অন লাইন ডেস্ক : রাজধানীর একটি বেসরকারি স্কুলের মোহাম্মদপুর শাখায় নার্সারিতে ভর্তির জন্য অভিভাবকের কাছ থেকে জানুয়ারির বেতনসহ নেওয়া হয়েছে ১০ হাজার ৯৮০ টাকা। এর মধ্যে বেতন এক হাজার ৫০ এবং ভর্তির জন্য দুই হাজার ৮০০ এবং সেশন চার্জ নেওয়া হয়েছে সাত হাজার ১০০ টাকা।
নার্সারির জন্য ভর্তির পর একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বই, কলম, পেনসিল কিনতে হয়েছে দুই হাজার ৭৯০ টাকা। এই টাকা দিতেও বাধ্য অভিভাবকেরা।
একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে জানুয়ারির বেতনসহ ভর্তি ফি নেওয়া হয়েছে ১৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে বেতন এক হাজার ৯৫০ টাকা। ভর্তি ফি নেওয়া হয়েছে ছয় হাজার আর সেশন চার্জ নয় হাজার ৩০০ টাকা। এই শ্রেণিতে সব বই সরকার বিনা মূল্যে দিলেও ওই স্কুলটি থেকে বই কিনতে হয়েছে আড়াই হাজার টাকার।
অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা বলছে, সিটি করপোরেশনের ভেতরে বেসরকারি স্কুল সব মিলিয়ে বাংলা মাধ্যমে আট হাজার আর ইংরেজি ভার্সনে ১০ হাজার টাকা নিতে পারবে। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে কোনো প্রতিষ্ঠান তিন হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না। আর পুনর্ভর্তির ফি নেওয়া যাবে না। কিন্তু এটা আদায়ের তথ্য মিলেছে।
এরই মধ্যে স্কুলে বাড়তি টাকা দিলে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নতুন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। গতকাল চাঁদপুরে নিজ এলাকায় গিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি আদায় নিয়মবহির্ভূত কাজ এবং অন্যায়। ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি, পরীক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ফি নেওয়া হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এমন বক্তব্য অবশ্য নতুন নয়। বারবার দিয়েছেন মন্ত্রীরা। সদ্য বিদায়ী মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও অভিভাবকরা কোনো সুফল পাননি।
বেসরকারি স্কুল কলেজ তো বটেই, নির্ধারিত অঙ্কের চেয়ে অতিরিক্ত ভর্তি ফি, উন্নয়ন ফি, কোচিং-মডেল টেস্টের নামে টাকা আদায়, নিবন্ধন ফিসহ নানা অজুহাতে পদে পদে টাকা আদায় করছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। শুরু হয়ে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষেও একই ঘটনা ঘটেছে।
নানা সময় এই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে সতর্কতা এসেছে। একাধিকবার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন স্কুলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু তাতে অন্যরা দমে যায়নি। আবার নানা সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ এসেছে অতিরিক্ত টাকা ফেরত দেওয়ার। কিন্তু তাতে কাজ হয়েছে কমই।
স্কুলগুলোতে নানা অজুহাতে এভাবে টাকা আদায় নিয়ে ক্ষোভ আছে অভিভাবকদের। তবে তারা নাম প্রকাশ করে কিছু বলতেও ভয় পান। কারণ হিসেবে একজন বলেন, এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তাদের সন্তানদের স্কুল থেকে বের করে দেওয়া থেকে শুরু করে নানাভাবে হয়রানি করা হবে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে আনোয়ার হোসেনের দুই সন্তান। তাদের পড়ালেখার খরচ মেটাতেই ব্যয় হচ্ছে অর্ধেকের বেশি। বাকি টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া, খাবারসহ আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে তার সঞ্চয় বলতে আর কিছুই থাকছে না।
এই অভিভাবক বলেন, ‘স্কুলগুলো প্রতিবছর খেয়াল-খুশিমতো টাকার পরিমাণ বাড়াচ্ছে। এটার বিরুদ্ধে কেউই কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। দুই সন্তানের লেখাপড়ার পেছনে মাসে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা চলে যাচ্ছে। ভবিষ্যতের জন্য যে কিছু জমাব, সেটা আর হচ্ছে না।’
রাজধানীর বেশ কয়েকটি নামীদামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে জানা যায়, প্রতিটি স্কুলই এ বছরও গতবারের চেয়ে বেশি করে টাকা আদায় করছে। এর মধ্যে সরকারি স্কুলও আছে।
উইলস ফ্লাওয়ার স্কুল, শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গ্রিন উডস স্কুল, ফিরোজা বাশার আইডিয়াল স্কুল, সানবিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ছাড়াও বেশ কয়েকটি স্কুলে এই চিত্র দেখা গেছে।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে গত বছরের চেয়ে কমপক্ষে ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা বাড়ানো হয়েছে। একজন অভিভাবক বলেন, তার ছেলে তৃতীয় শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছে। গেল বছর দেড় হাজার টাকা বেতন ছিল, এ বছর তাকে দিতে হবে দুই হাজার ৪০০ টাকা।
গ্রিন উডস স্কুলে কেজিতে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে ১০ হাজার টাকা। যেখানে মাসিক বেতন নেওয়া হবে দুই হাজার টাকা। ফিরোজা বাশার আইডিয়াল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ভর্তির জন্য নেওয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা। মাসিক বেতন ধরা হয়েছে এক হাজার টাকা। মোহাম্মদপুরে জেনেসিস প্রি-স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে ১৫ হাজার টাকা, যেখানে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন গুনতে হবে প্রায় দুই হাজার টাকা।
অতিরিক্ত টাকা আদায়ের ব্যাপারে গ্রিন উডস ও মোহাম্মদপুরে জেনেসিস প্রি-স্কুলের অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলে স্কুলের ভেতরেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে অধ্যক্ষকে পাওয়া যায়নি। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অধ্যক্ষের নাম্বারে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইআইআরের সাবেক পরিচালক ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষাটাকে পণ্য বানিয়ে দিচ্ছে। তারা বছরের প্রথমে ফি বাড়িয়ে অভিভাবকদের ওপর বোঝা চাপিয়ে দেয়, এটা অন্যায়। এটা এদের একটা অপকৌশল। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ে সরকার যেহেতু একটা নীতিমালা করেছে, সরকারের দায়িত্ব এটার তদারকি করা। আমি নিয়ম করব তদারকি করব না, এটা তো ঠিক নয়। যারা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।’