স্বাস্থ্য কণিকা: অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা হঠাৎ করে শুরু হয় এবং তা খুব মারাত্মক হয়। এ সময় শিশুরা খুব কান্নাকাটি করে। এ ধরনের ব্যথার উপসর্গ ও করণীয় সম্পর্কে আগে থেকে জানা থাকলে জটিলতা এড়ানো যায়। লিখেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আশরাফ উল হক কাজল
মানুষের বৃহদন্ত্রের সঙ্গে লাগানো কনিষ্ঠ আঙুলের মতো একটি সরু থলের নাম ‘অ্যাপেন্ডিক্স’। লম্বায় এটি দুই থেকে ২০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে, যা থাকে তলপেটের ডান দিকে। মানুষের এমনকি প্রাইমেট গোত্রের (শিম্পাঞ্জি, বানর, গরিলা ইত্যাদি) প্রজাতির মধ্যেও অ্যাপেন্ডিক্স রয়েছে। তবে বেশির ভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর অ্যাপেন্ডিক্স নেই। এই ছোট্ট থলেতে আকস্মিক প্রদাহ হলে দেখা দেয় অসহনীয় ব্যথা, যার নাম অ্যাপেন্ডিসাইটিস। শিশু, কিশোর, বৃদ্ধ—সবার ক্ষেত্রে এটা মারাত্মক হতে পারে।
যাদের হয়
আমেরিকায় প্রতিবছর হাজারে একজন শিশু অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্ত হয়। তবে বাংলাদেশে কত মানুষ এতে আক্রান্ত হয়, এর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। মানুষের আয়ুষ্কালে ৯ শতাংশ পুরুষ এবং সাত শতাংশ নারী এতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। শিশুদের মধ্যেও এই রোগের প্রবণতা রয়েছে। শিশু বলতে সাধারণত ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সকে বোঝায়। এর মধ্যে নবজাতক হলো জন্মের পর ২৮ দিন পর্যন্ত। এক বছর পর্যন্ত বয়সীরা ইনফ্যান্ট। তবে ১৮ বছরের নিচের বয়সী বা শিশুদের অ্যাপেন্ডিসাইটিসে আক্রান্তের আশঙ্কা এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয় ১১ থেকে ১২ বছর বয়সী শিশুদের।
ঝুঁকি
অ্যাপেন্ডিসাইটিস হলে দ্রুত রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করা উচিত। কারো অ্যাপেন্ডিসাইটিস হওয়ার পর সঠিক চিকিৎসা প্রয়োগ না করলে বা বিলম্বে চিকিৎসা করালে অনেক সময় তা ফেটে যেতে পারে, পুঁজ হতে পারে বা চাকার মতো হয়ে যেতে পারে। এই প্রতিক্রিয়াগুলো কিন্তু মারাত্মক, যাতে জীবনসংহার পর্যন্ত হতে পারে।
উপসর্গ
শিশুরা সমস্যাগুলো ঠিকমতো বলতে পারে না, আবার অনেক মা-বাবাও বুঝতে পারেন না তাঁদের সন্তানের অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে কি না। এই ব্যথার অবশ্য কিছু উপসর্গ বা লক্ষণ থাকে। যেমন—
♦ প্রথম ও প্রধান লক্ষণ পেট ব্যথা। এই ব্যথা থেমে থেমে ওঠে, পরে সেটি তীব্র ও হালকা—দুই রকমেরই হতে পারে।
♦ প্রাথমিকভাবে নাভির চারদিকে হালকা ব্যথা হয়। এরপর ডান দিকে তলপেটে ব্যথা (যেখানে অ্যাপেন্ডিস অবস্থিত) ছড়িয়ে যায়।
♦ ডান তলপেটে টেন্ডারনেসের সঙ্গে সঙ্গে ওই স্থানে গার্ডিং (শক্ত অনুভূত হওয়া) পাওয়া যায়, কাশি দিলে ওই স্থানে ব্যথা হতে পারে। তবে কখনো কখনো অ্যাপেন্ডিসাইটিস হলেও ডান তলপেটে টেন্ডারনেস বা গার্ডিং থাকে না।
♦ নাড়ির গতি দ্রুত হওয়া, ক্ষুধামান্দ্য, মুখে দুর্গন্ধ, জিহ্বায় সাদা আবরণ ইত্যাদি।
♦ অনেক সময় পেট ব্যথা, বমি, জ্বর, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। এসব লক্ষণ প্রকাশ পেলে তা একুইট অ্যাপেন্ডিসাইটিস হতে পারে। একুইট গ্যাস্ট্রোএন্টেরিটিটিস বা একুইট অ্যাপেন্ডিসাইটিসের উপসর্গ অনেক সময় একই রকম হয়।
♦ পেট খারাপের ব্যথা নাভির চারদিকে হলেও তা কিন্তু স্থান পরিবর্তন করে না।
♦ প্রস্রাবে ইনফেকশন হলেও পেটে ব্যথা বা অ্যাপেন্ডিসাইটিস মনে হতে পারে।
♦ কোষ্ঠকাঠিন্য হয়েও পেট ব্যথা হতে পারে।
♦ শরীরের ছোট ছোট গ্ল্যান্ড (লিজেন্ডারি লিম্ফ নোড) বড় হতে পারে। ভাইরাল ইনফেকশন বা ইনফ্লুয়েঞ্জা হলেও এই গ্ল্যান্ডগুলো বড় হয়ে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের মতো ব্যথা হতে পারে।
♦ প্রাথমিক পর্যায়ে রোগী কিছু খেতে চাইবে না।
♦ বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। জোর করে খাওয়াতে গেলেও বমি হতে পারে।
♦ হালকা জ্বর হয়, যা ৯৯-১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
পরীক্ষা
শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যাপেন্ডিসাইটিস নির্ণয় করা দুরূহ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দূরদৃষ্টি বা পর্যবেক্ষণে পারদর্শিতা। প্রথমে রোগের ইতিহাস জানতে হয়। অনেক সময় পেটে কোনো ব্যথা হয় না বা সামান্য ব্যথা হয়। এ পরিস্থিতিতে রোগ নির্ণয় বিলম্বিত হতে পারে। তবে উপসর্গ দেখে যদি অ্যাপেন্ডিসাইটিস মনে না হয়, তাহলে রক্ত পরীক্ষা, পেটের এক্স-রে ও আলট্রাসনোগ্রাম করালে ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে বোঝা যায় তা অ্যাপেন্ডিসাইটিস এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়।
চিকিৎসা
অ্যাপেন্ডিসাইটিস বলে সন্দেহ হলে সে ক্ষেত্রে অতি দ্রুত শল্যচিকিৎসা করাতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যদি নিশ্চিত হওয়া যায়, এটা অ্যাপেন্ডিসাইটিস, তখন তা অ্যাপেনডিক্টমি করা হয় বা অ্যাপেন্ডিসটা অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয়। এটি দুই পদ্ধতিতে করা যায়। প্রথমত, সনাতন পদ্ধতিতে পেট কেটে অ্যাপেন্ডিক্স ফেলে দেওয়া। দ্বিতীয়ত, পেটে ছিদ্র করে ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমেও তা অপসারণ করা।
অপারেশনের বিকল্প
অনেক সময় অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানের লেখাপড়ার চাপ বা অন্য বিশেষ কারণে অপারেশন না করিয়ে বিকল্প চিকিৎসার কথা আমাদের কাছে জানতে চান। আসলে অপারেশন না করে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের চিকিৎসা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। শিশুটির ক্ষেত্রে ঝুঁকি তো বটেই, অনেক সময় চিকিৎসকের জন্যও এই সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন হয়। তবে কোনো কোনো অ্যাপেন্ডিসাইটিস অ্যান্টিবায়োটিকে রেসপন্স করে। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করে যদি ভালো হয়ে যায়, তখন এমনো হতে পারে যে সারা জীবন তার আর অ্যাপেন্ডিসাইটিসের কোনো ব্যথাই হলো না। এটা অবশ্য রেয়ার বা খুব কম ক্ষেত্রে ঘটতে পারে।
সব পেট ব্যথাই অ্যাপেন্ডিসাইটিস নয়
শিশুদের পেট ব্যথা খুব সাধারণ একটি সমস্যা। তবে বেশির ভাগ পেট ব্যথাই অ্যাপেন্ডিসাইটিস নয়। সাধারণ পেট ব্যথা বা গ্যাস্ট্রোএন্টেরিটিটিস সাধারণত এক দিন বা দুই দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। কিন্তু শিশুর অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা হলে তা কিন্তু এক বা দুই দিনের মধ্যে সারে না। চিকিৎসা না করালে এতে বরং জটিলতা বাড়ে।
অ্যাপেন্ডিক্স কতটা দরকারি
অনেকে বলছেন, অ্যাপেন্ডিক্স কোনো দরকারি কিছু নয়; বরং বাড়তি বা অতিরিক্ত অঙ্গ। আবার অনেকে বলছেন, এটি শরীরের জন্য উপকারী। আসলে অ্যাপেন্ডিক্স আদৌ আমাদের কোনো উপকারে আসতে পারে কি না—এ বিষয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের মিডওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গত বছর বলেছেন, যেসব প্রাণীর দেহে অ্যাপেন্ডিক্স আছে, তাদের অন্ত্রে উচ্চহারে লিম্ফয়েড টিস্যু জমা হয়, যা রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই টিস্যু কিছু উপকারী ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনে উদ্দীপনা জোগাতে পারে। ফলে ডায়রিয়ার সময় ওই ব্যাকটেরিয়াগুলো পাকস্থলী থেকে বের হয়ে গেলেও আবার অ্যাপেন্ডিক্স গ্রন্থি থেকে সেগুলো বেড়ে ওঠে। তাঁরা এ-ও বলেছেন, যাদের দেহ থেকে অ্যাপেন্ডিক্স অপসারণ করা হয়, তারা কোনো রোগে আক্রান্ত হলে সুস্থ হতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। কারণ উপকারী ব্যাকটেরিয়ার আশ্রয়স্থল হিসেবে অ্যাপেন্ডিক্স গ্রন্থিটি না থাকায় তাদের পেট থেকে সব উপকারী ব্যাকটেরিয়া বের হয়ে পড়ে।
তবে অ্যাপেন্ডিসাইটিস রোগ হওয়ার কারণ কী, তা এখনো পরিষ্কার জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, যখন এর প্রবেশপথটি রুদ্ধ হয়ে যায়, তখন এ রোগ দেখা দেয়।