বিশ্বের অনেক দেশেরই আমোদপ্রিয় মানুষের কাছে বেশ পরিচিত ডি-জে বা ডিস্ক জকি। বাংলাদেশে একটা সময় পুরুষদের মধ্যে কাজটি সীমাবদ্ধ থাকলেও কয়েক বছর ধরে এর প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছে মেয়েদেরও।
বিভিন্ন পার্টিতে গানের মিক্সিং করে তার তালে তালে অতিথিদের মাতানোর কাজটি করেন একজন ডিজে। নারীদের অনেকেই পেশাদার ডিজে হিসেবে কাজ করছেন। কেমন এই ডিজে দুনিয়া?
লাউড স্পিকারে গান বাজছে। একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ব্যাচের পুনর্মিলীন অনুষ্ঠান। মিউজিকের তালে তালে নাচছে শিক্ষার্থীরা। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছে মিউজিক আর গান। মঞ্চে নিপুন মুন্সিয়ানায় কাজটি করছেন একজন ডিস্ক জকি। যিনি ডিজে নামেই পরিচিত বেশি।
বাংলাদেশে মেয়েদের মধ্যে প্রথম ডিজে হিসেবে মনে করা হয় যাকে, সেই ডিজে সনিকাকে দেখে আগ্রহী হয়ে ২০০৭ সাল থেকে কাজ শুরু করেন সুলতানা রাজিয়া সুমি। শহরাঞ্চলে এখনকার তরুণ-তরুণীদের কাছে ডিজে পার্টি বা ডিজে শো খুব পরিচিত।
নিউইয়ার পার্টি, থার্টি ফার্স্ট নাইট, বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক অনুষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের রি-ইউনিয়ন থেকে শুরু করে জন্মদিন বিয়ে সবকিছুতেই ডিজে মানে বিশেষ আনন্দ।
মেয়েদের জন্য এখনও ঝুঁকিপূর্ণ পেশা : ডিজে দুনিয়ায় ‘ডিজে সনিকা’ হিসেবে পরিচিত হলেও পুরো নাম মারজিয়া কবীর। সনিকা শুধু দেশেই নন, ভারত, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন শোতে নিয়মিত ডিজে হিসেবে কাজ করেন।
ডিজেদের ডাক পড়ে বড় বড় রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও। আইসিসি ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১১ ইভেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান কিংবা হাতিরঝিলে ডান্স অব ফাউন্টেন এর উদ্বোধনে মিউজিক করার তেমনই অভিজ্ঞতার কথা জানান ডিজে সনিকা। কিন্তু ‘মেয়েদের জন্য এখনো এটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা’ বলে মনে করেন তিনি।
সনিকা বলেন, আমি একেবারে মিডিয়া থেকে আলাদা ছিলাম। কিন্তু ডিজে রাহাত তার ডিজে স্কুলে বাংলাদেশে প্রথম কোনও ডিজে শিখতে আগ্রহী প্রথম ব্যাচকে বিনামূ্ল্যে শেখাবে। তখন প্রথম আমি জানলাম মেয়ে ডিজে নাই দেশে। আমার তখন মনে হলো এটা করতে হবে”।
তবে সনিকা বলেন, “মূলত লোকজন সন্ধ্যার দিকেই ডিজে করতে পছন্দ করে। খুব কম দিনে হয়। জন্মদিন বা পিকনিক এগুলো দিনে হয়। বাকিটা কিন্তু রাতেই হয়। একটা মেয়ের জন্য রাতে বের হয়ে কাজ করা অনেক বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমাকে তো সেরকম সিকিউরিটি নিয়ে যেতে হবে। যাতে নিরাপদে গিয়ে নিরাপদে ফিরতে পারি। দুজন মানুষেকে সাথে রাখতে হয়।”
আগে ডিস্কের মাধ্যমে গানের ব্যবহার করা হলেও, বর্তমান পেনড্রাইভ এর যুগে কাজটি সেভাবে আর করতে হয়না। পুরুষদের মধ্যে ডিজে হিসেবে অনেকেই কাজ করছেন বেশ আগে থেকেই এবং তাদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে সঙ্গীত পরিচালনা, বিজ্ঞাপনের কাজ ইত্যাদিতেও যুক্ত হয়েছেন।
প্রথমদিকে যারা বাংলাদেশে ডিজে সংষ্কৃতি চালু করেন তাদের মধ্যে ডিজে প্রিন্স, ডিজে রাহাত, ডিজে লিটন, ডিজে মিরাজসহ অনেকে এই নামগুলো উঠে আসে। তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বর্তমানে আরো অনেক তরুণ-তরুণীই কাজ করছেন। ডিজে মিরাজ ১০ বছর ধরে বিভিণ্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করছেন। তিনি নিজেই প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন উঠতি অনেক ডিজেকে।
পেশা হিসেবে কতটা গ্রহণ করার মত? ডিজে মিরাজ বলেন, ‘যেহেতু এখন কর্পোরেট ইভেন্ট বা ওয়েডিং ইভেন্ট বর্তমানে অনেক বিস্তার লাভ করেছে। অনেকব বেশি হয় সেক্ষেত্রে আমি বলবো এখন যদি কেউ এটাকে পেশা হিসেবে নিতে চায় ডিজে পেশা অন্য অনেক পেশার চেয়ে তুলনামূলক অনেক ভালো”
রাত গভীর হলেই মূলত শুরু হয় তাদের কাজ। দিনের বেলাতেও অবশ্য ডাক পড়ে বিভিন্ন আয়োজনে। বাংলাদেশে ডিজে হিসেবে এখন রাতভর কাজ করছে মেয়েরাও। কিন্তু রাতের কাজ হওয়াতে সামাজিক ভাবে বিষয়টি কিভাবে দেখা হয়?
সুমি বলেন, ” ডিজেটা শুধু না মিডিয়া বলতেই সাধারণ মানুষ অন্য একটা দেখে। আর আমরা যেহেতু রাতের বেলা কাজটা করি। রাতের বেলাই কাজ শেষে করে ফিরি। সেক্ষেত্রে অনেকে কটূক্তি করে। কিন্তু তারপরও ওই চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নাহলে তো আমাদের স্বপ্নটা পূরণ করতে পারবো না”।।
প্রশিক্ষণ নিচ্ছে অনেকেই: ডিজে বা ডিস্ক জকি হওয়ার জন্য এখন প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন অনেক তরুণ-তরুণী। প্রতিষ্ঠিত ডিজেরাই খুলেছেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রোজগারের সুযোগও রয়েছে প্রচুর।
একটা সময় ঢাকা- চট্টগ্রামের মত বড় শহরে এধরনের আয়োজন করা হলেও এখন ডাক পড়ছে মফস্বলের অন্যান্য এলাকাতেও। ডিজে সনিকা বা সুমির মত ডিজে মারিয়া, ডিজে ফারজানা, ডিজে পরী এবং আরো অনেক মেয়েই মঞ্চ মাতাচ্ছেন।
তবে ডিজেদের সাজ-পোশাক নিয়ে অনেকসময় অনাকাঙ্খিত মন্তব্য এড়াতে সতর্ক থাকতে হয়। সুমি বলেন, বিয়ে ববাড়িতে বা জন্মদিনে যে পোশাক পড়ে যাওয়া যায় সে পোশাক কর্পোরেট কোনও অনুষ্ঠানে পড়া যায় না। ফলে বাড়তি সতর্কতা রাখতেই হয়, জানান সুমি।
ডিজেদের মধ্যে কেউ কেউ অ্যালবামে মিউজিক করছেন, কেউ কেউ চলচ্চিত্রে সুর দিচ্ছেন। সুযোগ আছে অর্থ ও পরিচিতি দুটোই পাওয়ার।
আবার কেউ কেউ বিজ্ঞাপন বা মিউজিক ভিডিওতে মডিলং করছেন বা অংশ নিচ্ছেন নাটক অথবা নাচের প্রোগ্রামে। তাই আগ্রহী হচ্ছেন অনেক তরুণ। তবে এখনও এ পেশার প্রতি সামাজিক মনোভাব যথেষ্ট ইতিবাচক হয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে বলে মনে করেন ডিজেরা। -সূত্র: বিবিসি বাংলা।