দেশের খবর: টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন সরকারের সময় দেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সাফল্য সরকারের ঘোর সমালোচকরাও স্বীকার করেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠায়ও ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও অনেক বিচারের রায় কার্যকর, বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচারের রায় কার্যকর, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলার বিচার, জঙ্গিবাদ দমন ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। সাফল্য রয়েছে যোগাযোগসহ বিভিন্ন খাতেও। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালের নির্বাচনী ইশতেহারেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বিষয়টি ছিল আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিশ্রুতি।
এর পরও নবম ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারের বেশকিছু প্রতিশ্রুতি পূরণে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ কার্যত না হওয়ায় মানুষ হতাশ হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ প্রকাশ, বেকারত্ব দূর করার জন্য ঘরে ঘরে চাকরি, প্রতি দপ্তরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপন ইত্যাদি প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হয়নি এই সরকার।
এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ নতুন ইশতেহার ঘোষণা করেছে। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় অপ্রতিরোধ্য বাংলাদেশ’ শীর্ষক এ ইশতেহারে আবারও ক্ষমতায় যেতে পারলে সরকারের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে তরুণদের সমস্যা ও গ্রামের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে ২১ দফা বিশেষ অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়েছে।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ঘোষণা করে ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদ’। যেখানে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং ‘রূপকল্প-২০২১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে এ রাষ্ট্রকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার অঙ্গীকার ছিল। অন্যদিকে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ২০১৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর ঘোষণা করা হয় ‘শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক নির্বাচনী ইশতেহার। যেটির উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, পাঁচ বছরের মধ্যে ‘রূপকল্প-২০৪১’ ঘোষণা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ, সুখী ও উন্নত জনপদে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি। এই দুই নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়।
বিশ্নেষকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা থাকে বেশি। এ কারণে ২০০৮ ও ২০১৩ সালে ঘোষিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের উল্লেখযোগ্য অনেক অঙ্গীকার পূরণ না হওয়ায় তাদের অনেকেই সমালোচনার সুযোগ পেয়েছেন।
দুই মেয়াদের ইশতেহার বাস্তবায়ন: ২০০৮ সালের ইশতেহার ‘দিনবদলের সনদে’ অগ্রাধিকারের পাঁচটি বিষয় এবং ‘গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য কর্মসূচি’ শিরোনামে আরও ১৮টি বিষয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৩ সালে ‘শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শীর্ষক ইশতেহারে এ ২৩টি বিষয়ের সঙ্গে আরও তিনটি বিষয় যুক্ত করে মোট ২৬টি বিষয়ে নানা অঙ্গীকার তুলে ধরা হয়।
এগুলোর মধ্যে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রতিশ্রুতি ছিল অন্যতম দুটি প্রধান অঙ্গীকার। এই দুটিতেই ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে ২০০৯ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। পরে ২০১৪ সালে গঠিত মহাজোট সরকারও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখে। চলতি বছরের ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস স্টেশন থেকে দেশের প্রথম নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ উৎক্ষেপণকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বর্তমানে ১৫ কোটি ২৫ লাখ মোবাইল সংযোগের মাধ্যমে দেশের প্রায় শতভাগ নাগরিক মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন। ইন্টারনেট গ্রাহক সংখ্যা ২০০৮ সালের ৪০ লাখ থেকে বেড়ে ৮ কোটি ২ লাখে উন্নীত হয়েছে। অর্থাৎ, ৫৩ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৮ হাজার ৫০০টি ডাকঘরকে পোস্ট ই-সেন্টারে রূপান্তর করা হয়েছে।
এ ছাড়াও রয়েছে- ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, কেমিকেল মেজারমেন্ট ও খনিজসম্পদ বিষয়ে গবেষণা ইত্যাদির জন্য চারটি ইনস্টিটিউট স্থাপন, অনেকগুলো আইটি ও ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) চালু ও ৩ হাজার ৬০০টি ইউনিয়নে অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ প্রদান, নাগরিক সেবা প্রদানে ৪৫ হাজারেরও বেশি অফিসের তথ্যসংবলিত ‘বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন’ ও ৩৩৩টি কলসেন্টার স্থাপন, কৃষিবাতায়নে ৭৮ লাখ কৃষকের তথ্য সংযুক্ত করা, ই-গভর্ন্যান্স বাস্তবায়ন, ২৩ হাজার ৩৩১টি মাধ্যমিক ও ১৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম কার্যক্রম চালু, আদালতের কার্যক্রম আধুনিকায়নে ডিজিটাল মোবাইল কোর্ট সিস্টেম চালু ইত্যাদি সাফল্য।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পরপরই আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রতিশ্রুতি পূরণের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ৮৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে ৩৫টি মামলার রায় হয়েছে। ৫৩ জনকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন এবং একজনকে ৯০ বছরের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। ছয়জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ অনেকাংশেই গ্লানিমুক্ত হয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতা হত্যার বিচারের রায় ২০০৯ সালে গঠিত সরকারের মেয়াদকালে এসে কার্যকর হয়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ক্ষেত্রে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার অনেকটাই সফল হয়েছে। বর্তমান দেশে ১২৩টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে প্রায় ২০ হাজার ৪৩০ মেগাওয়াট। এতে ৯৫ শতাংশ মানুষই বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। দেশে অফগ্রিড এলাকার ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন ও পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পাবনার রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু এ সরকারের আরেকটি বড় সাফল্য।
শিক্ষা ও বিজ্ঞান ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রুতিগুলোর বেশিরভাগই পূরণ হয়েছে। শতভাগ শিশুকে স্কুলে পাঠানো, শিক্ষার্থীদের মেধাবৃত্তি ও উপবৃত্তি দেওয়া, স্কুল ফিডিং চালু, বিদ্যালয়বিহীন গ্রামে ১ হাজার ১২৩টি বিদ্যালয় স্থাপন, ২৫ হাজার ৮৩১টি বিদ্যালয় ও ৯১ হাজার শিক্ষকের চাকরি জাতীয়করণ, ১ লাখ ৮ হাজার ২০০ জন শিক্ষক নিয়োগ, ৯ বছরে সর্বমোট ২৬০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ২৯০টি বই বিনামূল্যে বিতরণ, পাঁচটি নৃগোষ্ঠীর ভাষায় ৭৭ লাখ ২৮২ বই ছাপিয়ে বিতরণ, ১ হাজার ৪৯৪টি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৫৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নসহ কওমি মাদ্রাসা সনদকে স্বীকৃতি দিয়ে দাওরা হাদিস পর্যায়কে মাস্টার্স সমমান প্রদান, অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে ২০১০ থেকে শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) ও ২০১১ সাল থেকে চালু হওয়া ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা এবং ৩০ দিনের মধ্যে সব পরীক্ষার ফল প্রকাশের সরকারি পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। ৬০ দিনের মধ্যে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ এবং সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার শিক্ষার মান বাড়ানোর ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরুর পর ইতিবাচক অগ্রগতি সরকারের সাফল্যকে অনন্য সাধারণ মর্যাদা এনে দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ হওয়ার পর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ ইতিমধ্যে ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে।
যা বাস্তবায়ন হয়নি: আওয়ামী লীগের পূর্ববর্তী দুটি নির্বাচনী ইশতেহারেই শীর্ষ অগ্রাধিকারের মধ্যে ছিল দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার প্রতিশ্রুতি। বাস্তবে গত ১০ বছরে সব ধরনের পণ্যমূল্যই বেড়েছে। ফলে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসেনি। বরং জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া ও চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ‘ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ’ গড়ে তোলা এবং সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতিও আলোর মুখ দেখেনি।
ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) আরও শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে দুদকের স্বাধীনতা আরও খর্ব করে ফেলা হয়। এ নিয়ে সুশীল সমাজসহ দেশের সব মহলে আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে।
পূরণ হয়নি ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ প্রকাশ এবং প্রতি দপ্তরে গণঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নাগরিক সনদ উপস্থাপনের প্রতিশ্রুতি। ইশতেহারে বলা হয়েছিল, জাতীয় সংসদ কার্যকর ও সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাসহ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য এবং সাংসদ ও তাদের পরিবারের সম্পদের হিসাব এবং আয়ের উৎস প্রতি বছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে। কিন্তু অন্যতম এই বড় প্রতিশ্রুতিই পূরণ হয়নি। একইভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শিষ্টাচার ও সহিষ্ণুতা গড়ে তোলা, সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি নিষিদ্ধ এবং একটি সর্বসম্মত আচরণ বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি।
জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে কয়লানীতি প্রণয়নের অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন গত পাঁচ বছরেও ঘটেনি। ২০০৮ সালের ইশতেহারে চতুর্থ অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে ২০১৩ সালের মধ্যে দারিদ্র্যসীমা ও চরম দারিদ্র্যের হার যথাক্রমে ২৫ ও ১৫ শতাংশে নামিয়ে দরিদ্রের সংখ্যা সাড়ে ৪ কোটিতে নামানোর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষিত হয়। তবে দারিদ্র্যের হার সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত ২১ শতাংশের মতো কমানো গেছে। অতি দারিদ্র্যের হার কমেছে ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। অবশ্য ২০১৩ সালের ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ২০০৮ সালের ইশতেহারের শেষ অগ্রাধিকারে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করে স্বাধীন মানবাধিকার কমিশন গঠন ও ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। তবে গত ১০ বছরেও ন্যায়পাল নিয়োগ হয়নি।
দুই ইশতেহারেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রায়ন করে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পরিষদকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। তবে স্থানীয় সরকারগুলোর বিশেষ করে উপজেলা পরিষদের ক্ষমতা খর্ব করে ও সংসদ সদস্যদের উপজেলা পরিষদের উপদেষ্টা পদে রেখে প্রণীত বিধিমালা নিয়ে আন্দোলন হয়েছে ২০০৯ সালে গঠিত সরকারের আমলেই।
যোগাযোগ খাতে ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল এশীয় রেল ও জনপথের আওতায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে রেল-সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের। এ ক্ষেত্রে চারটি দেশের সঙ্গে সীমিত পরিসরে সড়ক যোগাযোগ চালু হলেও বাস্তবে রেল যোগাযোগ স্থাপনের প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। গভীর সমুদ্রবন্দর ও কর্ণফুলী টানেল নির্মাণের মতো অন্য মেগাপ্রজেক্টগুলোর কাজ শুরু হলেও এর অগ্রগতি কিছুটা ধীর।
এ ছাড়া বাংলাদেশ বিমানকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, সর্বাধুনিক আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ, ঢাকার জনপরিবহন সমস্যার সমাধান ও যানজটমুক্ত করতে ভূগর্ভস্থ রেললাইন নির্মাণ, আকাশ রেল অথবা সার্কুলার রেলপথ, রাজধানীকে ঘিরে নাব্য ও প্রশস্ত নৌপথ নির্মাণের অঙ্গীকারেরও বাস্তবায়ন ঘটেনি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্যপ্রবাহের অবাধ চলাচল সুনিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা, সব সাংবাদিক হত্যার দ্রুত বিচার, সাংবাদিক নির্যাতন ও তাদের প্রতি ভয়-ভীতি-হুমকি প্রদর্শন বন্ধ, সন্ত্রাস-দুর্নীতি ও ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, স্বচ্ছ অর্থায়ন, শিষ্টাচার ও সহনশীল আচরণ প্রতিষ্ঠা এবং দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্র চর্চা ও অধিকতর সংস্কারের লক্ষ্যে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নেওয়ার মতো ছোট-বড় অঙ্গীকারগুলোও পূরণ হয়নি।
২০১৪ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করার প্রতিশ্রুতি এখনও সুদূরপরাহত। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর বেতন কাঠামো ও স্থায়ী বেতন কমিশন ও স্বতন্ত্র কর্মকমিশন গঠনের অঙ্গীকারও পূরণ হয়নি। এ ছাড়া শিক্ষাঙ্গনগুলোকে দলীয়করণ, সন্ত্রাস ও সেশনজটমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। পর্যায়ক্রমে স্নাতক পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক সেবায় পরিণত করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ২০১৩ সালেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখনও বাস্তবায়ন হয়নি।
একইভাবে ২০০৮ সালের ইশতেহার অনুযায়ী, ২০১১ সালের মধ্যে সব মানুষের জন্য নিরাপদ পানি এবং ২০১৩ সালের মধ্যে প্রতি বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করার প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। বছরে নূ্যনতম ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের জন্য প্রত্যেক পরিবারের একজন কর্মক্ষম বেকার তরুণ/তরুণীকে কর্মসংস্থানের জন্য ‘এমপল্গয়মেন্ট গ্যারান্টি’ স্কিমের আওতায় আনার প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি। সরকার প্রতিশ্রুত ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’ প্রকল্প চালু হলেও এক্ষেত্রে সাফল্য তেমন একটা আসেনি। ২০০৮ সালের ইশতেহারে ২০১৩ সালের মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ এবং ২০১৩ সালের ইশতেহারে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নতির প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও সরকারি হিসাবেই এখন পর্যন্ত তা ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশে থমকে আছে।
বিশ্নেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রেও ইশতেহারে বর্ণিত প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকারের ব্যর্থতা রয়েছে। ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বিনা পরোয়ানা ও সাদা পোশাকে গ্রেফতার, গুম-খুন ও ক্রসফায়ারের ঘটনা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে।