দেশের খবর: যাকে ঘিরে এক বছর আগে বাংলাদেশের বিচারঙ্গনে রীতিমত ভূমিকম্প ঘটে গিয়েছিল, সেই বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বিদেশে বসে একটি বই লিখেছেন, যেখানে দেশত্যাগ ও পদত্যাগ নিয়ে এসেছে বেশ কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য।
‘এ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’ শিরোনামে আত্মজীবনীমূলক এই বইয়ে বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধান বিচারপতি দাবি করেছেন, তিনি দেশ ছেড়েছেন ‘হুমকির মুখে’; একই কারণে বিদেশ থেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন।
আর সেই হুমকি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা– ডিজিএফআইয়ের তরফ থেকে এসেছিল বলে দাবি করা হয়েছে বইটিতে।
বিচারপতি সিনহার অভিযোগের বিষয়ে সরকারের মন্ত্রীদের কারও বক্তব্য তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। আর ডিজিএফআই বলেছে, কাওকে হুমকি ধামকি দেওয়ার মত কাজ তারা কখনোই করে না।
৬১০ পৃষ্ঠার এই বইটি অ্যামাজনের কিন্ডেল সংস্করণে বিক্রি হচ্ছে। বইয়ের কিছু অংশ অ্যামাজনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
বিচারপতি সিনহা ভূমিকায় লিখেছেন, ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশের বিচারাঙ্গনে যুক্ত থাকার সুবাদে এর রূপান্তর এবং বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঘটনাগুলো দেখার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। সিলেটের নিম্ন আদালতের একজন আইনজীবী হিসেবে শুরু করে বাংলাদেশের বিচারালয়ের শীর্ষ অবস্থানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য হয়েছে তার।
“কিন্তু ২০১৭ সালে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে ঐতিহাসিক এক রায় দেওয়ার পর বর্তমান সরকার আমাকে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাসনে যেতে বাধ্য করে।”
বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়াকে ওই রায়ের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট। আর তারপর যা ঘটেছে, তাকে বিচারপতি সিনহা বর্ণনা করেছেন ‘নজিরবিহীন ঘটনা’ হিসেবে।পৌন তিন বছর প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করা বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি। কিন্তু কার্যকাল শেষ হওয়ার ৮১ দিন আগেই তাকে ‘নজিরবিহীন’ ওই পরিস্থিতির মধ্যে পদত্যাগ করতে হয়।
বাংলাদেশে আর কখনও কোনো প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে এত আলোচনা হয়নি; আর কোনো প্রধান বিচারপতিকে পদত্যাগও করতে হয়নি।
অবসরের পর রায় লেখা নিয়ে অবসরপ্রাপ্ত সহকর্মীর সঙ্গে বাদানুবাদ, বিচার বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করার অভিযোগ আনা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট প্রকাশ নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে উত্তেজনা- এরকম বহু ঘটনায় বিচারপতি সিনহা বহুবার সংবাদ শিরোনামে এসেছেন।
সর্বশেষ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং কিছু পর্যবেক্ষণের কারণে ক্ষমতাসীনদের তোপের মুখে ২০১৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে তিনি ছুটিতে যান। সরকারের পক্ষ থেকে অসুস্থতার কথা বলা হলেও ১৩ অক্টেবর তিনি রীতিমত বোমা ফাটিয়ে বিদেশে চলে যান।
বিচারপতি সিনহা বলে যান, তিনি অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’। তার ছুটির মেয়াদ শেষে ১১ নভেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিচারপতি সিনহা পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পদত্যাগ করার পর বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, আর্থিক অনিয়ম ও নৈতিক স্খলনসহ সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগ ওঠার কথা সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বলা হয়, ওইসব অভিযোগের কারণে আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা আর প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বসে মামলা নিষ্পত্তিতে রাজি নন। সেসব অভিযোগ নিয়ে দুদক পরে অনুসন্ধানও শুরু করে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সে সময় বলেন, একজন বিচারপতির মাধ্যমে দেশে জুডিশিয়াল ক্যু করার চেষ্টা হয়েছিল। আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, বিচারকদের নিয়ন্ত্রণে সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে, শৃঙ্খলা বিধির নামে তা কেড়ে নিতে চেয়েছিলেন বিচারপতি সিনহা।
বিচারপতি সিনহার পর ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে আসেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সময়ে বিচারকদের চাকরিবিধির গেজেট নিয়ে সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের টানাপড়েনের অবসান ঘটে।
উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নেওয়া অবৈধ ঘোষণার যে রায় নিয়ে সঙ্কট জটিল মাত্রা পেয়েছিল, সেই রায় পুনর্বিবেচনার জন্যও সরকার আবেদন করে।
অবশ্য সরকার সৈয়দ মাহমুদ হোসেনকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিলে আপিল বিভাগের তখনকার জ্যেষ্ঠতম বিচারক ওয়াহহাব মিঞাও চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে বিদায় নেন।
‘দুর্ভাগ্যজনক, নজিরবিহীন
বিচারপতি সিনহার বইয়ের ভূমিকাসহ ১০টি অধ্যায় অ্যামাজানের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
আইন পেশায় এস কে সিনহার টিকে থাকার সংগ্রাম, নানা অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশের বিচার বিভাগের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার ‘অবক্ষয়’, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও বাংলাদেশের ‘শিশু গণতন্ত্রের’ অবস্থা, পুলিশের ‘বাড়াবাড়ি’, জরুরি অবস্থার প্রভাব এবং জরুরি অবস্থার প্রভাব, এবং ‘ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডিজিএফআইয়ের অর্থ আদায়ের’ বিষয়ে আলোকপাত করার কথা বলা হয়েছে ভূমিকায়।
শৈশব থেকে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনাল নিয়েও এ বইয়ে লিখেছেন বিচারপতি সিনহা।
বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির পদে থাকা অবস্থায় কোন পরিস্থিতিতে সরকারের সঙ্গে বিরোধ তৈরি হয়েছিল, কোন পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, আর কেন বিদেশে থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল- সে বিষয়ে নিজের ভাষ্য এ বইয়ে তুলে ধরেছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি।
তিনি লিখেছেন, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে যখন বিচারক অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে দেওয়া হল তখন থেকেই টানাপড়েনের শুরু।
২০১৬ বছরের ৫ মে হাই কোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পরের বছর জুলাইয়ে আপিল বিভাগের রায়ে তা বাহল থাকলে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় পড়েন বিচারপতি সিনহা।
পরের মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে তাতে বিচারপতি সিনহার ৪০০ পৃষ্ঠার পর্যবেক্ষণ দেখে শুরু হয় ব্যাপক বিতর্ক। সাবেক প্রধান বিচারপতি বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ওই রায়কে ‘ভ্রমাত্মক’ বলেন।
ওই পর্যবেক্ষণে সংসদ ও সরকার এবং জাতির জনককে খাটো করা হয়েছে অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলে আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা; অন্যদিকে বিএনপি প্রধান বিচারপতির পক্ষে দাঁড়ায়।
সেই সময়ের কথা তুলে ধরে বিচারপতি সিনহা তার বইয়ে লিখেছেন, “আপিল বিভাগের রায়ের পর ১৩ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাতিলের জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হয়। পার্লামেন্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী, তার দলের লোকজন এবং সরকারের মন্ত্রীরা আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আইনমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ আনতে থাকেন।”
বিচারপতি সিনহা অভিযোগ করেছেন, ওই সময় তাকে তার বাসভবনে আটকে থাকতে হয়। আইনজীবী ও বিচারপতিদেরকে তার সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হচ্ছিল না। সংবাদমাধ্যমকে বলা হচ্ছিল- তিনি অসুস্থ, ছুটির আবেদন করেছেন।
“কয়েকজন মন্ত্রী বলছিলেন যে, আমি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাব। ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর আমি যখন দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম, একটি বিবৃতি দিয়ে আমি বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করলাম যে আমি অসুস্থ নই, চিরতরে দেশ ছেড়েও যাচ্ছি না।
“আমি আশা করছিলাম, আদালতে আমার অনুপস্থিতি আর আদালতের নিয়মিত অবকাশের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা থিতিয়ে আসার সুযোগ পাবে এবং সুবিবেচনার উদয় হবে, সরকার হয়ত ওই রায়ের মর্ম বুঝতে পারবে, তারা বুঝবে যে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা রাষ্ট্র ও দেশের জন্যই দরকার।
“শেষ পর্যন্ত আমার পরিবার আর স্বজনরা যখন দেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যাকে বলা হয় ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স, তাদের হুমকির মুখে পড়ল, তখন আমি বিদেশ থেকেই পদত্যাগপত্র জমা দিই।”
বিচারপতি সিনহার অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে ডিজিএফআইয়ের পিআরএমসি বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভীর মাজহার সিদ্দিকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বইটি তারা এখনো হাতে পাননি, সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
“তবে স্পষ্ট কথা হল, ডিজিএফআই কখনো কোনো ব্যক্তিকে হুমকি দেয় না বা এ ধরনের কোনো কাজও করে না।”
বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছে বিবিসি বাংলা বিভাগ। বুধবার রাতে বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান প্রবাহে বিচারপতি সিনহা ওই সময়ের পরিস্থিতি এবং তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়েও কথা বলেন।
ওই সাক্ষাৎকারের অডিও বিবিসি বাংলার ফেইসবুক পেইজেও দেওয়া হয়েছে।