নীরবে-নিভৃতে চলে গেলেন বিশ্বনাথ বোস, আমাদের বিশু বাবু। ২৫ জানুয়ারির জোছনালোকিত শীত-রাতে পশ্চিমবাংলার হাবড়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
বিশ্বনাথ বোসের রাজনীতির ফুল ফুটেছিল সাতক্ষীরা জেলার তালা থানায়, কিন্তু তার ঘ্রাণটি ছিল বিশ্বনেতাদের মতো দূর-প্রসারী। মাগুরা ইউনিয়নের চারবারের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। এই যে “দূর-প্রসারী” বললাম এই কারণে যে, স্থানীয় নেতা হয়েও তাঁর বুদ্ধি, মেধা, ব্যক্তিত্ব ও কর্মতৎপরতা একজন জাতীয় নেতার মর্মশক্তির সমান্তরাল। বিশু বাবুর জীবনী অনুধাবন করলে তা স্পষ্ট হবে।
পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তোর, বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির ঘটনাপ্রবাহ অনেকটা অন্ধকারে ছিল। সেই অনিশ্চয়তার দিন এবং চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের রেশ―দুই কারণে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো তালাবাসীর জীবনেও কর্মহীনতা ও খাদ্যঘাটতির বিপদ নেমে আসে; অন্যদিকে চীন ও মস্কোপন্থীদের ক্ষীণ হয়ে আসা স্রোতটির অধিকার-অভিমানী উচ্শৃঙ্খলতা, সবমিলে― সমাজে তৈরি করতে থাকে সর্বহারাসহ নানান বিরক্তিকর সংগঠন। বিশ্বনাথ বোস তখন বেলেদহ স্কুলের তরুণ শিক্ষক। শিক্ষকের আদর্শ-পরিচয় এবং স্বর-শক্তি দিয়ে তিনি কর্মসৃজনের আহবান নিয়ে তরুণদের সংগঠিত করলেন। এ কাজ হয়েছে আপন মহিমায়, তাঁর ব্যক্তি গুণে। ঠিক এই সময়ে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর ক্ষমতাকে রাজনীতিসিদ্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। বিশ্বনাথ বাবুর মতো নেতা তাঁর দরকার। তাই শত আহবান এল জিয়াউর রহমানের তরফ থেকে। এখানে একটা কথা বলা দরকার, পরিবর্তনবাদী বামদের মতো তিনিও আদর্শকে থলের ভেতরে রাখতে চাননি, চেয়েছেন সমন্বয় ঘটাতে। এই সমন্বয় জনমানুষের জন্য। নিরুদ্দেশ রাজনীতির আবহে দুর্বল মানুষগুলোর অধিকার ছিনিয়ে আনা বড় দরকার। তাই সাড়া দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের ডাকে। সে যদি ভুল হয়, তবে তা-ই ফুল হয়ে ফুটেছিল কপোতাক্ষ পাড়ের ওই জনপদে। খালকাটা কর্মসূচি থেকে স্বনির্ভর আন্দোলন―সবখানে তিনি দৃষ্টান্ত কাড়লেন। মাগুরা হয়ে উঠল ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ এক জনপদ, সেখানে বিদ্যুৎ এল, রাস্তা-ঘাট, বাজার হল। এ সবের মূল ছিল কৃষিতে কর্ম-সৃজন। বিশু বাবু হয়ে উঠলেন জনদরদী নেতা, সারাদেশে নাম ছড়ালেন। পুরস্কার স্বরূপ জিয়াউর রহমান নিয়ে গেলেন চীন দেশে। ফিরে এসে হয়ে উঠলেন সাতক্ষীরার রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তারেরও নজরে ছিলেন তিনি। দেশ গড়ায় অনন্য অবদানের জন্য প্রেসিডেন্ট সাত্তার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যানের খেতাব। সেই ছবি দীর্ঘদিন পর্যন্ত ছিল আমাদের বাড়িতে।
আদর্শের মূল থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। এক সেনাশাসকের হাত থেকে আরেক সেনাশাসকের হাতে যখন দেশ, তখন তাঁর দিকেও হাত বাড়ানো হয়েছিল। তিনি ধরা দেন নাই। কারণ, জন-আকাঙ্খাকে তিনি উপেক্ষা করেন নাই। এর ভোগান্তিও কম ছিল না। সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন। এর মধ্যে আলতাফ বাহিনীর হাতে নির্যাতন উল্লেখযোগ্য।
… ১৯৮৮ সাল। প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় জনসভা করলেন। এরশাদের হেলিকপ্টার যখন সাতক্ষীরার আকাশ থেকে অন্তর্হিত হল, ঠিক তখনই বঙ্গভূমি আন্দোলনের অপবাদে বিশ্বনাথ বোসকে জেলে নেওয়া হল। কিন্তু এলাকার জনমানুষকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর সহধর্মিনী স্বপ্না বোসের প্রতিবাদের মুখে অল্প কিছুদিনের মধ্যে তিনি কারা মুক্ত হন। এরশাদের পতন ও বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক-বদল―এই সময়ে নিজেকে রাজনীতির বাইরে রেখে নিয়োজিত থাকলেন জনসেবায়। বহুমানুষের কর্ম সংস্থানে তাঁর ভূমিকা উল্লেখ করবার মতো।
বিশ্বনাথ বোসের ব্যক্তিজীবন ও একটি স্মৃতি :
ব্যক্তিজীবনে তিনি চার সন্তানের জনক। তীব্র স্নেহবৎসল ছিলেন তিনি। করণীয় সম্পর্কে তিনি ছিলেন দারুণ প্রজ্ঞাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা বলতেই হবে।…আমার তখন সাত বছর বয়েস। গাঁ-গ্রামে আমাদের বাড়ি। আমার কী যে একটা রোগ হল, গ্রামের ডাক্তাররা কিছুতেই কিছু করতে পারছে না। একদিন গলা বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, দম আটকে এল। বিশ্বনাথ বোস তখন আমাদের বাড়িতে। ডাক্তার বুঝতে পারল না, কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝলেন। কাল বিলম্ব না করে তাঁর ইয়ামাহা ব্রান্ডের মোটরসাইকেলে চেপে পয়ত্রিশ মিনিটে ৪২ কিমি পথ পাড়ি দিয়ে সাতক্ষীরায় আনলেন। তখন রাস্তাঘাট খুবই খারাপ ছিল। ডাক্তার ছিদ্দিক সাহেব দেখে বললেন―ডিপথেরিয়া, আর দশ মিনিট দেরি হলে বাঁচানো যেত না।
আজ মনে পড়ে সেদিন তিনি আমাদের বাড়িতে ঈশ্বরের দূত হিসেবে ছিলেন। সেই দুতিয়ালি আজ তিনি কার কাছে দিয়ে গেলেন জানিনা, তবে তাঁর অন্তর্ধানে নিজেকে বড় নিঃস্ব লাগছে।
লেখক: বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী, কথা সাহিত্যিক