এস,এম, আহম্মাদ উল্যাহ বাচ্ছু : ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের অদম্য সাহস ও মনোবলের কারণে পাক সেনারা সে দিন হটে যেতে বাধ্য হয়েছিল। একাত্তরের ২০ নভেম্বর সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা দীর্ঘ ৮ মাস যুদ্ধ করে কালিগঞ্জ অঞ্চলকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন। এযুদ্ধে কালিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা তেমন বেশী হতাহত না হলে ও পাক বাহিনীর অনেক সদস্যরা মুক্তিসেনাদের হাতে প্রাণ হারায় এই মাটিতে। ক্যাপ্টটেন নূরুলহুদার নেতৃতে কালিগঞ্জে ২০ নভেম্বরের দুপুরে প্রথমে ওয়াপদা ডাকবাংলাস্ত পাকসেনা ঘাটি দখল করে জাতীয় পতাকা উত্তলন করার পর সোহরাওয়ার্দ্দী পার্ক প্রাঙ্গণে মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। বাঙালীর জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষনে সরাসরি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলে সারা বাংলা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। শ্যামলীঘেরা শান্ত সুশীতল কালিগঞ্জ ও সেই বিপ্লবে উত্তাল হয়ে ওঠে। সে সময় মুক্তি সংগ্রামকে সংগঠিত করতে তৈরি হয়েছিল ২৩ সদস্যের “কালিগঞ্জ সংগ্রাম পরিষদ”। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যরা রাত দিনের কর্ম-তৎপরতায় মাঝে কালিগঞ্জের রাজনৈতিক চিত্র পাল্টে দিল। একাত্তরের ৮ মার্চ কালিগঞ্জের ডাকবাংলা চত্বরে শত শত মানুষ সমবেত হয়ে উন্মত্ত আক্রোশে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে পুড়িয়ে ফেলা হয় পাকিস্থানের পতাকা। এ সময় লাঠি মিছিলও হয়েছিল কালিগঞ্জ থানা সদরে। ফেটে পড়েছিল কালিগঞ্জের ছাত্র ও সকল তৌহিদী জনতা। সেদিন ঠিক করা হয়েছিল যশোরের এ পাশে পাক হানাদার আর্মিকে আসতে দেয়া হবে না। ১০ ও ১১ এপ্রিলের দিকে রটে যায় পাক আর্মি কালিগঞ্জের দিকে আসছে। এখবর শুনে ক্রোধে ও উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে সংগ্রাম পরিষদ। দ্রুত এলাকার সমস্ত বন্দুকধারীদের সংঘবন্ধ করে কালিগঞ্জ বাজার থেকে থানা পর্যন্ত নদীর তীরে গেওয়া বাগানের ঝোঁপের মধ্যে পজিসন নিয়েছিল বন্দুকধারীরা। হঠাৎ রটে গেল সংগ্রাম পরিষদের একটা নামের লিস্ট পাক আর্মির কাছে পৌছে গেছে। সে মোতাবেক জন্মভূমি ত্যাগ করে ১৪ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিলের মধ্যে সংগ্রাম পরিষদের সদস্যবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের জন্য সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যায়। এদিকে সকল বাধা বিপত্তি মায়া মমতা কাটিয়ে মে মাসের মধ্যে শত শত দামাল ছেলেরা দেশমুক্তির শপথ নিয়ে মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য চলে যায়। এদিকে পাক আর্মি ঘাঁটি গাড়লো ওয়াপদা ডাক বাংলা ভবন, বসন্তপুর চন্দ্রদেবের পরিত্যাক্ত বাড়ি, কালিগঞ্জ হাসপাতালের সংলগ্ন এলাকা, দমদম ফেরি ঘাটের বরফকল এবং খানজিয়া ই.পি.আর ক্যাম্প। দ্রুত তাদের পরিধি আরো সম্প্রসারিত করে সাদপুর ব্রীজ, ভাড়াশিমলা, সুইলপুর, খানজিয়া, নাজিমগঞ্জ, বসন্তপুর, উকস্ াপিরোজপুরসহ গোটা সীমান্ত এলাকা ঘিরে ফেলে হায়না বাহিনী নিরিহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। এসময় তারা সারা দেশের ন্যায় কালিগঞ্জেও গঠণ করে পিস কমিটি ও রাজাকার বাহিনী। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিশোধ স্পৃহায় দ্রুত আর্মস ট্রেনিং নেয় ভারতের হিঙ্গলগঞ্জসহ বিভিন্ন শিবিরে। মে মাসের মধ্যে ট্রেনিং শেষে তারা ফিরে আসেন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে। ৯নং সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল ও তার সহযোগি ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা, লে. বেগ, লে. আরেফিন ও লে. শচীন এদের নেতৃত্বে জুন থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে নিজ বাসভূমির উপর কৌশলে হায়না বাহিনীর উপর অসংখ্য আক্রমন পরিচালনা করে। এসময় পাক সেনারা কালিগঞ্জ দখলে রাখতে বিভিন্ন ক্যাম্পে ভারী অস্ত্র মেশিনগ্যান, কামান, মটার ইত্যাদি মজুদ করে। এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খোজ খবর পেতে তারা গোয়েন্দা নিয়োগ করে। তাদের অত্যাধুনিক অস্ত্র শস্ত্রের বিরুদ্ধে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা দেশীয় নিম্ন মানের অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে মনোবল কে সম্বল করে অসম যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। প্রথমে তারা বসন্তপুর বিওপি, খানজিয়া ক্যাম্প ও কালিগঞ্জ থানা সদরের বিওপি ক্যাম্পের উপর আক্রমণ শুরু করে। পরে বাগবাটি, পিরোজপুর, ভাড়াশিমলা, রতনপুর, নজিমগঞ্জ, উকস্,া দুদ্লীসহ বিভিন্ন পাক ঘাঁটিতে বারবার চোরাগুপ্তা আক্রমণ করে পাক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে অক্টোবর ও নভেম্বরে কালিগঞ্জ একটা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আক্রমন পাল্টা আক্রমন আর রাইফেল, মেশিনগান, গ্রেনেড, রকেট লাঞ্চারের শব্দে ও আগুনে কালিগঞ্জের আকাশ, বাতাস, মাটি, প্রকম্পিত হতে থাকে। উকসা বিওপি ক্যাম্প আক্রমন পিরোজপুর ও খানজিয়ার সম্মুখ সমরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কালিগঞ্জের আপামর জনসাধারণ পাকিস্তানী নরপশুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। সে সময় সকল স্থরের জনতা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে থাকে। এযুদ্ধে কালিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা খুব বেশী হতাহত না হলে ও পাক বাহিনীর অনেক সৈন্যদের প্রাণ হারাতে হয়েছিল সেদিন। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তোপের মুখে হানাদার বাহিনী ২০ নভেম্বর ভোরে কালিগঞ্জ ছেড়ে সাতক্ষীরার পুস্পকাটি নামক স্থানে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এখবরে উল্লাসিত হয়ে ২০ নভেম্বর কালিগঞ্জের ডাকবাংলা চত্বরের বকুল তলায় মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে কালিগঞ্জের স্বাধীনতার শুভ সুচনা করেন।