নিজস্ব প্রতিবেদক : তিনি ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। প্রাণিবিদ্যা বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। চলতি বছর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এখনো তিনি থাকছেন ফজলুল হক হলে!
তাঁর নাম মাসুদ রানা। তিনি বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! ওই হলের একাধিক শিক্ষার্থী ও দায়িত্বরত একাধিক কর্মচারী নিশ্চিত করেছেন যে মাসুদ রানা এখনো ওই হলেই থাকেন।
চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন মাসুদ রানা। যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে না থেকে তিনি থাকেন ঢাবির এই আবাসিক হলে।
হলের প্রধান ভবনের ৩৩৩ নম্বর রুমের শয্যা দখলে আছে মাসুদের। সেখানে টেবিলের উপরে মাসুদের নাম ও শিক্ষাবর্ষের সাল উল্লেখ করা আছে। বেডের মাথার কাছে আছে তাঁর স্বাক্ষর ও তারিখ। সেখানে চলতি বছরের মার্চ মাসের ১৪ তারিখ উল্লেখ আছে। এ ছাড়া ওই রুমের এক আলমারির মধ্যে তাঁর কিছু জামা কাপড়ও আছে।
মাসুদ রানাকে গত সোমবারও হলে দেখা যায় বলে জানিয়েছেন ফজলুল হক মুসলিম হলের একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী। তিনি নিয়মিত থাকেন কি না, জানতে চাইলে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, ‘তাঁকে মাঝেমধ্যে হলে দেখা যায়। তবে তাঁর দখলে হলের একটা রুম আছে। তিনি এই হলে ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ছিলেন।’
বনফুলের অভিযোগ
সম্প্রতি মিষ্টির দোকান বনফুলের চাঁনখারপুল শাখা ফজলুল হক হল প্রশাসনের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ করে। বনফুলের অভিযোগ, গত ২৩ সেপ্টেম্বর ফজলুল হক হলের ছাত্রলীগের বড় নেতা পরিচয়ে তিনজন যুবক এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন এবং দোকানের ম্যানেজারকে মারধর করেন।
বনফুল তিনজনের নাম দেয়। এর মধ্যে একটি নাম মাসুদ। ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে তিনিই মাসুদ রানা।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর হল প্রভোস্ট ড. মিজানুর রহমান বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দেন বনফুল অ্যান্ড কোং চানখাঁরপুল শাখার ব্যবস্থাপক মো. আল আমিন। ওই অভিযোগপত্রে তিনজনের নাম উল্লেখ করা হয়। ওই তিনজনের নাম হচ্ছে, জিসান, রাকিব ও মাসুদ।
ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জিসান হচ্ছেন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপসম্পাদক মো. আরিফুল ইসলাম জিসান; রাকিব হচ্ছেন, হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম এবং মাসুদ হচ্ছেন সাবেক হল ছাত্রলীগ সদস্য মাসুদ রানা। মাসুদ রানা বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
গত শনিবার বিকেলে একদল ছেলে ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে এসে ছাত্রলীগের বড় নেতা দাবি করে এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। টাকা না দেওয়াতে ম্যানেজারসহ দুজনকে মারধর শুরু করেন এবং একজনকে ছুরিকাঘাত করেন। তারপর আমাকে ও আমার সহকর্মী গিয়াস উদ্দিনকে ফজলুল হক মুসলিম হলের গেস্টরুমে নিয়ে যান এবং অমানবিকভাবে মারধর করেন। পরে চাপাতি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেন। এ সময় সাংবাদিক সমিতিতে খবর যাওয়ায় আমাদের ছেড়ে দেন। অপরাধীদের মধ্যে তিনজনের নাম ছিল- জিসান, রাকিব, মাসুদ।
বিষয়টি তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে হল প্রশাসন। হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মমিনুল ইসলামকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে হল প্রশাসন।
‘আমাকে ফাঁসানো হয়েছে’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শফিউল ইসলাম বলেন, ‘মাসুদ এক বছর হয়েছে জবিতে যোগ দিয়েছে। তবে সে কোথায় থাকে জানি না।’ চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে এ ব্যাপারে কিছু জানেন না বলে জানান তিনি।
এদিকে হলে থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেন মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ‘আমি এখন জবির শিক্ষক। এখন আর হলে থাকি না।’ হলে তাঁর দখলে একটা সিট আছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি সেটিও অস্বীকার করেন।
চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে মাসুদ বলেন, ‘আমি তাঁদের কাছে চাঁদা চাইনি।’ বনফুলের অভিযোগনামায় তাঁর নাম উল্লেখ আছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘আমাকে ফাঁসানো হয়েছে।’
হলের আবাসিক শিক্ষক অধ্যাপক ড. মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেক হলেই এমন অবস্থা দেখা যায়। তবে যেসব আবাসিক শিক্ষকদের দায়িত্ব থাকে তাঁদের এটা দেখা উচিত। এখন তথ্য পাওয়া গেছে আমরা হল প্রশাসন থেকে ব্যবস্থা নেব।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ এম আমজাদ বলেন, ‘এটা হলের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে হলের প্রাধ্যক্ষ ভালো বলতে পারবেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘জবির শিক্ষক হওয়ার পরও তিনি হলে থাকেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটি হল প্রশাসন দেখবে।’