্থান করে নিয়েছেন। শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ বলেন জলিল ছিলেন মনে প্রাণে একজন শিল্পী, শিল্প ও সাংস্কৃতিক জগতে তিনি ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। এমন নম্র-ভদ্র বিনয়ী মানুষের বড়ই অভাব আমাদের সমাজে।
শিল্পীএমএ জলিলের রং তুলিতে ফুটে উঠেছে একটি বাংলাদেশ। শ্যামলে সবুজে স্নাত স্নিগ্ধ চিরায়ত বাংলার অমলিন প্রকৃতি । ফুল পাতা পাখি বিস্তীর্ণ নদী বর্ষায় বাংলা ধান সরষে ক্ষেত সবই দেখা দিয়েছে তুলি আঁচড়ে। উঠে এসেছে রক্তঝরা ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, লাল সবুজ পতাকা হাতে বিজয় দিবস, গণতন্ত্রের জন্য অবিরাম সংগ্রামের এক একটি ইতিহাস, এক একটি সংগ্রাম।সাতক্ষীরার ঈষিকা অর্কেস্ট্রার এমএ জলিল তার তৃতীয় একক চিত্র প্রদর্শনী উপহার দিয়েছিলেন ৭৪ টি জলরং ছবি নিয়ে । শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত পাঁচদিনব্যাপী এ চিত্র মেলা শেষ হয় ২০১৬ এর শেষ সূর্যাস্তের দিন শনিবার। শিল্পকলা ভবনের প্রাচীর জুড়ে ৭৪ টি জল রং ছবির প্রস্ফূটিত চিত্র কেড়ে নিয়েছিল সবার দৃষ্টি। অপলক নেত্রে দর্শকরা তাদের প্রাণ জুড়িয়েছেন বাংলাদেশকে বারবার দেখে। এই প্রদর্শনী উদ্বোধন করেন সাতক্ষীরা ২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মীর মোস্তাক আহমেদ রবি। শিক্ষাবিদ উপাধ্যক্ষ নিমাই মন্ডল বলেন জলিল ছিলেন একজন অজাতশত্রু। প্রগতিশীল চেতনার ধারক এমএ জলিল সব সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তার শিল্পচর্চায় আমরা মুগ্ধ, আচরণ ছিল বন্ধুসুলভ। বন্ধু হিসাবে দৃষ্টান্ত হতে পারেন এমএ জলিল। তিনি ছিলেন শিল্পী এসএম সুলতানের অনুসারী।
দুষ্টু ছেলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে । ফিরছে না কেনো এই উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়েই কাটছে মায়ের দিন। সে কি আর ফিরবে না কোনোদিন? নাকি সালাম রফিক শফিক বরকতের পথে দামাল সন্তানদের মতো রক্ত দিয়ে গড়ে তুলবে এক একটি শহীদ বেদী? চেয়ে দেখো কালো ধোঁয়ার মতো কুন্ডলী পাকিয়ে কিভাবে বাংলাদেশকে তিল তিল করে গ্রাস করছে দুর্নীতি সন্ত্রাস মাদক আর জঙ্গিবাদ। এখনই এদের পরাভূত করতে না পারলে কেমন বাংলাদেশ হবে তা নিয়ে আতংকিত হয়ে উঠেছে প্রদর্শিত চিত্রকর্ম। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই মিছিল, ৫২-তে মাতৃভাষার জন্য সন্তানদের বাঁধ ভাঙ্গা মিছিল স্লোগান আর তাদের আত্মাহুতিতে জন্ম নেওয়া প্রথম শহীদ মিনার আমাদের চিন্তার জগতকে নিয়ে গেছে বহু গভীরে। উনসত্তুরে সাত কোটি বাঙ্গালির গনঅভ্যুত্থান আর ছাত্র নেতা আসাদের আত্মত্যাগ, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনে বাঙ্গালির নিরংকুশ জয় ইতিহাসের পেছন পাতা অনুশীলনে নিয়ে গেছে দর্শকদের। ৭ মার্চ তর্জনী উচিয়ে বঙ্গবন্ধুর গগন বিদারী ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালির ওপর পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলার নৃশংস চিত্র ধরা পড়েছে শিল্পীর তুলিতে। পাক হানাদার বাহিনীর বাঙালির ওপর হামলা ও গণহত্যা, নির্যাতিত শরণার্থীদের দেশ ত্যাগের করুণ চিত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কালীন স্মৃতির পাতায় নজর কেড়ে নেয়। দেশ মাতৃকার স্বাধিকার অর্জন ,বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে স্বাধীন ভূখন্ড হিসাবে তুলে ধরার অবিরাম সংগ্রামে রাইফেল হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুবিনাশী যুদ্ধ দর্শকদের সংগ্রামী জীবনে নতুন করে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। চিত্রকর্মে ফুটে ওঠে বিজয় দিবসের উল্লাসের চিত্র। সেই সাথে সাথে লাল সবুজের পতাকার অমলিন ছবিও উপহার দিয়েছেন তিনি। শিল্পী এমএ জলিলের ছবিতে রয়েছে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্ভাব্য ক্ষয় ক্ষতির আশংকার দৃশ্য। এ দৃশ্য আমাদের জীবন জীবিকা ভাবনায় নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেছে। ভাবতে শিখিয়েছে পরিবর্তিত জলবায়ুর করাল গ্রাস থেকে কিভাবে নিজেদের রক্ষা করা যাবে তা নিয়ে।
সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম বলেন তিনি ছিলেন, সৎ প্রগতিশীল মানুষ। তার মৃত্যুতে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। নারী নেত্রী সংস্কৃতিকর্মী প্রধান শিক্ষক নাসরিন খান লিপি বলেন, জলিল ভাইয়ের মৃত্যুতে ঈষিকার আড্ডাটা ভেঙে গেল। জমবে কি আর এ আড্ডা? শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সচিব মুশফিকুর রহমান মিল্টন বলেন, আমরা সাতক্ষীরাবাসী তার কাছে ঋণি থেকে গেলাম। দৈনিক প্রথম আলোর স্টাফ রিপোর্টার কল্যাণ ব্যানার্জি বলেন, ৮০ এর দশক থেকে সব রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঈষিকা। এর স্বত্ত্বাধিকারী চিত্রকর জলিল ছিলেন এ সবের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়ক।
এমএ জলিলের চিত্রকলায় আরও উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , যুগশ্রষ্টা কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, মাষ্টারদা সূর্য সেন, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানি, বীর কন্যা প্রীতিলতা সেন, বিপ্লবী ইলা মিত্রসহ মহামনিষীদের প্রতিকৃতি। চিত্রে তিনি উপহার দিয়েছেন লালন ফকির, শাহ আবদুল করিম আর হাসন রাজার মতো মরমী শিল্পীর অবয়ব। শিল্পী এসএম সুলতানকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তুলির আঁচড়ে।
নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, ঈষিকা ও জলিল সমার্থক। আমাদের সব প্রেরণার উৎস। রাজনৈতিক পরিবর্তনে জলিল ও তার ঈষিকা আমাদের মাইলফলক। তার প্রস্থান আমাদের হৃদয়কে ছিন্ন করে দিয়েছে। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, প্রগতিশীল আন্দোলন এবং শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চায় তিনি ছিলেন সহায়ক শক্তি। তার প্রয়াণে গভীর শুন্যতার সৃষ্টি হলো। কবি পল্টু বাসার বলেন, জলিলের মৃত্যু সাতক্ষীরার শিল্প অঙ্গনকে অসহায়ত্বের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তার বন্ধু বাৎসল্য ছিল চমৎকার।
চিত্রকলায় বীরত্বের সাথে স্থান করে নিয়েছে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক স্বৈরাচার নিপাত যাক ’ দৃশ্যও। এমএ জলিল তার ছবিতে বিজয়ানন্দে আমি বাংলার গান গাই দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন। তার চিত্রকলায় আছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন পতাকা কাঁধে নিয়ে বীরের বেশে অস্ত্রসমর্পণ। একক চিত্রে আরও ফুটে উঠেছে ৪৭ পূর্ব ও পরবর্তী ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। আছে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানির কাগমারি সম্মেলনের দৃশ্য, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার আন্দোলন, একাত্তরে বীরাঙ্গনা মা ও বোনেদের ওপর নির্যাতনের চিহ্ণ। আছে বুদ্ধিজীবী হত্যা, বধ্যভূমি, একাত্তরে গণহত্যার শিকার মানবসন্তানের দেহ পচে গলে ওঠার হৃদয়স্পর্শী দৃশ্য। শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে বাঙ্গালির স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রাম ও আত্মশক্তির কাছে ১৬ ডিসেম্বর সামরিক জান্তা এএকে নিয়াজীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পন । দীর্ঘ সংগ্রামে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের পরও বাংলাদেশে স্বৈরাচারি থাবা মোকাবেলায় বাঙ্গালির গনতান্ত্রিক সংগ্রামে ডা. মিলনের আত্মদানের দৃশ্যও তুলে ধরতে ভোলেননি শিল্পী জলিল।
শিল্পী ভুলে যাননি সমাজে নানাভাবে নিবর্তনের শিকার নারীর অনুশোচনার কথা। ভোলেননি একান্তে বসে দুই প্রবীণার পুরনো দিনের স্মৃতিচারণের কথা। ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে তাদের অনুশোচনার দৃশ্য তুলিতে ধারণ করেছেন তিনি। অস্তায়মান সূর্যের লাল আভায় ডানা ভাসিয়ে বিহঙ্গ্রে নীড়ে ফেরার চিরায়ত ছবি আর সেই সাথে কর্ম ক্লান্ত শ্রমজীবীর কুটিরে ফেরার দৃশ্য আমাদের গ্রামবাংলাকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে। ছবিতে রয়েছে এক ঝাঁক উড়ন্ত বলাকার আকাশ পথে ভেসে চলার মুগ্ধকর দৃশ্য। ছবিতে রয়েছে একজন উর্বশীর ভ্রান্ত পথ চলা। রয়েছে মাতৃত্ব আর মাতৃস্নেহের এক স্নিগ্ধ পরশ। জসীমউদ্দিনের পল্লী কবিতার আদলে চিত্রে জাগরিত হয়েছে স্মৃতি ‘তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়’। । আছে বৃক্ষছায়ায় কারও জন্য প্রতীক্ষার দৃশ্য। আল পথে কৃষকের হেঁটে চলা, প্রকৃতির কোলে সবুজের আস্তরণ উপহার দিতে মাঠে কৃষক আর বাড়ির আঙিনায় কিষানীর শস্য মাড়াইয়ের দৃশ্য চাঁদনি রাতে স্ফটিকের মতো ফুটে উঠেছিল দর্শকদের নজরে। লাল সুর্যের আভায় ভেসে চলা নৌকা আর মাঝির মুখে ‘ও নদীরে’ ভাওয়াইয়া বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে আবারও তুলে ধরেছিল। সেই সাথে মধ্যরাতে বাঁশের বাঁশরীর মধুঝরা করুন সুর লহরীতে কেঁদে ওঠে বিরহী নারীর হৃদয় – এ দৃশ্যও উপহার দিয়েছেন তিনি। বাসদ নেতা অ্যাডভোকেট আজাদ হোসেন বেলাল বলেন, তিনি তার চিত্রকলা প্রদর্শনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের চিরচেনা চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি ছিলেন কর্মঠ, পরিশ্রমী,সৎ নিবেদিত প্রাণ। জেলা নাগরিক আন্দোলন মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান মাসুম বলেন, সদা হাস্যোজ্জ্বল জলিল ভাইয়ের মৃত্যুতে সাতক্ষীরার চিত্রকলার অগ্রযাত্রা থমকে গেলো। তার অভাব আমাদের অনুভবে আসতে শুরু করেছে।
সাতক্ষীরায় এমএ জলিলকেই এই প্রথম কোনো একক নান্দনিক চিত্র প্রদর্শনী দৃশ্যে অনুভবে আর অবগাহনে নাগালে পেয়েছেন সাতক্ষীরার মানুষ। তারা হৃদয় দিয়ে হাতড়েছেন স্মৃতি, দুরদৃষ্টি দিয়ে ভেবেছেন ভবিষ্যত, স্মরণে এনেছেন ভাষা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ, অবিরাম বাংলার চিরায়ত দৃশ্য। যা শত শত শিল্পকর্মের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন সাতক্ষীরার শিল্প কর্মে পাইওনীয়র এমএ জলিল।
মঙ্গলবার প্রত্যুষে একটি ফোন কল আমাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছিল বন্ধু বৎসল চিত্রকর এমএ জলিলের শোকস্তব্ধ বাড়ির আঙিনায়। দুপুরে প্রত্যক্ষ করলাম শহিদ আবদুর রাজ্জাক পার্কে তার জানাযায় সহস্র মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতি পথে নজর কেড়ে নিল মিনি মার্কেটে ‘ঈষিকা’র দরজা বন্ধ। তার আড্ডার সাথীরা মলিন চেহারায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন পাশে। তারা জেনেছেন চিত্রকর এমএ জলিল ছেড়ে গেছেন তাদের, কি ভাবে জমবে ঈষিকার সেই আড্ডা।
লেখক: সুভাষ চৌধুরী, সাতক্ষীরা করেসপন্ডেন্ট, এনটিভি ও দৈনিক যুগান্তর।