নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশের সংবিধান চিন্তা ও মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে। সংবিধান বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে যা ইচ্ছা তাই লিখলাম। যা খুশী তাই প্রকাশ করলাম। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায় তা হলো আইন ও নৈতিকতার মাপে সিদ্ধ এবং রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সমুন্নত রেখে গঠনমূলক মত প্রকাশ। আর এর ব্যতিক্রম কোনোভাবেই মিডিয়ার স্বাধীনতা হিসাবে গন্য হবে না।
বৃহস্পতিবার সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে নিউজ নেটওয়ার্ক আয়োজিত প্রশিক্ষণ কর্মশালার সমাপনী অধিবেশনে এ কথা বলেন আলোচকরা। তারা বলেন আমরা স্বাধীনতা চাই , তবে তা বলগাহীন নয়। এ প্রসঙ্গে তারা সংবাদ লিখন ও প্রকাশে কারও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন এর বিপরীত হলে তা মানহানির পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এ জন্য সংবাদ লিখনে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বনের প্রয়োজন রয়েছে।
নিউজ নেটওয়ার্কের সম্পাদক শহীদুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোজাম্মেল হোসেন বকুল ওরফে সাজ্জাদ বকুল, সাতক্ষীরা জেলা সমন্বয়কারী ভয়েস অব সাতক্ষীরার সম্পাদক এম কামরুজ্জামান ও মনিটরিং অফিসার শ্যামল সিংহ রায় ।
স্থানীয় পত্রিকায় স্থানীয় খবরের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে তা প্রকাশ করতে হবে এমন মন্তব্য করে আলোচকরা বলেন এ জন্য পুরো ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা এবং তাদের কল্যাণে প্রতিটি সংবাদ হাউসের উচিত কল্যাণ তহবিল গড়ে তোলা। কোনো উসকানিমূলক খবর নয়, কারও অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করার ওপরও খবর নয় জানিয়ে তারা বলেন সব সংবাদের ক্ষেত্রে বিপরীত অংশের মন্তব্য নিতে হবে। তারা কোনো মন্তব্য করতে না চাইলে কিংবা তাকে না পাওয়া গেলে সে বিষয়টিও পত্রিকায় তুলে ধরতে হবে বলে মন্তব্য করেন তারা।
আলোচনায় উঠে আসে সংবাদ লিখন ও পরিবেশনের সময় বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার প্রসঙ্গ। এসব ডিভাইসের ব্যবহার যথাযথ না হলে তা বুমেরাং হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্যের হাতে পড়লে তিনি তার অসদুদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ওই ডিভাইস ব্যবহার করে সাংবাদিকের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করতে পারেন। হ্যাকিংয়ের কবল থেকে নিজের সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ভাবতে হবে। নিউজের যথাযথ সূত্র সুরক্ষা , নিউজ লিখবার সময় যাচাই বাছাই, নিজেই বিচারক হয়ে রায় না দেওয়া এসব বিষয়ের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হলে সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিক মানহানির মতো মামলা এড়াতে পারবেন। অসহায় মানুষের পাশে সাংবাদিক দাঁড়াবেন এটাই স্বাভাবিক উল্লেখ করে তারা বলেন মানুষ এখনও মিডিয়ার ওপর আস্থাশীল ।
সংবাদপত্রের ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচকরা বলেন ১৭৯৯ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েরসলির সময়কালে সংবাদপত্র রেগুলেশন প্রণীত হয়। এ সময় থেকে প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকরের নাম লেখা শুরু হয়। এর পর ১৮২৩ সালে সংবাদপত্রের লাইসেন্স প্রদান চালু হয় । ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত তা বহাল থাকার পর ১৮৫৭ তে তা ফের চালু হয়। ১৮৬০ সালে পেনাল কোড এবং ১৮৭০ সালে মানহানির সাথে যুক্ত হয় রাষ্ট্রদ্রোহ। ১৮৯৮ সালে সংবাদপত্রে শ্রেণি শত্রুতার বিচারের বিধান চালু করা হয়। ১৮৬৭ সালে প্রেস এন্ড রেজিস্ট্রেশন , ১৮৭৮ সালে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট এবং ১৯৯৮ সালে ক্রিমিন্যাল প্রসিডিউর বা ফৌজদারি কার্যবিধি চালু হয়। ১৯০৮ সালে নিউজ পেপার ইনসাইটমেন্ট অফেন্স অ্যাক্ট এবং ১৯১০ সালে প্রেস অ্যাক্ট ও ১৯২২ সালে প্রণীত হয় প্রেস এন্ড পাবলিকেশনস অ্যাক্ট। এর পর ১৯২৩ সালে অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট চালু হয়। বর্তমানে এর মধ্যে রয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট । ১৯৭৩ সালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ডিক্লারেশন অ্যাক্ট এবং ১৯৭৪ সালে নিউজ পেপার এমপ্লয়ীজ আইন চালু হয়। একই সালে বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিষয়টি সংযুক্ত হয়।
আলোচনায় অতিথি বক্তারা আরও বলেন সংবাদ মাধ্যম ও সংবাদকর্মীদের সুরক্ষায় আরও কৌশলী হতে হবে। বর্তমানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তা সংশোধনের যে দাবি নিয়ে সম্পাদকরা মাঠে নেমেছেন তাকে স্বাগত জানিয়ে বলা হয় সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকের স্বাধীনতা না থাকলে দেশে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটে না। এমনকি সুশাসনও নিশ্চিত হয় না।
প্রশিক্ষণ কর্মশালায় আরও অংশ নেন দৈনিক কালের চিত্র সম্পাদক অধ্যক্ষ আবু আহমেদ, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভির সাংবাদিক সুভাষ চৌধুরী, দৈনিক দক্ষিণের মশাল সম্পাদক অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহি, দৈনিক পত্রদূতের উপদেষ্টা সম্পাদক অধ্যাপক আনিসুর রহিম, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবদুল বারী, দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক লায়লা পারভিন সেঁজুতি, ডেইলি সাতক্ষীরার সম্পাদক হাফিজুর রহমান মাসুম, দৈনিক দৃষ্টিপাত এর নির্বাহী সম্পাদক আবু তালেব মোল্লা , সাপ্তাহিক সূর্যের আলো পত্রিকার সম্পাদক আব্দুল ওয়ারেশ খান চৌধুরী পল্টু, দৈনিক সুপ্রভাত সাতক্ষীরার নির্বাহী সম্পাদক শেখ তানজির আহমেদ। সম্পাদকবৃন্দ বিভিন্ন প্রশ্ন তুলে ধরেন। এসবের জবাব দেন আলোচক সাংবাদিকরা।
সমাপনী অধিবেশনে প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশ গ্রহনকারীদের হাতে তুলে দেওয়া হয় কোর্স সমাপনী সনদপত্র।