বিশেষ সংবাদ: ’রক্তাভ চাঁদ’ এর মহাজাগতিক বিস্ময়ে মুগ্ধ জগতবাসী। শুক্রবার দিবাগত রাতটি ছিলো শিহরন জাগানো অভাবনীয় মহাজাগতিক রাত। ভরা পূর্নিমায় আকাশের বুকে জগতের কোটি কোটি মানুষ অবলোকন করেছেন একুশ শতাব্দীর এক বিরল আশ্চর্য দৃশ্যমালা। দীর্ঘ চন্দ্রগ্রহণকালে ধবল জোছনার বদলে রক্তের মতো টকটকে লাল চাঁদ ছড়িয়েছে ’রক্তাভ জোছনা’।
এই রাতটা ছিলো অন্যরকম। এক অপার্থিব অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলো বেশুমার মানুষ। সন্ধ্যাকাশে চাঁদ উদিত হওয়ার পর ঘুরতে ঘুরতে প্রবেশ করে একেবারে পৃথিবীর ছায়ার মধ্যে। অতপর গ্রহণস্পর্শ তাকে
গ্রাস করতে থাকে। টানা ১ ঘণ্টা ৪৩ মিনিট ধরে চাঁদের মুখ ঢেকে যায় সম্পূর্ণ। তার আগে ১ ঘণ্টা ৬ মিনিট ধরে চলে আংশিক চন্দ্রগ্রহণ। আবার পূর্ণগ্রাস হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় আংশিক গ্রহণ, যা চলে আরও ১ ঘণ্টা ৬ মিনিট ধরে। এই দীর্ঘতম পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ বাংলাদেশের আকাশেও যেখানে মেঘমুক্ত ছিল সেখান থেকে অবলোকন করা গেছে।
তবে সজল সঘন মেঘমালা ছাওয়া ঢাকার আকাশে দেখা যায়নি চন্দ্রগ্রহণ। গ্রিনিচ মান সময় রাত ৮টা ২১ মিনিটে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুরু হয় এই গ্রহণ। বিভিন্ন দেশের মানুষ রীতিমত উৎসবের আমেজে এই ব্লাডমুন দেখার আয়োজন করে।
নাসা’র তথ্য মতে,শুধু গ্রহণ হওয়াই নয়, চাঁদ সূর্যের আলো বিকিরণ করে লাল হয়ে যায়। গত প্রায় ৬০ হাজার বছরের মধ্যে দ্বিতীয় বার পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসা ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গলকে রাতের আকাশে অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যায়। কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীকে মাঝখানে রেখে সূর্যের ঠিক উল্টো দিকে চলে যায় মঙ্গল, আর ১০০ বছরের মধ্যে যেখানে ‘উপনিবেশ’ বানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে মানবসভ্যতার।
যদিও ‘লাল গ্রহ’ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে আসবে ৩১ জুলাই, আগামী মঙ্গলবার। সেদিন পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব হবে প্রায় পাঁচ কোটি ৭৬ লক্ষ কিলোমিটার। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই একটি চন্দ্রগ্রহণ দেখা যাবে, তবে তা আংশিক। ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারি হবে আরও একটি পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণ। তবে তা উপমহাদেশ থেকে দেখা যাবে না। আগামী ৯ জুন ২১২৩ সালে এর থেকে বড় চন্দ্রগ্রহণ হবে। সেই সময় পৃথিবী থেকে সবথেকে দূরে থাকবে চাঁদ। এর ফলে সাধারণ দিনের থেকে চাঁদের আকার একটু ছোট হয়ে যাবে।
চাঁদের এই ছোট হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে ‘মাইক্রো মুন’ বলা হয়। পৃথিবীর সব জায়গা থেকে এই চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায়নি। উত্তর ও দণি আমেরিকার মানুষ এই গ্রহণ দেখতে পারেনি। আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, ভারত,বাংলাদেশ,অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশ থেকে দেখা গেছে চাদের এই বিস্ময়কর দৃশ্য। সবচেয়ে ভালো দেখা যায় আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের কিছু এলাকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং সেন্ট্রাল এশিয়া থেকে।
এর আগে এত বেশিক্ষণ ধরে চন্দ্রগ্রহণ এই শতাব্দীতে কোনও দিন হয়নি। এর আগের দীর্ঘ চন্দ্রগ্রহণ হয় ২০১১ সালের ১৫ জুন । সেটা ১০০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর, জলবায়ু মহাশাখার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গতক্রার শুক্রবার রাত ১১ টা ১৩ মিনিট ০৬ সেকেন্ড গ্রহণটি শুরু হয়। শেষ রাত ২ টা ২১ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড কেন্দ্রীয় গ্রহণ ঘটে। গ্রহণটির সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ১.৬১৪। গ্রহণটির সর্বশেষ পর্যায় সমাপ্ত হয় ভোর ৫ টা ৩০ মিনিটে।
ঢাকার বিজ্ঞান জাদুঘর দর্শনার্থীদের জন্য চন্দ্রগ্রহণ দেখার আয়োজন করে। রাত সাড়ে ১০টা থেকে জাদুঘর উন্মুক্ত রাখা হয়। আয়োজন করা হয় প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শনী ও সেমিনারের।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীকে কেন্দ্র করে উপবৃত্তাকার (অনেকটা ডিমের মতো) কক্ষপথে পাক খায় চাঁদ। পৃথিবীকে এক বার পাক খেতে তার গড়ে সময় লাগে সাড়ে ২৭ দিন। এই সাড়ে ২৭ দিনের মধ্যে চাঁদ এক বার পৃথিবীর কাছে চলে আসে আর তার পরে দূরে চলে যায়। দূরত্বটা যখন সব থেকে কমে যায়, সেটাকে বলে ‘অনুভূ’ (এপিজে) অবস্থান। আর পৃথিবী ও চাঁদ যখন একে অন্যের থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে থাকে, সেই অবস্থানকে বলে ‘অপভূ’ (অ্যাপোজে) অবস্থান।
শুক্রবার সেই ‘অ্যাপোজে’-তেই ছিলো চাঁদ ও পৃথিবী। একই সরল রেখায় ছিলো চাঁদ, সূর্য আর পৃথিবী। চাঁদ আর পৃথিবী কারওই নিজের আলো নেই। সূর্যের আলোতেই তারা আলোকিত হয়। সূর্য আর চাঁদের মাঝে তাই পৃথিবী এসে পড়লে মুখ ঢেকে যায় চাঁদের। হয় চন্দ্রগ্রহণ। চেহারায় বড় কোনও বস্তুর সামনে কোনও বস্তু এসে পড়লে ছায়ার দু’টি এলাকা তৈরি হয়-প্রচ্ছায়া আর উপচ্ছায়া। সূর্যের আলো পৃথিবীর উপর পড়লে তেমনই একটি প্রচ্ছায়া কোণ তৈরি হয়। পৃথিবীকে অতিক্রম করতে করতে কোণের মাঝামাঝি অংশ দিয়ে চাঁদ অতিক্রম করলে তখন চাঁদের গতি মন্থর হয়ে যায়। পৃথিবীকে অতিক্রম করতে বেশি সময় লাগে। তাই দীর্ঘতম হয় এই চন্দ্রগ্রহণ।
বিবিসি বাংলা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ভাষ্য উদ্বৃতি করে জানায়, সূর্যের আলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছুঁয়ে ছড়িয়ে যায়, সেই আলো আবার পৃথিবীতে আসার পথে অন্য সব রঙ হারিয়ে লাল রঙটি এসে আমাদের চোখে পৌঁছায়, কারণ এই রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। আর এ কারণে চাঁদ অনেকটা ‘রক্তিম’ দেখায়, তাই এটাকে ‘ব্লাড মুন’ বলা হয়। এদিকে এই রক্তাক্ত চাঁদ নিয়ে বহু অলিক কাহিনী ছড়িয়ে আছে! বাইবেলে কেয়ামত এর অন্যতম আলামত হিসেবে বলা আছে, ‘সূর্য আলোহীন হয়ে পড়বে আর চাঁদ গাঢ রক্ত বর্ণ ধারণ করবে।
এছাড়া বিভিন্ন ডাকিনীতন্ত্রের ধর্মমতগুলো- যেমন উইকা বা আরাদিয়ার অনুসারীরা, যারা চন্দ্রদেবী ডায়নার পূজা করে থাকে তাদের জন্যে এই ব্লাড মুন বা রক্ত জোছনা খুব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার পালনের রাত। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই রাতে যারা জন্ম গ্রহণকরে তারা বিশেষ আধ্যাত্মিক মতার অধিকারী হয়। হিব্রু বাইবেলের ‘বুক অফ জোয়েল’-এর বর্ণনা থেকে ব্লাড মুন বা রক্তবর্ণ চাঁদ নিয়ে বিস্তর ভবিষ্যদ্বাণী প্রচলিত। তার মধ্যে বেশির ভাগটাই প্রলয় সংক্রান্ত।
তবে এর বাইরেও কিছু অন্য বিপর্যয়ের কথা বলে লোকবিশ্বাস। রক্ত চাঁদের দিন নাকি ভ্যাম্পায়াররা প্রবল সক্রিয় হয়ে ওঠে আর এদিন তারা নতুন জীবনীশক্তি লাভ করে। গ্রিকদের ধারণা ছিলো, সূর্যগ্রহণ হচ্ছে স্রষ্টার রাগ এবং আসন্ন মৃত্যু ও ধ্বংসের পূর্বাভাস। চীনের মানুষ মনে করতো, স্বর্গীয় ড্রাগন সূর্যকে গ্রাস করে নেওয়ার ফলে সূর্যগ্রহণ হয়। ভিয়েতনামের বাসিন্দাদের ধারণা, বিশাল আকারের একটি ব্যাঙ সূর্যকে গিলে ফেলার কারণে সূর্যগ্রহণ হয়।
ইনকা সভ্যতার লোকদের বিশ্বাস ছিল যে, একটি চিতাবাঘ চাঁদকে গ্রাস করার কারণে চন্দ্রগ্রহণ হয়। চাঁদের ওপর আক্রমণ শেষ হলে সে পৃথিবীতে নেমে এসে মানুষদের ওপর আক্রমণ করবে। তাই তারা চাঁদের দিকে বর্শা তাক করে কল্পিত এই চিতাবাঘকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করতো। এমনকি আশপাশের কুকুরদের গায়ে তারা আঘাত করতো, যাতে কুকুরের আর্তচিৎকারে ঐ চিতাবাঘ ভয় পেয়ে পালিয়ে যায় এবং পৃথিবীতে আর আক্রমণ না করে।
চন্দ্রগ্রহণকে জড়িয়ে নানা কুসংস্কার রয়েছে যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পুরোটাই কুসংস্কার এবং অলিক ধারণা। যেমন, গ্রহণের সময় ঘরের বাইরে বেরোতে নেই, খাবার থাকলে তা ফেলে দিতে হয়, অন্তঃসত্বা নারীদের খুবই সাবধানে থাকতে হয়। কিন্তু গ্রহণ হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক বিষয়। এর সঙ্গে শুভ বা অশুভয়ের কোনো পার্থক্য নেই। শনিবার আবারো স্বাভাবিক চাঁদ আকাশ আলো জোছনা ছড়াবে।
এদিকে ইসলাম ধর্মভীরুরা চন্দ্রগ্রহণকালে সালাতুর কুসুফ পড়েন। কারণ তাদের রাসুল (সা.) গ্রহনকালে সাহাবিদের নিয়ে কুসুফ নাজাম পড়তেন। কান্নাকাটি করতেন। আল্লাহর কাছে মাফ চাইতেন। এসময় নবী (সা.) এর চেহারা ভয়ে বিবর্ন হয়ে যেতো।