বিশেষ ডেস্ক : দেড় বছর ধরে এক অদৃশ্য শত্রু দুনিয়াকে কাবু করে রেখেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে প্রায় ৪২ লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশেও এ পর্যন্ত ২০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। সারা দুনিয়ায় শনাক্তও হয়েছে সাড়ে ১৯ কোটি মানুষ। এর থেকে মুক্তির জন্য গবেষকরা রাত-দিন গবেষণা করে তৈরি করেছেন নানা ভ্যাকসিন। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে মানুষ প্রতিদিন নিচ্ছেন টিকা। উন্নত পৃথিবী এর কিছুটা সুুফলও পেয়েছে। বাংলাদেশেও টিকাদান কর্মসূচি চলছে।
তবে দুই ডোজ টিকা নিয়েও এই অদৃশ্য শত্রু থেকে রক্ষা মিলছে না অনেকের। গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরও করোনা টিকার দুই ডোজই নিয়েছিলেন। করোনায় মারা গেছেন এই কণ্ঠযোদ্ধা। করোনার দুই ডোজ টিকা নেয়ার পর আক্রান্ত হয়ে ষাট বছর বয়সী আনোয়ারা বেগমের মৃত্যু হয়েছে। দুই ডোজ টিকা নেয়ার পরও কেন সংক্রমণ এবং মৃত্যু তা বের করতে স্বাস্থ্য বিভাগকে গবেষণা পরিচালনার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জাতীয় পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, প্রথমে দেখতে হবে উনি দুই ডোজ টিকা কোন কোম্পানির নিয়েছেন। ভ্যাকসিন নেয়ার পর অনেক বিষয় রয়েছে। যেমন ভ্যাকসিন নেয়ার পর তার শরীরে কি পরিমাণে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, তা জানা হয়েছে কিনা। ভ্যাকসিন কার্যকর হলো কিনা।
তিনি বলেন, যিনি মারা গেছেন তার শরীরে হয়তো অ্যান্টিবডি গ্রো হয়নি। এ ছাড়াও তিনি আগে থেকে কোনো জটিল রোগে ভুগছিলেন কিনা। এগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা করা প্রয়োজন। এজন্য ভালো পরিকল্পনা দরকার। খ্যাতিমান এই ভাইরোলজিস্ট বলেন, দেশে গবেষণার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তাই আমাদেরকে এই দিকে গভীর নজর দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, সংশ্লিষ্ট টিকা কোম্পানিগুলো তাদের বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। তাতে লেখা থাকে টিকা নেয়ার পর সংক্রমণ হবে না এমন বলা যাবে না।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং সংস্থাটির উপদেষ্টা ডা. মুস্তাক হোসেন এ বিষয়ে বলেন, দুই ডোজ টিকা নেয়ার পর মৃত্যুর বিষয়টি স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্ত করে বের করা উচিত। কি কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। টিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত কিনা। যিনি মারা গেছেন তার শরীরে আগ থেকে কোনো জটিল রোগ ছিল কিনা।
তিনি আরও জানান, টিকা নেয়ার পর প্রতি ১০ লাখে ১ জন মারা যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ছাড়া অন্যদেশের এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে মিল আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখতে হবে বলে এই জনস্বাস্থ্যবিদ মনে করেন।
এদিকে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা অঙ্গরাজ্যে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন টিকা নেওয়া ১৫ অতিথি। চার জুলাই দেশটির স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন হাজার হাজার মানুষ। সেসব লোকজমায়েত থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ডজনখানেক বড় শহরে। করোনা ছড়িয়েছে সম্পূর্ণরূপে টিকা নেওয়া অনেকের মাধ্যমেও।
ডেল্টা ধরনের দাপট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকা নেওয়া লোকেরাও সংক্রমিত হচ্ছেন করোনায়। সে তালিকায় আছেন টেক্সাসের অন্তত ছয়জন ডেমোক্রেট, হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা এবং স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির এক সহকারী। বিধিনিষেধের অভাবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব রাজ্যেই বাড়ছে করোনা সংক্রমণ। নতুন সংক্রমিতদের প্রায় সবাইকেই হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশনে’র (টিকা নেওয়ার পরও করোনায় আক্রান্ত হওয়া) সংখ্যা এখনও তুলনামূলকভাবে একেবারেই কম। আর টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা করোনায় আক্রান্ত হলেও তাদের খুব কম সংখ্যকই গুরুতর অসুস্থ হন। ‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশনে’ মৃত্যুর ঘটনা এবং হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও একেবারেই নগণ্য। করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া মানুষগুলোর ৯৭ শতাংশই টিকা নেননি।
‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশন’ হওয়ার মানে এই নয় যে, টিকা অকার্যকর। তবু টিকা নেওয়া ব্যক্তিরাও সংক্রমিত হতে পারেন। তাদের ক্ষেত্রে কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না, কিংবা খুব হালকা উপসর্গ দেখা দেয়। এর ফলে টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা নিজেদের অজান্তেই অন্যদের মাঝে ভাইরাস ছড়াতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে করোনার বিস্তার ফের বাড়তে থাকায় টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের বদ্ধ জায়গায় এবং শপিং মল বা কনসার্ট হলের মতো জনবহুল স্থানে মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছেন কয়েকজন বিজ্ঞানী। অবশ্য দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সংস্থা- সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) কেবল টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদেরই মাস্ক পরার পরামর্শ দিয়েছে।
তবে ডেল্টা ধরনের প্রকোপ বাড়তে থাকায় ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকটি অঞ্চলের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ফের আবদ্ধ জায়গায় মাস্ক পরার বাধ্য-বাধকতা জারি করার অনুরোধ করেছেন।
করোনার আগের ধরনগুলোর সঙ্গে ডেল্টা ধরনের পার্থক্যের কারণেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ডেল্টার বিস্তারের পদ্ধতিতে অবশ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। এটি নিশ্বাসের সঙ্গে, বিশেষ করে বদ্ধ জায়গায় বেশি ছড়ায়। তবে এ ধরনটিকে মূল ভাইরাসের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ সংক্রামক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে মনে করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, গবেষণায় দেখা গেছে ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা করোনার প্রথম ধরনের চেয়ে হাজারগুণ বেশি ভাইরাস বহন করেন। তার মানে এই নয় যে, এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর মানে সম্ভবত এই যে, ডেল্টা ধরনের সংক্রমণক্ষমতা অনেক বেশি এবং দীর্ঘস্থায়ী।
ভাইরাসের সংখ্যাও গুরুত্বপূর্ণ। টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা খুব অল্প সংখ্যক ভাইরাসের সংস্পর্শে এলে বেশিরভাগ সময়ই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার টিকা নেওয়া ব্যক্তি বেশি সংখ্যক ডেল্টা ধরনের সংস্পর্শে এলে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অকার্যকর হয়ে যেতে পারে।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বা সামাজিক সংক্রমণের হার বেড়ে গেলে সমস্যা আরও তীব্র হবে। কারণ ভাইরাস তখন সংখ্যায় ও শক্তিতে আরও বাড়বে।
এদিকে টিকা না নেওয়া ব্যক্তিদের সিংহভাগই যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। ফলে সবাই-ই মারাত্মক ঝুঁকিতে আছেন। টিকাকে তুলনা করা যায় বড় আকারের ছাতার সঙ্গে। এর নিচে দাঁড়ালে আমরা তুমুল বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাব। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের মুখে এই ছাতার নিচে দাঁড়ালেও ভিজে যাব। করোনার ডেল্টা ধরন ঘূর্ণিঝড়ের পরিস্থিতিই সৃষ্টি করছে।
টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা সাধারণত করোনায় আক্রান্ত হন না। হলেও তার উপসর্গ বলতে গেলে দেখাই দেয় না। তবে খুব অল্প সংখ্যক টিকা নেওয়া মানুষ সংক্রমিত হলে তাদের মধ্যে ‘লং কোভিড’ দেখা দিতে পারে।
অনুমান করা হচ্ছে, কোভিডের সব টিকাই ডেল্টা ধরনের বিরুদ্ধে কমবেশি কার্যকর। সত্যি বলতে কী, গবেষণায় দেখা গেছে দক্ষিণ আফ্রিকায় আবিষ্কৃত বেটা ধরনের চেয়ে ডেল্টা তুলনামূলক কম ভয়ংকর।
একজন টিকা নেওয়া ব্যক্তি করোনায় সংক্রমিত হতে পারেন কিনা- তা নির্ভর করে টিকা নেওয়ার পর তার শরীরে কত দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে, সে অ্যান্টিবডি করোনার বিরুদ্ধে কতটা কার্যকর এবং টিকা নেওয়ার পর ওই ব্যক্তির রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমাণ কমে গেছে কি না—এসবের ওপর।
ডেল্টা ধরনের মাধ্যমে ‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশন’ বেশি হয় কি না, তার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রমাণ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে আমেরিকায় প্রায় ৫,৫০০ টিকা নেওয়া মানুষের করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির খবর পাওয়া গেছে।
ধারণা করা হচ্ছে, আলফার চেয়ে ডেল্টা ধরনের মাধ্যমেই ‘ব্রেকথ্রু ইনফেকশন’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অবশ্য টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা আক্রান্ত হলেও খুব দ্রুত (দুই সপ্তাহের কমে) সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তবে টিকা নেওয়া ব্যক্তিরা করোনার ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত হলে তারা প্রথম ৭ থেকে ১০ দিন আলফা ধরনের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যক ভাইরাস বহন করেন।
বেইলর কলেজ অফ মেডিসিনের জিনেটিসিস্ট ক্রিস্টেন প্যান্থাগানি বলেছেন, টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের সংক্রমিত হওয়া ঠেকাতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। সাধারণ মানুষকে বোঝাতে হবে, টিকার কাজ মানুষকে গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করা। সেই কাজ টিকা খুব ভালোভাবেই করছে।
তিনি বলেন, ‘কোনো টিকাই একশোভাগ কার্যকর নয়—এটা কখনও সম্ভবও নয়। কোভিড টিকা নিখুঁত হবে—এমন আশা করাও উচিত নয় আমাদের।’
গুরুতর অসুস্থতা ও মৃত্যু ঠেকানোর জন্য করোনার টিকা কার্যকর। কিন্তু ভয়ংকর এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অভেদ্য নিরাপত্তাব্যূহ হিসেবে দাঁড়ানোর সামর্থ্য এখনও অর্জন করেনি এসব টিকা।