ভিন্ন স্বাদের খবর: ছোট ছোট পারিবারিক বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল নিহত সগিরা মোর্শেদ ও তার জা সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের মধ্যে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তারা থাকতেন রাজারবাগের ৯৫৫ আউটার সার্কুলার রোডের বাসায়। পারিবারিক কলহের জের ধরে সগিরাকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করেন সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীন। পরিকল্পনায় শরিক হন তার স্বামী ডা. হাসান আলী চৌধুরী। তিনিই তার এক পেশেন্ট মারুফ রেজাকে শায়েস্তা করার কাজটা দেন। আর এই কাজে সহযোগিতার দায়িত্ব দেয়া হয় আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে। সে অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই বিকেলে ভিকারুননেসা স্কুলের সামনে প্রথমে সগিরা মোর্শেদের হাতে থাকা বালা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে মারুফ রেজা। বাধা দেয়ায় সগিরাকে গুলি করা হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় পিবিআই সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।
মামলা সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার দিনই রমনা থানায় মামলা দায়ের করেন নিহতের স্বামী আ. ছালাম চৌধুরী। এই মামলার তদন্ত করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত শেষে ১৯৯০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মিন্টু ওরফে মন্টু নামে একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণের সময়। তাদের জবানবন্দিতে মারুফ রেজার নাম আসায় আদালত অধিকতর তদন্তের আবেদন করলে তা মঞ্জুর হয়। কিন্তু আদালতের এই আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে রিভিশন মামলা করে বিবাদি পক্ষ। এতে আদালত মামলার ওপর ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। পরবর্তীতে ছয় মাস করে সময় বাড়াতে বাড়াতে একসময় মামলাটির বিচারকাজ ফাইলবন্দি হয়ে যায়।
যেভাবে মামলাটি সামনে এলো
তিন দশক ধরে মামলাটি ফাইলবন্দি থাকার পর একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এ সংবাদ প্রকাশিত হলে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়। ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৬ জন কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করার পর চলতি বছরের ১১ জুলাই মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য পিআইবি’র ডিআইজিকে নির্দেশ দেন আদালত। এর আগে, দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকা মামলাটি অনুসন্ধান করে সামনে নিয়ে আসেন সাংবাদিক মাসউদুর রহমান।
তিনি এ বিষয়ে বলেন, আমি এক সোর্সের মাধ্যমে এ মামলাটি দীর্ঘদিন চাপা পড়ে থাকার তথ্য পাই। অনুসন্ধান শেষে সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলা চাপা থাকার ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ হয় জুন মাসে। এরপর আদালতের নজরে আনা হলে আদালত পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
মাসউদুর রহমান বলেন, অনুসন্ধান করার সময় বাদীর মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলি। আমরা সঙ্গে কথা বলার সময়ও তিনি বলেছিলেন, এটার ঘাঁটাঘাঁটি করে আর কী হবে? কিছু পাওয়া যাবে না। যদিও পরবর্তীতে পিআইবি’র তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডে তার সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। এবং ডা. হাসান আলী চৌধুরী সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন।
কার স্বার্থে মামলা স্থগিত খুঁজতে গিয়ে বের হয় থলের বিড়াল:
আদালতের মাধ্যমে তদন্তভার পেয়ে কার স্বার্থে আদালতে মামলাটি বছরের পর বছর ধরে স্থগিত থেকেছে তা আগে খুঁজে বের করেন নতুন তদন্ত কর্মকর্তা। আর এতেই উঠে আসে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কর্মকর্তা আনাস মাহমুদ রেজওয়ানের নাম। তাকে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন তিনি সব অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে পিবিআই তাদের অনুসন্ধানে আনাস মাহমুদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়।
পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, গত ১০ নভেম্বর আনাস মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া স্বীকারোক্তি ও আমাদের অনুসন্ধানে বাকিদের নাম বেরিয়ে আসে। সেখানে বাদীর মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী ও তার স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহীনের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। তাদেরকে ১২ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয়। দুজনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। আরও একজনের নাম পাওয়া যায়, যাকে ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার কন্টাক্ট দিয়েছিলেন আনাস মাহমুদ। তার নাম মারুফ রেজা। ধনাঢ্য এই আবাসন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয় ১৩ নভেম্বর। তিনিও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
হত্যার নেপথ্যের ঘটনা:
তদন্ত কর্মকর্তা ও বাদী আ. ছালাম চৌধুরী জানান, তারা তিন ভাই। বাদী আ. ছালাম চৌধুরী, বড় ভাই সামছুল আলম চৌধুরী ও মেঝ ভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী। বাদী ১৯৮০ সালে শিক্ষকতার জন্য সপরিবারে ইরাকে চলে যান। ইরাক-ইরান যুদ্ধের কারণে ১৯৮৪ সালে বাদী আবার সপরিবারে বাংলাদেশে ফিরে এসে পৈত্রিক ভিটা রাজারবাগ পেট্রোল পাম্পের পাশের দোতলার বাসায় বসবাস শুরু করেন। মেঝভাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী বারডেম হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছেন। তিনি ১৯৮০ সালের ২২ জুন স্ত্রীকে নিয়ে লিবিয়ায় চলে যান। ফিরে আসেন ১৯৮৫ সালে। দেশে ফিরে পৈত্রিক ভিটায় তিনিও বসবাস শুরু করেন। বড় ভাই সামসুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে নিচতলায় কিছুদিন থাকার পর ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার ছোট ভাইয়ের বাসার একটি রুমে সপরিবারে থাকতে শুরু করেন হাসান আলী। এক বাসায় থাকার কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনের সঙ্গে ছালাম চৌধুরীর স্ত্রী সগিরা মোর্শেদের বিভিন্ন ছোট খাট বিষয়ে দ্বন্দ্ব ও ঝগড়া শুরু হয়। এভাবে ৬ মাস থাকার পর ১৯৮৬ সালের এপ্রিল মাসে ওই বাড়ীর তৃতীয় তলার কাজ সম্পন্ন হলে ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার স্ত্রী পুত্রসহ তৃতীয় তলায় ওঠেন। এই সময়ে তৃতীয় তলা হতে ময়লা ফেলা ও বিভিন্ন কারণে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিনের সঙ্গে সগিরা মোর্শেদের দ্বন্দ্ব আরও বাড়ে।
মামলার বাদী আ. ছালাম চৌধুরী জানান, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করত সায়েদাতুল মাহমুদা। আমার স্ত্রীর উচ্চশিক্ষা, স্ত্রীকে আমার মায়ের পছন্দ সব মিলিয়ে আমার মেঝ ভাইয়ের স্ত্রী ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। যে কারণে আমার স্ত্রীকে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে তারা।
ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আমাদের তদন্ত ও আসামিদের স্বীকারোক্তিতে জানা গেছে, ১৯৮৯ সালের প্রথম দিকে ডা. হাসান আলী চৌধুরীর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন বলে যে, সগিরা মোর্শেদকে একটু শায়েস্তা করতে হবে। স্ত্রীর কথায় ডা. হাসান আলী চৌধুরী রাজি হন। আসামি মারুফ রেজা (তৎকালীন সময়ে সিদ্ধেশ্বরী এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসানের ভাগ্নে) অপর আসামি ডা. হাসান আলী চৌধুরীর পেশেন্ট ছিল। সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য ডা. হাসান আলী চৌধুরী আসামি মারুফ রেজার সঙ্গে কথা বলেন। এই কাজের জন্য ডা. হাসান আলী চৌধুরী মারুফ রেজাকে ২৫ হাজার টাকা দেওয়ার কথা দেন।
যেভাবে সগিরা মোর্শেদকে হত্যা
সগিরা মোর্শেদকে শায়েস্তা করার জন্য মারুফ রেজাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এবং এই কাজে সহযোগিতার জন বেছে নেওয়া হয় ডা. হাসান আলী চৌধুরীর শ্যালক আনাস মাহমুদ রেজওয়ানকে। তাকে মারুফ রেজার সহযোগী হিসাবে নিয়োগ করা হয়, যাতে তিনি সগিরা মোর্শেদকে দেখিয়ে দিতে পারেন।
বনজ কুমার মজুমদার বলেন, আনাস মাহমুদ ডা. হাসান আলী চৌধুরীর বাসায় যাতায়াত করতো, যে সুবাদে তিনি সগিরা মোর্শেদকে চিনতেন। পরিকল্পনানুযায়ী ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই ডা. হাসান আলী চৌধুরী তার শ্যালক আনাস মাহমুদকে দুপুর ২টার দিকে ফোন করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসতে বলে এবং জানায়, মারুফ রেজা মোটরসাইকেলে করে মৌচাক মার্কেটের সামনে আসবে। আগে থেকে দেওয়া দায়িত্ব অনুযায়ী মারুফ রেজার সঙ্গে গিয়ে সগিরা মোর্শেদকে দেখিয়ে দিতে বলেন আনাস মাহমুদকে। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটের দিকে আনাস মাহমুদ, মারুফ রেজার মোটরসাইকেলের পেছনে ওঠে মৌচাক মার্কেটের সিদ্ধেশ্বরী কালি মন্দিরের গলি দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী রোডে ঢোকেন। ততক্ষণে সগিরা মোর্শেদ তার মেয়েকে স্কুল থেকে নেওয়ার জন্য রিকশায় করে আসেন। তাকে পেছন থেকে ফলো করে আনাস ও মারুফ রেজা। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একটু আগে মোটরসাইকেল দিয়ে সগিরা মোর্শেদের রিকশার পথরোধ করে মারুফ। সগিরা মোর্শেদের হাত ব্যাগ নিয়ে নেয় এবং হাতের চুড়ি ধরে টানা হ্যাঁচড়া শুরু করে মারুফ। পাশেই দাঁড়ানো আনাস মাহমুদকে চিনে ফেলেন সগিরা মোর্শেদ। এবং বলেন, ‘এই আমি তো তোমাকে চিনি, তুমি এখানে কেন?’ এই কথা বলার পরপরই মারুফ রেজা ব্যাগ ছেড়ে দিয়ে কোমর থেকে পিস্তল বের করে এক রাউন্ড গুলি করে যা সগিরা মোর্শেদের হাতে লাগে। এরপর সে সগিরা মোর্শেদকে আরো এক রাউন্ড গুলি করে যা সগিরা মোর্শেদের বাম বুকে লাগে। এ সময় সগিরা মোর্শেদ রিকশা হতে পড়ে যায়। তখন মারুফ রেজা আরো ২টি ফাঁকা গুলি করে মোটর সাইকেলে করে আনাস মাহমুদকে নিয়ে পালিয়ে যায়।
মামলার বাদী ও নিহত সগিরা মোর্শেদের স্বামী আ. ছালাম চৌধুরী জানান, হত্যার পর বিভিন্নভাবে আমাকে চাপ প্রয়োগ করা হয়। আমার ভাই নানাভাবে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, এই মামলার কিছু হবে না।
তিনি আরও জানান, তখন মামলাটি তদন্ত চলাকালে নামে বেনামে চিঠি আসা শুরু হয়। যার ভাষা ছিল “তোমার তিন মেয়েকে নিয়ে ভাল থাকো, মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না”। এছাড়া টেলিফোনেও মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য হুমকি আসে।
আগামী ৬০ দিনের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল:
আদালত থেকে পিবিআইকে দেওয়া সময় একদফা বাড়ানো হয়েছে। সেসময় প্রায় শেষ। আসামিদের গ্রেফতার ও তারা আদালতে জবানবন্দি দিলেও আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। তিনি বলেন, আরও দুমাস সময় চাওয়া হয়েছে। সে সময়ের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি কয়েক হাত ঘুরে সর্বশেষ ব্যক্তির কাছ থেকে চুরি হয়ে গেছে। মারুফ রেজা অস্ত্রটি এনেছিল মুন্না নামের একজনের কাছ থেকে। যা কাজ শেষে ফেরত দিয়েছিল বলে জানিয়েছে মারুফ।
অস্ত্র সরবরাহ করা মুন্না বন্দুকযুদ্ধে বেশ কিছুদিন আগে মারা গেছে বলে জানান পিআইবি প্রধান বনজ কুমার। তিনি বলেন, আমরা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্রটির সন্ধান করছি। বন্দুকযুদ্ধে মুন্না নিহতের সময় তার কাছে পাওয়া অস্ত্র, এই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসব তথ্য প্রমাণ জোগাড় করে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।