শিক্ষা ডেস্ক : দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে অনুসরণীয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা (ভিসি) সম্মানীয় ও আদর্শ ব্যক্তি হলেও সম্প্রতি তাঁদের অনেকেই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়নকাজ এবং শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বেশি হয়, সেখানে অনিয়মও বেশি হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে একাধিক ভিসির ব্যাপারে অনিয়ম প্রমাণের পর সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ফাইলবন্দি হয়েই পড়ে থাকে।
ইউজিসি সূত্র জানায়, দেশের ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬টির শিক্ষা কার্যক্রম চলমান। এর মধ্যে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে ১০ উপাচার্যের অনিয়মের অভিযোগে তদন্ত চলছে। সম্প্রতি তিনজন ভিসির ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় অনিয়ম সংক্রান্ত। এ ছাড়া কারো বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপরাধের অভিযোগও আছে। সাময়িকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন করে কম যোগ্যতাসম্পন্ন পছন্দের ব্যক্তিকে নিয়োগের পর আবার আগের জায়গায় বিধিমালা ফিরিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছেন উপাচার্যরা।
বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি এবং বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসির ব্যাপারে তদন্ত চলছে।
সম্প্রতি তিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়েছে। সেগুলো হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক মুহাম্মদ আহসান উল্লাহ এবং রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ। তবে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসির বিরুদ্ধে দুটি তদন্ত চলছে। এর মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, আরেকটি তদন্ত চলমান।
ইউজিসির সচিব ড. ফেরদৌস জামান বলেন, ‘কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে অভিযোগ আসলে আমরা তদন্ত করি। এরপর তা সুপারিশসহ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়। তবে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকারের।’
দীর্ঘ তদন্ত ও গণশুনানি শেষে গত অক্টোবরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের নানা অনিয়মের ব্যাপারে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি। কিন্তু চার মাস পেরিয়ে গেলেও সেই প্রতিবেদনের আলোকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে।
জানা যায়, তদন্তে উপাচার্যের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ আত্মসাৎ, স্বজনপ্রীতি, টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগসহ বিভিন্ন অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড উপাচার্যের মতো সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল পদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এ কারণে উপাচার্যের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে কমিটি। তারা বলেছে, উপাচার্যের নৈতিকতাবিবর্জিত এ ধরনের কর্মকাণ্ড জরুরি ভিত্তিতে বন্ধে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যাতে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও গবেষণার সার্বিক পরিবেশের উন্নয়ন সাধিত হয়।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা নিয়োগ পেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমানোর অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এই প্রক্রিয়ায় যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে ইউজিসির তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
গত ২৫ ফেব্রুয়ারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ইউজিসি। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি অবকাঠামো নির্মাণে যে অবহেলা, দীর্ঘসূত্রতা ও অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা বর্তমান প্রশাসনের অনৈতিকতা, অদক্ষতা ও ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বহিঃপ্রকাশ। প্রথমে নিয়োগকৃত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা না করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়, যা সরকারি ক্রয় পদ্ধতি বহির্ভূত বলে কমিটি মনে করে। নকশা পরিবর্তন করায় নির্মাণাধীন ভবনে এক ধরনের ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ সৃষ্টির পথে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রকল্পের পরিচালক পদে দায়িত্বে থাকায় উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর এই দায়দায়িত্ব অবশ্যই বহন করা উচিত। তবে এ ব্যাপারে নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহকে গত রাতে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি ধরেননি।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ আহসান উল্লাহর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, উপাচার্যদের বড় ধরনের অনিয়ম বা দুর্নীতি প্রমাণিত হলেও কখনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়নি। কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ এলে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে তাঁকে অপসারণের সুপারিশ করা হয়। তবে বেশির ভাগ সময়ই ইউজিসির সুপারিশ আমলে নেয় না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ফলে ভিসিরা বহাল তবিয়তেই থেকে যান। অনেক সময় অভিযোগ এলে তদন্তও হয় না। ভিসিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে গিয়ে ইউজিসির কমিটিও বেশির ভাগ সময়ই বিব্রত হয়।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘উপাচার্যদের ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপিত হওয়াটাই দুঃখজনক; আর তদন্ত তো দূরের কথা। উপাচার্যের আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, পড়ালেখা, গাম্ভীর্য, সততার প্রতি সব সময়ই মানুষের নজর থাকে। তাঁদের অর্থের প্রতি কোনো মোহই থাকা উচিত নয়। তবে সমাজে মূল্যবোধের অভাব যদি সংক্রমিত হয়, তাহলে তা উপাচার্যের চেয়ারও আক্রান্ত করতে পারে। তবে উপাচার্যরা রোল মডেল হিসেবে থাকবেন, এটাই আমার প্রত্যাশা।’সূত্র: কালের কণ্ঠ