দেশের খবর: একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নানাভাবে ভূমিকা রাখছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)। আইনি বিধিনিষেধে ‘শাস্তির শঙ্কায়’ বিদেশি তহবিলে পরিচালিত এসব এনজিওর কর্মকর্তাদের কেউই নিজেকে সরাসরি নির্বাচনী কাজে যুক্ত করছেন না। তবে এনজিওগুলোর প্রধান সারির কেউ কেউ নাগরিক সংগঠনের ব্যানারে তৎপর রয়েছেন।
বিদেশি অনুদানে পরিচালিত এনজিওর বেশিরভাগই অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। কোনো কোনো এনজিও নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ কাজে যুক্ত থাকতে চেয়ে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিতও হয়েছে, অর্থছাড়ের জন্য আবেদন করেছেন এনজিও ব্যুরোতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এনজিওগুলোর নির্বাচন-সংক্রান্ত কার্যক্রম ও তৎপরতায় দাতাদের প্রভাব থাকে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক অনুদান নিয়ে কাজ করে এমন দেশি-বিদেশি এনজিও রয়েছে দুই হাজার ৬২৫টি। এর মধ্যে বিদেশি এনজিও ২৫৯ এবং দেশি দুই হাজার ৩৬৬টি। এনজিও ব্যুরোতে নিবন্ধিত এসব সংস্থা ছাড়াও অনেক এনজিও রয়েছে দেশে। এসব এনজিওর একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কাজের বাইরে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের কাজও করে। একাদশ সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে পর্যবেক্ষণ কাজে যুক্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে ১১৯টি স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংস্থাকে নিবন্ধন দিয়েছিল ইসি। তবে এগুলোর মধ্যে একটি সংস্থার বিরুদ্ধে এনজিও ব্যুরো থেকে এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর থেকে অভিযোগ আসায় নির্বাচন পর্যবেক্ষক নীতিমালা অনুসরণ করে সেটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচনী কাজে এসব সংস্থার ভূমিকা সম্পর্কে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর অনেকে এনজিও হিসেবে কাজ করেন। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি নির্বাচনেও কাজ করেন। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, ভণ্ডুল হয় এমন কোনো কাজ যদি তারা করেন, নীতিমালা ভঙ্গ করেন, তাহলে নিবন্ধন বাতিল করার জন্য সংশ্নিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে চিঠি দিয়ে দেব।
বিভিন্ন ব্যানারে সক্রিয় এনজিও: গত ১৪ অক্টোবর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘বাংলাদেশ ও এজেন্ডা ২০৩০ :তারুণ্যের প্রত্যাশা’ শীর্ষক দিনব্যাপী যুব সম্মেলন করে ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’। ২০১৬ সালে সংগঠনটি যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে এর ৮৭টি সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসডিজির বিভিন্ন অভীষ্ট নিয়ে কাজ করছে। এ সম্মেলনে সারাদেশের প্রায় দুই হাজার তরুণ-তরুণী অংশ নেন। সম্মেলনের একাধিক অধিবেশনে আগামী নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে তরুণদের ‘সক্রিয় অংশগ্রহণের বার্তা’ দেওয়া হয়। সরকারের একাধিক কর্তাব্যক্তি এই সম্মেলনে অংশ নিলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনাও উঠে আসে অধিবেশনগুলোতে।
এ সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক এনজিও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনে নাগরিকরা নিরাপদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি-না তা নিয়ে উৎকণ্ঠা রয়েছে। তাই ভোট দেওয়ার নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। ‘সুশাসন ও আইনের প্রয়োগ’ শীর্ষক সম্মেলনের অন্য একটি অধিবেশনে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) নির্বাহী পরিচালক ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, নাগরিক হিসেবে রাজনীতি নিয়ে তরুণদের কথা বলতে হবে। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি-না তা দেখতে হবে।
সরাসরি নির্বাচনী কার্যক্রমে যুক্ত না থাকলেও ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ’-এর মতো বিভিন্ন ব্যানারে এনজিও এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য কাজ করছেন অনেক দিন ধরে। এ রকমই একটি নাগরিক সংগঠন ‘সুশাসনের জন্য নাগরিক’ (সুজন)। এর সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার আন্তর্জাতিক এনজিও দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশের ‘কান্ট্রি ডিরেক্টর’। সুজনের কাজে দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট আর্থিক সহায়তা না করলেও জনবলের সহায়তা নেওয়া হয় বলে জানা গেছে।
হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর বদিউল আলম বলেন, গতানুগতিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোর বাইরে সুজন দীর্ঘমেয়াদি নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ কাজে যুক্ত রয়েছে। এনজিওগুলোকে একটা নিয়ন্ত্রণমূলক আইনের মধ্য দিয়ে চলতে হয়। তাই তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই নাগরিক সংগঠনের ব্যানারে দেশে সুষ্ঠু গণতন্ত্র বিকাশে তারা কাজ করছে।
বদিউল আলম আরও বলেন, এবারের নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষক অনেকে আসবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছে। তাদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নও রয়েছে। আবার বিদেশি এনজিওগুলোর তহবিল যেহেতু ইইউ, ইউএসএইডসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দিয়ে থাকে, সেহেতু এবার তাদের অনেকেও আসবে না। অন্যদিকে, এককভাবে ব্যক্তিগত খরচে কোনো বিদেশির পক্ষে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিকে ‘নেতিবাচক’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আশা করি সরকার ও ইসি এর পরিণতি অনুধাবন করবে।
দেশে নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ কাজে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর সর্ববৃহৎ জোট ‘ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (ইডব্লিউজি)। ২৬টি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এ জোট আগামী নির্বাচনে পর্যবেক্ষণ করার সব প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। এ প্রসঙ্গে ইডব্লিউজির চেয়ারপারসন আব্দুল আউয়াল সমকালকে বলেন, তারা নির্বাচনী পর্যবেক্ষণ নীতিমালা মেনে কাজ করেন। এ নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম হবে না। এ সময় স্বল্পমেয়াদি পর্যবেক্ষক হিসেবে ১৫ হাজারের বেশি ও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে ১৪৫ জন কাজ করবেন।
নির্বাচন ঘিরে এনজিওগুলোর বহুমুখী তৎপরতা প্রসঙ্গে ‘সিভিল সোসাইটি’ বিশেষজ্ঞ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহাত তাসনীম বলেন, নির্দিষ্ট কোনো প্রতীকে ভোট দেওয়ার বিষয়ে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রে এনজিওগুলোর ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য ভোটারদের ভোট দেওয়ার বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে এনজিওর ভূমিকাকে তিনি ইতিবাচকভাবেই দেখেন।
‘ডোনারদের যে সুর, এনজিওদের সেই সুর’- এ দেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে এ কথাটি কতটা প্রাসঙ্গিক জানতে চাইলে এ শিক্ষাবিদ বলেন, দাতাদের উপেক্ষা করে এনজিওগুলো চলতে পারে না। যদিও আগের চেয়ে তারা এখন অনেক বেশি স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন বলে মনে হয়। তবে একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো সৃষ্টিতে ‘সিভিল সোসাইটি’ যেভাবে এগিয়ে আসার কথা, সেভাবে ভূমিকা বর্তমানে রাখছে না বলে মনে করেন তিনি।
নির্বাচনী তহবিল ছাড়ে ১৯ এনজিওর আবেদন: এনজিও ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, এ পর্যন্ত ১৯টি এনজিও নির্বাচনী পর্যবেক্ষণসহ সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন কাজে অংশ নেওয়ার জন্য তহবিল পেতে ব্যুরোতে আবেদন করেছে। ব্যুরো থেকে এসব এনজিওর বিষয়ে তথ্য চেয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে মতামত চাওয়া হয়েছে। যদি ইসি ও সুরক্ষা সেবা বিভাগ ইতিবাচক মতামত দেয়, তা হলে তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়ের অনুমতি দেওয়া হবে।
ব্যুরোতে আবেদন করা এনজিওগুলো হলো- সিরাজগঞ্জের ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এনডিপি), খুলনার নবলোক পরিষদ ও রূপান্তর; নোয়াখালীর রুরাল ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, মেহেরপুরের পলাশীপাড়া সমাজকল্যাণ সমিতি, শরীয়তপুর ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, ওয়েভ ফাউন্ডেশন, ইনস্টিটিউট ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, বগুড়ার লাইট হাউস, যশোরের জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পরিষদ (জানিপপ), কুড়িগ্রামের সলিডারিটি, ধানমণ্ডির উত্তরণ, অ্যাকশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, পিরোজপুরের ডাক দিয়ে যাই, অ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, যশোরের বাঁচতে শেখা, কোস্টাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল ট্রান্সফরমেশন (কোস্ট ট্রাস্ট) ও আব্দুল মোমেন খান মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।
এ প্রসঙ্গে এনজিও ব্যুরোর মহাপরিচালক কেএম আব্দুস সালাম বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে বিভিন্ন এনজিও প্রকল্প পাসের আবেদন করে। বেশিরভাগই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করে। ইসির অনুমোদন থাকলে এসব প্রকল্প ব্যুরো থেকে ছাড় করার অনুমতি দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে ১৯টি এনজিও এ ধরনের প্রকল্পের অর্থ ছাড়ের আবেদন করেছে।
আব্দুস সালাম বলেন, নির্বাচন কেন্দ্র করে এনজিওকেন্দ্রিক নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের কেউ কেউ ভূমিকা রাখেন। বিদেশি অনুদান রেগুলেশন আইনের ব্যত্যয় না হলে এ ব্যাপারে ব্যুরো কোনো বাধা দেয় না। এখন পর্যন্ত কারও নেতিবাচক তৎপরতা নজরে আসেনি। এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।