দেশের খবর: রাজধানীতে বিকল্প গণপরিবহনের ব্যবস্থা না করেই হঠাৎ লেগুনা বন্ধ ঘোষণা করার পর পুলিশই আবার চলতে দিচ্ছে যানবাহনটি। ওই ঘোষণার আগে লেগুনার বিকল্প পরিবহন কী হতে পারে তা নিয়ে ডিএমপি অংশীজনদের নিয়ে কোনো বৈঠকও করেনি। শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের চাপে কৃতিত্ব দেখাতেই ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে লেগুনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল বলে অভিযোগ আছে। তাতে রাজধানীর ১৫৯টি রুটে প্রায় ছয় হাজার লেগুনা চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাতে যাত্রীরা বিপাকে পড়ে। জনদুর্ভোগের বিষয়টি সামনে এনে ডিএমপি তিন দিন ধরে রাজধানীর শতাধিক রুটে আবার লেগুনা চলতে দিচ্ছে। পুলিশের দাবি, প্রধান সড়ক ছাড়া সংযোগ সড়কে লেগুনা চলাচলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। গতকাল শনিবার রাজধানীর গুলিস্তান, পান্থপথ, ফার্মগেটসহ বিভিন্ন স্থানে প্রধান সড়কেও দাপিয়ে লেগুনা চলতে দেখা গেছে।
লেগুনা হঠাৎ বন্ধ করে আবার চালু করার কারণ খুঁজতে গিয়ে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ‘নির্বাচনের আগে ভোট কমে যাবে’—এমন কথা বলে রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি, পরিবহন নেতা ও পুলিশের চাঁদাবাজি টিকিয়ে রাখতেই মূলত লেগুনা চালু করা হয়েছে। পরিবহন মালিক, চালক, লাইনম্যানসহ বিভিন্ন সুত্রে জানা যায়, বিভিন্ন হারে প্রতিটি লেগুনা থেকে দিনে চাঁদা তোলা হচ্ছে গড়ে ৭০০ টাকা। বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে প্রায় ২০০ রুটে ছয় হাজার লেগুনা থেকে দিনে চাঁদা তোলা হয়ে থাকে প্রায় ৪২ লাখ টাকা। এই চাঁদা যায় মালিক সমিতি, ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের নেতা এবং শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের হাতে। এর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় পুলিশকেও দিতে হয় গোপন চাঁদা। এটি মূলত মালিক সমিতির মাধ্যমে দেওয়া হয়ে থাকে।
চাঁদার বিষয়ে বাংলাদেশ অটোরিকশা অটো টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক বলেন, ‘পরিবহন ব্যয় পরিচালনার জন্য চাঁদা নেওয়ার রীতি রয়েছে। আমাদের পায়ে পায়ে চলায় দোষ আছে। তাই পুলিশও সুবিধা নেয় বলে অভিযোগ আছে। তবে এই খাতে শৃঙ্খলা আনতে বর্তমান পুলিশ কমিশনার আন্তরিক।’
জানা গেছে, লেগুনা বন্ধ থাকলে চাঁদার উৎসও বন্ধ থাকে। ফলে তা চালু করতে উঠেপড়ে লাগে মালিক ও শ্রমিক নেতাদের বড় একটি অংশ। ওই নেতারা অজুহাত দেখান যে নির্বাচন সামনে রেখে গণপরিবহনের ব্যাপক সংকটের এই সময়ে লেগুনা বন্ধ রাখলে জনদুর্ভোগ তৈরি হবে এবং ভোট কমে যেতে পারে। এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা লেগুনা আবার চালু করার জন্য চাপ দেন পুলিশ প্রশাসনকে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আবার চালু করা হয়েছে লেগুনা।
জানা গেছে, লেগুনা বন্ধ ঘোষণার পর পুলিশ বিকল্প যানবাহন কী হতে পারে তা নিয়েও পথ বের করতে পারেনি। গত ১০ সেপ্টেম্বর ডিএমপি কমিশনারের কার্যালয়ে দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বৈধ কাগজপত্র আছে এমন লেগুনা সীমিতভাবে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার কথা মালিক ও নেতাদের জানানো হয়।
ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া বাংলাদেশ অটোরিকশা অটো টেম্পো পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক বলেন, ‘যেদিন লেগুনা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল সেদিন রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ধানমণ্ডির বাসায় দুই হাজার চালক ও মালিক উপস্থিত হই। সর্বশেষ আমরা ১০ সেপ্টেম্বর মহানগর পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে বৈঠক করি। ১৫ জন পরিবহন মালিক ও নেতা বৈঠকে ছিলেন। ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার ও দুই যুগ্ম কমিশনার বৈঠকে ছিলেন। এর পর থেকে ধীরে ধীরে চালু করা হয় লেগুনা।
পুলিশ ও পরিবহন মালিক সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, গাবতলী-শ্যামলী-মহাখালী, মিরপুর-১-শ্যামলী-মহাখালী, মোহাম্মদপুর-মহাখালী-গুলশান, ফার্মগেট-মানিক মিয়া এভিনিউ-মোহাম্মদপুর এবং ফার্মগেট-মানিক মিয়া এভিনিউ-জিগাতলা রুট ছাড়া অন্যান্য রুটে বৈধ কাগজপত্র আছে—এমন লেগুনা চলাচলে পুলিশের ইঙ্গিত পান মালিকরা।
গতকাল আগারগাঁও বেতার ভবনের সামনে থেকে ৬০ ফুট সড়ক ধরে মিরপুর ২ নম্বর সড়কে চলতে দেখা গেছে লেগুনা। বিকেলে ৬০ ফুট সড়কে মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহন, ঢাকা ইন্দিরা পরিবহনের লেগুনায় অবিরত যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছিল। মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহনের একটি লেগুনার (ঢাকা মেট্রো-ছ-১১-৩৭২১) চালক মো. আনোয়ার হোসেন জানান, প্রতিদিন ১৭টি ট্রিপ হচ্ছে। মালিককে দিনে এক হাজার ২০০ টাকা দিতে হয়। এর বাইরে মালিক সমিতিকে দিনে ৪০০ টাকা এবং পাকা মসজিদের কাছে দলের এক নেতাকে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে।
জানা যায়, পাকা মসজিদের কাছের ওই নেতার নাম মো. রনি। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে প্রতি লেগুনা থেকে ১০০ টাকা হারে চাঁদা তোলেন।
মহানগর ডিজিটাল সিটি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মোস্তফা জানান, তাঁদের কম্পানির ২০টি লেগুনার রুট পারমিট আছে। এগুলোই চলছে ৬০ ফুট সড়কে। এর বাইরে প্রধান সড়কে কোনো লেগুনা চলছে না। তিনি জানান, ঢাকা ইন্দিরা পরিবহনের লেগুনা প্রধান সড়কে চলাচল করছে। তবে একটু পর দেখা যায়, ডিজিটাল পরিবহনের লেগুনাও আগারগাঁওয়ের প্রধান সড়কে চলছে।
ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেড কম্পানির লাইনম্যান মো. আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমাদের ২০টি লেগুনা ফার্মগেট থেকে মিরপুরের বড় বাগ পর্যন্ত চলছে। কেন চলছে সেটা আমি বলতে পারব না। কম্পানির লোকেরা বলতে পারবে।’
৬০ ফুট সড়কের আগারগাঁও রেডিও সেন্টারের কাছের মোড় থেকে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেডের একটি লেগুনায় (ঢাকা মেট্রো-ছ-১১-৩৮৭৫) ফার্মগেটের দিকে যেতে যেতে চালক মো. শাহীন বললেন, ‘দুই দিন হলো রাস্তায় লেগুনা চালাচ্ছি। লাইসেন্স আছে। রেডিও সেন্টার থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। আগে ৬৫টি লেগুনা এই রুটে চলত। এখন চলছে ২০টি। আমার পরিচিত একজন মালিক তাঁর লেগুনা বন্ধ ঘোষণার আগে বেচতে চেয়েছিলেন। দাম উঠেছিল দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। এখন দাম উঠছে ৯০ হাজার টাকা।’ শাহীন জানান, প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৭০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এর মধ্যে ফার্মগেটে ৬০০ টাকা এবং পাকা মসজিদের কাছে এক নেতার নামে ১০০ টাকা দিতে হয়। ৬০০ টাকা দিতে হয় মালিক সমিতির নামে।
এ বিষয়ে ঢাকা ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেড কম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন চুন্নু বলেন, ‘আমরা চাঁদা তুলি না। যা তুলি তা পরিবহন পরিচালনা ব্যয়।’
ফার্মগেট থেকে নিউ মার্কেট রুটে চলাচল করতে দেখা যায় একের পর এক লেগুনা। এই রুটে আনন্দ পরিবহনের লেগুনা আগে চলত ৫০টি, এখন চলছে ২০টি। আনন্দ পরিবহন মালিক সমিতির সহসভাপতি মো. নুরুল হক লেগুনার চলাচল দেখতে দেখতেই বলেন, ‘লেগুনা বন্ধ ঘোষণার পর আমরা গত রবিবারের আগের রবিবার ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের অতিরিক্ত ও যুগ্ম কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছি। বৈঠকে আমরা বলেছি, লেগুনা নছিমন ও করিমনের মতো বিপজ্জনক নয়। এগুলোর রুট পারমিট ও ফিটনেস সনদ বিআরটিএ থেকে দেওয়া হয়েছে। বৈঠকের পর আমাদের বলা হয়েছে, বৈধ কাগজপত্র আছে—এমন লেগুনা সংযোগ সড়কে বা ফিডার সড়কে চলতে পারবে। এর পর থেকে আমরা লেগুনা রাস্তায় নামিয়েছি।’
নুরুল হক আরো বলেন, ‘পুলিশকে লাইন চালুর জন্য কোনো অর্থ দেওয়া হয় কি না তা দেখার জন্য গোয়েন্দা নজরদারি করা হবে বলে কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের বলেছেন।’
ফার্মগেটে লেগুনার স্ট্যান্ডে ওই কম্পানির একাধিক চালক জানান, প্রতিদিন তাঁদের মালিক সমিতি ও রাস্তার খরচ দিতে হয় ৭০০ টাকা। তবে বিষয়টি অস্বীকার করেন মো. নুরুল হক। তিনি জানান, তাঁর নিজের দুটি লেগুনা আছে। এই কম্পানির ফার্মগেট অংশের সুপারভাইজার মো. জালাল বলেন, ফার্মগেট থেকে নিউ মার্কেট রুটের দূরত্ব চার কিলোমিটারের মধ্যে শুধু পান্থপথ মোড় অংশ পড়েছে প্রধান সড়কে। বেশির ভাগই অপ্রধান সড়ক।
ইন্দিরা পরিবহন লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেন চুন্নু বলেন, ‘আমরা এ ধরনের চাঁদা দিতে চাই না। এ জন্য অতীতে বারবার প্রতিবাদ করেছি। মহাখালীতে এই চাঁদাবাজি হয় গাড়ি চললেই।’ পাকা মসজিদের কাছে ১০০ টাকা চাঁদা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আগে তো তা বন্ধ করেছিলাম। এখন নতুন করে নিচ্ছে কি না খোঁজ নেব।’
মহাসড়কে লেগুনা চলাচলে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় গত ২৭ আগস্ট সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভায় লেগুনা চলাচলে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ৪ সেপ্টেম্বর ডিএমপি রাজধানীতেও লেগুনা বন্ধ করার ঘোষণা দেয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় লেগুনা চালু করতেই হতো। কারণ বিকল্প যানবাহনের ব্যবস্থা নেই। বাসসংকট তীব্র হওয়ায় বিভিন্ন রুটে লেগুনা ভরসা হয়ে উঠেছে যাত্রীদের। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘অংশীজনদের মতামত না নিয়ে এভাবে হুট করে আগেও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে তা বেশিদিন টেকেনি। এবারও টিকল না।’
ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম সালেহউদ্দিন আহমদ বলেন, ঢাকায় বড় বাস নামাতে হবে। এ জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দুই বছর সময় লাগবে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে। ফলে এই দুই বছর লেগুনার ওপর ভরসা আরো বাড়বে। তবে আগামী বছর ডিসেম্বরে উত্তরা-আগারগাঁও রুটে মেট্রো রেল চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
একই স্থানে চার দফায় চাঁদাবাজি : একই সংগঠনের নামে মহাখালী ফ্লাইওভারের নিচে একেকটি লেগুনা থেকে দিনে চার দফায় ৬০ টাকা করে ২৪০ টাকা চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ আছে। লেগুনাচালকরা জানান, ঢাকা জেলা হালকা যানবাহন সড়ক পরিবহন ইউনিয়নের (ঢাকা- ২১২৪) বনানী, তেজগাঁও, শিল্পাঞ্চল ও কাফরুল থানা কমিটির নামে এই চাঁদা নেওয়া হয়। ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান গত রাতে ফোনে বলেন, ‘আমাদের সংগঠন কোনো অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত নয়। আমাদের সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে দিনে ২০ টাকা নেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এ জন্য ছাপানো রসিদও আছে। কিন্তু মহাখালীতে যে চাঁদাবাজি হচ্ছে তা আমাদের কাছে কেউ অভিযোগ করেনি। তাহলে আমরা বিষয়টির তদন্ত করে দেখতাম।’
জানা গেছে, গাবতলী, সিপাহীবাগ, গুলিস্তান, জিগাতলা, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে এভাবে বিভিন্ন সংগঠনের নামে চাঁদা তোলা হয়।
ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম কমশিনার মফিজ উদ্দিন আহমেদ গত রাতে বলেন, ‘আমরা প্রধান সড়কে লেগুনা চালাতে বারণ করেছি।’ লেগুনায় চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কিছু অনিয়ম তো আছে। ধীরে ধীরে তা নিয়মে আনতে হবে। আমাদের নিয়মিত তদারকি আছে।’
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে ঢাকা থেকে তিন চাকার ৪০ হাজার অটো টেম্পো তুলে দিয়ে বিকল্প হিসেবে নামানো হয়েছিল কমসংখ্যক সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও লেগুনা। বিআরটিএর গত জুলাই মাসের পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে নিবন্ধিত সিএনজি অটোরিকশা আছে প্রায় ১৩ হাজার। এগুলোর আয়ুও শেষ হয়ে গেছে।