আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মিয়ানমারে সামরিক অভিযানের মুখে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন যেসব রোহিঙ্গা মুসলমান তারা দেশে ফিরতে পারলেও তাদের জমিজমা ও ঘরবাড়ি হারাতে হতে পারে।
এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে রয়টার্স বলছে, মিয়ানমার সরকার পরিকল্পনা করছে যে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত নেয়া হলেও তাদেরকে নিজেদের ঘরদোরে ফিরে যেতে দেওয়া হবে না।
কঠোর সনাক্তকরণের প্রক্রিয়ায় যেসব রোহিঙ্গা উতরাবে, শুধুমাত্র তাদেরকেই সরকারি ব্যবস্থাপনায় অন্যত্র গ্রাম তৈরি করে সেখানে পাঠানো হবে।
রয়টার্সের সাংবাদিকরা এ নিয়ে কয়েক জন সরকারি কর্মকর্তার সাথে কথা বলেছেন। কিছু সরকারি পরিকল্পনার দলিলও তাদের হাতে এসেছে।
রয়টার্স জামিল আহমেদ নামের একজন রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে এবং এই রিপোর্টে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে জমির মালিকানা প্রমাণ করার পরও হয়তো মি. আহমেদকে তার নিজের গ্রাম কিউক পান ডু গ্রামে ফিরে যেতে নাও দেয়া পারে।
শরণার্থীরা ফিরে এসে জমির মালিকানা দাবি করতে পারবে কি না, রয়টার্সের এই প্রশ্নে জবাবে রাখাইনের কৃষিমন্ত্রী চিয় লুইন বলেছেন, “এটা নির্ভর করে তাদের ওপর। যাদের নাগরিকত্ব নেই, তাদের জমির মালিকানা নেই।”
মিয়ানমারের নেত্রী অঙ সান সুচি বলেছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন এমন কেউ যদি পরিচয়ের প্রমাণপত্র দেখাতে পারেন, তবে তাদের মিয়ানমারে ফেরত আসতে দেয়া হবে।
রয়টার্স রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এবং পুনর্বাসনের সাথে জড়িত ছয়জন কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নিয়েছে যেখানে এই পরিকল্পনা সম্পর্কে সরকারি নীতিমালার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।
যেভাবে রোহিঙ্গাদের পরিচয় পরীক্ষা হবে
মিয়ানমারের সরকারি পরিকল্পনার বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, যারা মিয়ানমারে ফিরে আসবেন প্রাথমিকভাবে তাদের একটা অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রাখা হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, এখানে শরণার্থীদের একটি ফর্ম পূরণ করতে হবে যেখানে ১৬টি পয়েন্ট রয়েছে।
এরপর স্থানীয় প্রশাসনের কাছে রাখা দলিলের মাধ্যমে এদের পরিচয় যাচাই করা হবে।
মিয়ানমারের ইমিগ্রেশন বিভাগের কর্মকর্তারা প্রতিবছর রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের ওপর জরিপ চালিয়েছে এবং রোহিঙ্গাদের ফটো তুলে রেখেছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
যেসব শরণার্থীর কাগজপত্র হারিয়ে গেছে, তাদের ছবির সাথে ইমিগ্রেশন বিভাগের ছবি মিলিয়ে দেখা হবে বলে বলছেন মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন এবং জনসংখ্যা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মিন্ট চায়ে।
‘মডেল গ্রাম’
রয়টার্স বলছে, অনেক শরণার্থী ফিরতে ভয় পাচ্ছেন এবং তাঁরা মিয়ানমারের আশ্বাসের ব্যাপারে সন্দিহান।
যারা ফিরে যাবেন বলে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাদের প্রথমে একটি বা দুটি কেন্দ্রে গ্রহণ করা হবে।
সরকারি পরিকল্পনার পর্যালোচনা করে রয়টার্স বলছে যে এরপর তাদের বেশীরভাগকে মডেল গ্রামে পুনর্বাসন করা হবে।
আন্তর্জাতিক অনেক দাতা সংস্থা ২০১২ সালের সহিংসতার পর রাখাইনে অস্থায়ী শিবিরে অভ্যন্তরীনভাবে বাস্তুচ্যুত এক লক্ষ ২০,০০০ রোহিঙ্গাকে দেখাশুনা করছে ও খাবার-দাবার দিচ্ছে। এই সব প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারকে বলেছে তারা আর অতিরিক্ত কোন ক্যাম্প চালাতে পারবে না। ত্রাণকর্মী ও কূটনীতিকদের বরাতে এই তথ্য জানা গেছে।
জাতিসংঘের মুখপাত্র স্তানিস্লাভ স্যালিং এক ইমেল জবাবে বলেন, “নতুন অস্থায়ী ক্যাম্প বা ক্যাম্পের মত আশ্রয় তৈরি করা হলে অনেক ঝুঁকি হতে পারে, যেমন ফিরে আসা ব্যক্তি ও অভ্যন্তরীনভাবে বাস্তুচ্যুতরা এসব ক্যাম্পে লম্বা সময়ের জন্য আটকা পড়তে পারেন”।
স্যাটেলাইট ছবির বরাত দিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে ২৫শে অগাস্টের পর ২৮৮টি গ্রাম – যেগুলো মূলত রোহিঙ্গারা বাস করতো – পুরোপুরি কিংবা আংশিকভাবে আগুনে পুড়ে গেছে।
শরণার্থীরা বলছে, সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধরা দাঙ্গাকারীরা বেশীরভাগ অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী। তবে সরকার বলছে, রোহিঙ্গা যোদ্ধা এবং এমনকি বাসিন্দা নিজেরাই আগুন লাগায় প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্য নিয়ে।
সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী সচিব সোয়ে অঙ বলেন, রোহিঙ্গারা যেসব পল্লীতে বাস করতো, সেগুলো “ঠিক গোছানো নয়”, তাই সারিবদ্ধভাবে এক হাজার ঘরবাড়ি নিয়ে ছোটছোট গ্রাম গড়ে তোলা যেতে পারে যেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সহজ হবে”।
“কিছু গ্রাম আছে, যেখানে তিনটি বাড়ি এখানে, চারটি বাড়ি সেখানে। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, এসব গ্রামে আগুন লাগলেও সেখানে দমকলের গাড়ি যাওয়ার কোন রাস্তা পর্যন্ত নেই,” সোয়ে অঙ বলেন।
পাকা ধানের বেহাত মালিকানা
রয়টার্স বলছে, উত্তর রাখাইনের সংঘাতময় এলাকা থেকে ৫৮৯,০০০ রোহিঙ্গা এবং প্রায় ৩০,০০ হাজার অমুসলিম পালিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার ৭১,৫০০ একর জমিতে পাকা ধানের কোন মালিকানা নেই।
সরকার পরিকল্পনা করছে, এই ধান তারা সরকারি গুদামে তুলবে।
রয়টার্স এমন একটি সরকারি দলিল দেখেছে যেখানে ধানী জমিকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
একটি ভাগের জমির মালিকানার নাম দেয়া মূল জাতিগোষ্ঠী, অর্থাৎ এসব জমির মালিক বর্মী। আর অন্য জমির মালিকানায় লেখা হয়েছে ‘বেঙ্গলি’ অর্থাৎ মিয়ানমার সরকার যে নামে রোহিঙ্গাদের ডেকে থাকে।
রাখাইনের কৃষিমন্ত্রী চিয় লুইন রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন ৪৫,০০০ একর জমিকে ‘মালিকবিহীন বাঙ্গালী জমি’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, রোহিঙ্গা জমির ফসল ঘরে তুলতে কৃষি মন্ত্রণালয় ১৪টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন দিয়ে চলতি মাসেই কাজ শুরু করবে।
তারা মোট ১৪,৪০০ একর জমির ফসল কাটতে পারবে। বাকি ফসলের কী হবে তা এখনও পরিষ্কার নয়।
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, এই কাজে তারা অতিরিক্ত শ্রমিক ব্যবহার করবেন বলে পরিকল্পনা করছেন। রয়টার্স বলছে, প্রতি একর জমির ধান থেকে সরকারের আয় হবে ৩০০ মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ।
এর মানে হলো, পরিত্যক্ত ফসলি জমি থেকে মিয়ানমার সরকারের লক্ষ লক্ষ ডলার আয় হবে।
রাখাইন রাজ্যের সচিব টিন মং সোয়ে রয়টার্সকে জানিয়েছেন, এসব ধান সরকারি গুদামে তোলা হবে, এরপর এই ধান হয় এই সংঘাতে আশ্রয়হীন হয়েছেন যারা তাদের মধ্যে বিতরণ করা হবে, নয়তো বিক্রি করা হবে।
তিনি বলেন, “জমি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। ফসল তোলার কেউ নেই। তাই সরকার ফসল কাটার আদেশ দিয়েছে।”
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক উপপরিচালক ফিল রবার্টসন বলছেন, মিয়ানমার সরকার এসব জমি অন্তত মানবিক কাজে ব্যয় করবে বলেই তারা আশা করছেন।
“সহিংসতা এবং অগ্নি সংযোগ করে মালিকদের দেশ থেকে বিতাড়ন করলেই, কোন জমির ফসলকে মালিকবিহীন বলা যায় না।”