ভিন্নরকম খবর: খুলে দেয়া হল ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই দৃষ্টিনন্দন এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। একই সঙ্গে যাতায়াতের সময় কয়েক ঘণ্টা কমিয়ে রাজধানীর সঙ্গে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সড়ক যোগাযোগে সূচনা হল নতুন যুগের।
বৃহস্পতিবার (১২ মার্চ) সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ঢাকা থেকে খুলনা (এন-৮) মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী-মাওয়া এবং পাঁচ্চর-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেয়া হয় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে।
পাশাপাশি তৃতীয় কর্ণফুলী সেতু নির্মাণ (সংশোধিত) প্রকল্পের আওতায় ৬ লেনবিশিষ্ট ৮ কিলোমিটার কর্ণফুলী (শাহ আমানত শাহ সেতু) সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়ক এবং ওয়েস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের আওতায় খুলনা, বরিশাল ও গোপালগঞ্জ সড়ক জোনে নির্মিত ২৫টি সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্বমানের মহাসড়ক হিসেবে ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর যান চলাচল শুরু হয়। এরই মধ্যে এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ সুবিধা পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা। এত দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছে অবাক হয়েছেন যাত্রীরা। সেই সঙ্গে তারা বলছেন; পদ্মা সেতু চালু হলে সকালে ঢাকায় এসে বিকেলে বাড়ি ফিরবেন।
জানা যায়, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ভাঙ্গা যেতে সড়কযানে সময় লাগবে মাত্র ৪৫ মিনিট। তবে এখন ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে সড়কযানে মাওয়া যেতে সময় লাগছে মাত্র ৩০ মিনিট। এই মহাসড়ক ব্যবহারের আগে যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া যেতে লাগত গড়ে দুই ঘণ্টা।
পদ্মা সেতুর সর্বোচ্চ সুবিধা যাতে পাওয়া যায় সেজন্য আধুনিক মহাসড়কের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা রেখে তৈরি করা হয় দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। যান চলাচল নিশ্চিত করার জন্য দুটি সার্ভিস লেন, পাঁচটি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস, দুটি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি রেলওয়ে ওভারব্রিজ, চারটি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু ও ৫৪টি কালভার্ট থাকা ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণ করা হয়।
এক্সপ্রেসওয়েটি এশিয়ান হাইওয়ে করিডর-১-এর অংশ। ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দূরত্ব ৫৫ কিলোমিটার। এটি চালু হলে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা যেতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট। বর্তমানে ঢাকা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার যেতে সময় লাগছে ৩০ মিনিট। অবশ্য এখনই ঢাকা থেকে সরাসরি ভাঙ্গা যাওয়া যাচ্ছে না। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই সুফল পাওয়া যাবে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২২ জেলার মানুষ সরাসরি এক্সপ্রেসওয়ে থেকে উপকৃত হবেন। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু হয়ে যাওয়ার পর এক্সপ্রেসওয়েটির পুরো সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। তখন এক্সপ্রেসওয়ের দুই অংশ যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার ও পাঁচ্চর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার যুক্ত হয়ে যাবে।
এদিকে পদ্মা সেতুর কাজ প্রায় শেষপর্যায়ে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগেই খুলে দেয়া হয় এক্সপ্রেসওয়ে। বর্তমানে এই সড়ক পাড়ি দিতে সময় লাগে দুই ঘণ্টা। পদ্মা সেতু খুলে দেয়ার পর ৫৫ কিলোমিটার যেতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট।
বৃহস্পতিবার ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে এসে রুবাইয়াত হোসেন মুন্না নামে এক যাত্রী বলেন, সড়ক নয় যেন আকাশপথে বিমানে ভ্রমণ করলাম। গাড়িতে উঠার ২০ মিনিটের মধ্যে ফেরিঘাটে চলে এলাম। সড়ক এতই মসৃণ যে; একটুও কাঁপেনি বাস। সড়কে নেই কোনো ধুলাবালু। দেখে বিদেশের সড়ক মনে হয়। কোথাও কোনো স্টপেজ নেই। সড়কপথে এর চেয়ে আরামদায়ক যাতায়াত ভাবাই যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সাধুবাদ।
ঢাকা থেকে বরিশালগামী যাত্রী সজিব হোসেনের ভাষ্য, এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের পরপরই বাসে ঢাকা থেকে মাওয়ায় আসলাম। অবিশ্বাস্য, সত্যি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। মাত্র ৩০ মিনিটে ঢাকা থেকে মাওয়ায় চলে এলো বাস। আগে যেখানে গড়ে দুই ঘণ্টা সময় লাগত; সেখানে লাগছে ৩০ মিনিট। এক ঘণ্টা বেঁচে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিবাদন।
মোশাররফ মুন্সী বলেন, ভাঙ্গা থেকে মাত্র ২০ মিনিটে শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে আসল আমাদের বাস। এত সুন্দর সড়ক জীবনেও দেখিনি। সড়কে কোনো স্টপেজ নেই, কোনো থামাথামি নেই। এক টানে ফেরিঘাটে চলে যায় সব বাস।
ভাঙ্গা-শিবচর রুটের বাসচালক হোসেন সরদার বলেন, সড়কটি আসলেই পৃথিবীর অন্যতম সড়কের একটি। ভাঙ্গা থেকে বাস ছেড়ে আসলাম; কোথাও গতি কমাতে হয়নি। এমনকি চৌরাস্তা বাজারেও গাড়ির গতি কমাতে হয়নি। কারণ বাজার কিংবা চৌরাস্তাগুলো আন্ডার পাসের মাধ্যমে মহাসড়কের নিচ দিয়ে চলে গেছে। লোকাল চলাচলের জন্য পৃথক সড়ক রয়েছে। এ ধরনের সড়ক দেশের সব অঞ্চলে করা হলে সময় বাঁচার পাশাপাশি কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না।
কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ফল বিক্রেতা সাইদুল ব্যাপারী বলেন, সড়কে শান্তির বাতাস। পদ্মা সেতু খুলে দিলে আর কোনো চিন্তা নেই আমাদের। সকালে ঢাকায় গিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরবে মাদারীপুর-ফরিদপুরের মানুষ।
সরেজমিনে এক্সপ্রেসওয়ে ঘুরে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন এবং আধুনিক ট্রাফিক ডিজাইন সমন্বিত এক্সপ্রেসওয়ে উন্নত বিশ্বের সড়কের সঙ্গে সমন্বয় করে নির্মিত। সার্ভিস লেনের দু’পাশে সবুজায়নের জন্য বনায়ন করা হয়েছে। যা ইউরোপ-আমেরিকার সড়কের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এটি প্রথম অ্যাক্সেস কন্ট্রোল্ড ননস্টপ এক্সপ্রেসওয়ে। এ এক্সপ্রেসওয়েতে কোনো ট্রাফিক ক্রসিং নেই। যানবাহনগুলো চলবে বিরতিহীনভাবে। আমার খুব ইচ্ছা ছিল নিজে গিয়ে উদ্বোধন করার। কিন্তু পারলাম না। আজকে এখান থেকে এক্সপ্রেসওয়েটিসহ অনেকগুলো উন্নয়ন কাজ আমরা উদ্বোধন করেছি। তবে খুব শিগগির যাব। এক মাসের মধ্যেই হয়তো যেতে পারি। এখন থেকে খুব দ্রুত টুঙ্গিপাড়া যেতে পারব।
এক্সপ্রেসওয়েটি দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগে আমূল পরিবর্তন এনেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ সবসময় অবহেলিত ছিল। দীর্ঘ ভোগান্তি নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে হতো। এই সড়ক দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ এখন দ্রুত ও সহজে যাতায়াত করতে পারবে।