নৌকা ও ধানের শীষে ভর করেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যেতে চায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুই জোটের শরিক দলগুলো। এর আগেও ছোট দলগুলোর মধ্যে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচনে গেলে তাদের জামানত হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। দলের নিবন্ধন ঝুঁকিও বাড়তে পারে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতীক নিয়ে ভোটে অংশ নিলে ভোট পাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে বেশি। সবকিছু বিবেচনায় প্রধান দুই দলের হাইকমান্ডের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিজ দলের প্রতীক বিসর্জন দিয়ে অন্যের কাঁধে ভর করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন খণ্ড-বিখণ্ড দলের নেতারা। আগামী নির্বাচনেও ‘নাম ও প্যাড সর্বস্ব’ দলগুলো সেই প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। সংশ্লিষ্ট দলের একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে এ তথ্য জানা গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এমন বিধি করা উচিত, কোনো নিবন্ধিত দল নিজ দল থেকে ভোটে অংশ না নিয়ে অন্যের কাঁধে ভর করে অংশ নিলে ওই দলের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। বিশেষ করে কোনো দলের যিনি সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হবেন—তাদের ক্ষেত্রে এটা ছাড় দেওয়া উচিত নয়। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলো প্রধান দুই দলও নিজেদের বৃহৎ স্বার্থে ছোট দলগুলোর হাতে নিজের প্রতীক তুলে দেয়। ’
এ প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘কেউ যদি স্বেচ্ছায় নিজের প্রতীক দিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন কি করতে পারে? সেটা ওই দলকেই দায়িত্ব নিতে হবে। নির্বাচনী বিধিতে রয়েছে, একটি দল পরপর দুবার নির্বাচন না করলে তার নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ছোট ছোট দলগুলো নৌকা-ধানের শীষের প্রতীকে দুই চারজনকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিবন্ধন রক্ষা করে। তারা একভাগও ভোট পায় না। এর আগে একটা বিধি ছিল, কেউ তিন বছর একটি দলে না থাকলে তাকে ওই দলের প্রতীক দেওয়া যাবে না। সেটা উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ‘আমাদের দেশের বাস্তবতায় প্রধান দুই দলেরই সারা দেশে জনসমর্থনে এগিয়ে আছে। অন্য যেসব রাজনৈতিক দল আছে তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সমর্থন নেই। নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করলে বিজয়ী নয়, জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার জোর সম্ভাবনাও বেশি। সে কারণে তারা জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে। জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে তারা আসন পায় ও ক্ষমতার অংশীদার হয়। না হলে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। ’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, ‘ছোট ছোট দলগুলো জানে, নিজের দল থেকে তারা জিতবে না। এমনকি তথাকথিত বামদলগুলোর নেতারাও জানেন, তাদের কোনো অবস্থাতেই নিজ দলের স্বকীয়তায় নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা নেই। বর্তমান মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্যেরও একই অবস্থা। তাদের মধ্যে কারও কারও অতীতে এমনও হয়েছে যে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। তাদের নিজস্ব কোনো শক্তি নেই। তাই তারা নৌকা বা ধানের শীষে সওয়ার হয়। তবে এটা নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন দেওয়া উচিত নয়। এমন আইন করা উচিত, যদি কেউ নিজ দলের প্রতীক বাদ দিয়ে অন্য দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নেয়, তাদের নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। বিশেষ করে যারা সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হবেন তাদের ক্ষেত্রে এটা করা উচিত। ’
জানা যায়, দুটি জোটের শরিকদেরই কর্মী ও সমর্থকের অভাব রয়েছে। তার ওপর রয়েছে জনসমর্থন ও ভোটার সংকট। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধিত হওয়া সত্ত্বেও এসব দলের আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নির্বাচনী প্রতীকই ভরসা। তবে তারা দুর্বল হলেও এরাই নির্বাচনী আসন নিয়ে দর কষাকষিতে ব্যস্ত এখন। কোনো কোনো নামসর্বস্ব দল দাবি করছে, জোটের কাছে তারা ১০০ আসন চাইবেন।
আবার কেউ ১০টি থেকে শুরু করে ৫০টি আসন পর্যন্ত নিয়ে দর কষাকষি করার চিন্তাভাবনা করছেন। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ৪০টি আসন ছাড় দিলেও এবার তাদেরকেই ১০০টি ছেড়ে দেওয়ার চাপ আসছে। তবে ২০০৮ সালে জামায়াত বাদে বিএনপি জোটের অন্য দলগুলো ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করে। অন্যদিকে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জোটের শরিকদের জন্য ৩৫টি আসনে ছাড় দেয়। শুধু জাতীয় পার্টি ছাড়া জাসদ ও ওয়ার্কার্স পাটির্র শীর্ষ নেতারাসহ অন্য সবাই নৌকা মার্কায় নির্বাচন করেন।
এর মধ্যে সর্বশেষ দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোটে শরিকদের মধ্যে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে জয়ীরা হলেন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন (ঢাকা-৮), সাধারণ সম্পাদক ফজলে হাসান বাদশা (রাজশাহী-২), শেখ হাফিজুর রহমান (নড়াইল-২), মোস্তফা লুত্ফুল্লাহ (সাতক্ষীরা-১), জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু (কুষ্টিয়া-২), জায়েদুল কবির (নরসিংদী-২), শিরিন আখতার (ফেনী-১), মঈনউদ্দিন খান বাদল (চট্টগ্রাম-৮) এবং বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী (চট্টগ্রাম-২) ও এম এ আউয়াল (লক্ষ্মীপুর-২)। ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট।
তবে একাদশ নির্বাচনে জোটের শরিক দলগুলো ধানের শীষে ভর করেই নির্বাচনে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দলগুলোর মধ্যে রয়েছে, জামায়াতে ইসলামী, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি—এলডিপি, ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ, জাতীয় পার্টি (জাফর), খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি—বিজেপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক দল—জাগপা, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি—এনপিপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি—এনডিপি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, ন্যাপ-ভাসানী, বাংলাদেশ ন্যাপ, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ, ডেমোক্রেটিক লীগ, সাম্যবাদী দল। এ দলগুলোর মধ্যে জামায়াত বা এলডিপি বাদে সবাই ধানের শীষে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন