বিদায় নিলো ১৪২৪। শুক্রবার (১৩ এপ্রিল) চৈত্রের শেষ সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে কালের মহাতরঙ্গে মিলিয়ে গেলো বাংলা সনটি। রাত পোহানোর পর আজ শনিবার ভোরে নতুন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে বাংলা নববর্ষ ১৪২৫। পুরনো বছরের সব হতাশা, গ্লানি আর জরাজীর্ণতা পেছনে ফেলে আগামীর পানে চোখ থাকবে সবার। বোনা হবে নতুন নতুন স্বপ্ন। নব প্রত্যাশার ডানা মেলে ঝলমলিয়ে উঠবে নতুন আলো। বিদায়ী বাংলা বর্ষের বিরহকে ছাপিয়ে সবার মনে ছড়িয়ে যাবে নববর্ষের রঙ। আনন্দ-উল্লাসে আবাহন করা হবে ১৪২৫ বঙ্গাব্দকে।
প্রতি বছরের মতো এবারও পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেওয়া হবে ধুমধাম আয়োজনে। নতুন বছরকে বর্ণিলভাবে বরণ করে নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের হাটেবাজারে, মাঠেঘাটে, পাড়ায়-পাড়ায় চলে বর্ষবিদায়ের অনুষ্ঠান। একইসঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও স্থাপনাকে সাজিয়ে তোলা হচ্ছে নতুন সাজে। সব মিলিয়ে ধুম পড়েছে উৎসব আয়োজনে।
নতুন বছরের অভ্যর্থনার আনন্দে নানা সুখ-দুঃখের সঙ্গী পুরনো বছরটিকে বিদায়লগ্নে ভুলে যায় না বাঙালিরা। বাংলায় নতুন বছরকে স্বাগতম জানানো হয় যেমন উৎসব করে, পুরানো বছরকে বিদায় দেওয়া হয় তেমনই গুরুত্ব দিয়ে। চৈত্র মাসের বিদায়ের মধ্য দিয়েই এখন দেশজুড়ে চলছে বর্ষবিদায়ের আয়োজন।
পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া উপলক্ষে নতুন পোশাক কেনার ধুম পড়েছে, ব্যস্ততা বেড়েছে বুটিকগুলোতে। বিপণি বিতান ও মার্কেটে চলছে কেনাবেচা। নানান ডিজাইনের পোশাক বিক্রি ও কেনায় ব্যস্ত দোকানি ও ক্রেতারা। বৈশাখী উৎসবের আগাম প্রস্তুতি চলছে জোরেশোরে।
আজ ৩০ চৈত্র বিদায়ী বাংলা সনের শেষ দিনে উদযাপন করা হচ্ছে ‘চৈত্র সংক্রান্তি’। একসময় চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ হিন্দুদের শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠান হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল। আজ তা সম্প্রদায় ছাপিয়ে হয়ে উঠেছে জাতীয় ও সামাজিক উৎসব। আদিবাসীরাও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান করে থাকে। সব মিলিয়ে বর্ষবিদায়ের আয়োজন চিরায়ত বাংলার অসাম্প্রদায়িক বাঙালির কাছে পরিণত হয়েছে বিশেষ লোকজ উৎসবে।
শহরের মতো গ্রামবাংলায়ও পালন হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব। দেশজুড়ে শহর-গ্রামে চলছে মেলা। এসব আয়োজনে উঁকি দেয় হাজারও খুশির আভা। চৈত্র মাসের শেষে চৈত্রসংক্রান্তির অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পুরনো বছরকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় জানানোর প্রয়াসই বাঙালিদের স্বকীয়তা। এবার বর্ষবরণে প্রস্তুত সারাদেশ। চারপাশে আনন্দমুখর পরিবেশ।
প্রসঙ্গ ‘হালখাতা’
চৈত্র সংক্রান্তিকেই ঘিরেই মূলত শুরু হয় হালখাতা। এটি হলো বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া। এই দিনে নতুনভাবে ব্যবসা শুরুর উপলক্ষ পান তারা। গ্রাম, শহর বা বাণিজ্যিক এলাকা; সবখানেই পুরনো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে খোলা হয় নতুন হিসাবের বই। ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে ক্রেতাদের নিমন্ত্রণ পাঠান। অতিথি এলেই গোলাপজল ছিটিয়ে অভ্যর্থনা জানানো হয়। দোকানে দোকানে চলে মিষ্টি খাওয়ার ধুম। অতিথি-অভ্যাগতদের মিষ্টিমুখ করানো হয় যত্ন নিয়ে। রসে ডুবুডুবু মিষ্টির সঙ্গে থাকে মুচমুচে ভাজা কালিজিরা ছিটানো হালকা গেরুয়া রঙের নিমকি। এই প্রথা এখনও বেশ প্রচলিত।
বাংলাদেশে হালখাতার প্রচলন কবে থেকে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা দুষ্কর। তবে হালখাতা শব্দটির সঙ্গে মুসলিম শাসনের অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। ‘হাল’ আর ‘খাতা’ দুটোই আরবি-ফারসি। এর অর্থ নতুন খাতা। ষোড়শ শতাব্দীতে এই শব্দ বাংলায় প্রচলিত হয়েছে বলে গবেষকরা অনুমান করেন।
আগে অগ্রহায়ণ মাসে বাংলা নতুন বছরের গণনা শুরু হতো। পরবর্তী সময়ে বাদশাহ আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য ও বাংলা মুলুকে ফসল কাটার মৌসুমের কথা মাথায় রেখে বৈশাখী মাস থেকে ফসলি সন চালু করেন। এর অংশ হিসেবে পয়লা বৈশাখ থেকে নতুন বছরের হিসাব রাখা শুরু হয়। বাংলার জমিদারদের ‘পুণ্যাহ’ অনুষ্ঠান অনুযায়ী খাজনার হিসাব করার রেওয়াজ সম্ভবত বাংলার বণিক ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে প্রভাবিত করেছিল। তাই জনশ্রুতি রয়েছে, জমিদারি আমলেই হালখাতার ব্যবহার তুঙ্গে উঠেছিল বাংলাদেশে।
হালখাতা আজও পয়লা বৈশাখে খোলা হয়। সুতা দিয়ে বাঁধা লাল খেরো খাতা এর প্রধান উপকরণ। এতে ব্যবসায়ীরা তাদের লেনদেন, বাকি-বকেয়া সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখেন। মুসলিম ব্যবসায়ী হলে হালখাতায় ‘এলাহী ভরসা’ অথবা হিন্দু ব্যবসায়ী হলে ‘গণেশায় নমঃ’ লেখা থাকে।
নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে যারা ব্যবসায়ীদের নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভার্থী, তাদের চিঠি দিয়ে বা লোক মারফত আমন্ত্রণ জানিয়ে জলযোগে আপ্যায়ন করা হয়। এই দিনে কেনাবেচার চেয়ে সামাজিকতা ও সৌজন্য বিনিময় হয় বেশি। তবে সৌজন্যমূলক হলেও অনেকে বকেয়া শোধ করে দেন। যদিও সেই রমরমা দিন এখন আর নেই। তবুও ডিজিটাল ঝাপটা সামলে হালখাতা টিকে আছে। হয়তো টিকেও থাকবে ঐতিহ্য হিসেবে।
লোকজ ঐতিহ্য
রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানান আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তি উদযাপন করছে। এর মধ্যে রয়েছে ঘুড়ি উৎসবে রকমারি সব ঘুড়ির প্রদর্শনী, গ্রাম বাংলার জনপ্রিয় লাঠি খেলা, পুঁথি পাঠ, পুতুলনাট্য, পালাগান, গম্ভীরা ও গ্রামীণ মেলা, গান, আবৃত্তি, সঙযাত্রা, রায়বেশে নাচের মতো লোকসংস্কৃতি। মুড়ি-মুড়কি বিতরণ তো হচ্ছেই।
বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণকে ঘিরে মাটির তৈরি খেলনা, ফল, ঘোড়া, হাতিসহ বিভিন্ন সামগ্রী তৈরির পর তাতে লেগেছে রঙ। নববর্ষকে ঘিরে রঙের তুলিতে মাটির সামগ্রী রাঙানোর সমারোহে প্রাণ পেয়েছে মৃৎশিল্প।
এসো হে বৈশাখ…
উৎসব-আনন্দে বাংলা নববর্ষ ১৪২৫ বরণ করে বৈশাখী উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে যাবে বাঙালিদের জীবনে। নতুন বছর সারাদেশে সবার জন্য শুভ হোক, মঙ্গল বয়ে আনুক। নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার প্রেরণা নিয়ে আসুক নববর্ষ। সেই প্রার্থনায় এখন অপেক্ষা নতুন বছরের প্রথম প্রভাতের। পুরনো বছরকে বিদায় দিয়ে আসুন গাই রবিঠাকুরের গান, ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…’।