রাজনীতির খবর: শুক্রবার বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক পদত্যাগ করেছেন। সেই খবরের রেশ কাটতে না কাটতে নিজেই দল থেকে বরখাস্তের খবর দিলেন শুরা সদস্য মজিবুর রহমান মনজু।
জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের সাবেক এ সভাপতি শনিবার তার ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বহিষ্কারের বিষয়টি জানিয়েছেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক সূত্রও বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে পদত্যাগের সুনির্দিষ্ট কারণ ব্যাখ্যা করে শুক্রবার দল থেকে পদত্যাগ করেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। যিনি দলটির সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত একাধিক নেতার প্রধান কৌঁসুলি ছিলেন। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের পর তিনি এখন যুক্তরাজ্যে আছেন। যুক্তরাজ্যের নাগরিক জামায়াতের এ শীর্ষস্থানীয় নেতা সেখান থেকেই পদত্যাগের ঘোষণা দেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করায় জনগণের কাছে ক্ষমা না চাওয়া ও একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতার আলোকে এবং অন্যান্য মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনকে বিবেচনায় এনে নিজেদের সংস্কার করতে না পারাকে পদত্যাগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। তবে তিনি গত দুই দশক ধরে এই ক্ষেত্রে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছিলেন বলেও পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করেন।
এদিকে শনিবার জামায়াত থেকে বহিষ্কারের ব্যাপারে শুরা সদস্য মজিবুর রহমান মনজু মুখ খুলেছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। নিজের ফেসবুক পেজে দেয়া পোস্টে তিনি জানান, ‘গতকাল শুক্রবার আনুমানিক রাত সাড়ে সাতটার দিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত আমির জনাব মকবুল আহমদের পক্ষ থেকে নির্বাহী পরিষদের একজন সম্মানিত সদস্য আমাকে জানান যে আমার দলীয় সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে।’
পদত্যাগের ক্ষেত্রে দলের সঙ্গে ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের ন্যায় নিজেরও মতভিন্নতার কথা উল্লেখ করে দীর্ঘ পোস্টে মজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘বেশ কয়েক বছর যাবৎ সংগঠনের কিছু বিষয়ে আমি দ্বিমত করে আসছিলাম। মৌখিক ও লিখিতভাবে বৈঠকসমূহে আমি প্রায়ই আমার দ্বিমত ও পরামর্শের কথা সম্মানিত দায়িত্বশীলদের জানিয়েছি। অভ্যন্তরীণ ফোরামের পাশাপাশি আকারে–ইঙ্গিতে প্রকাশ্যেও আমি আমার ভিন্নমত প্রকাশ করে এসেছি।’
তিনি আরও উল্লেখ করেছেন ‘আমি যেহেতু সামাজিক-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করি এবং প্রকৃতিগত কারণে আমাকে নানা ধরনের আড্ডা, ঘরোয়া আলোচনা, সেমিনারে অংশ নিতে হয়, সেহেতু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তন-পরিবর্তন প্রসঙ্গে আমি অনেক জায়গায় খোলামেলা মত প্রকাশ করে থাকি। এসব আলোচনায় প্রসঙ্গক্রমে মিশর, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, তিউনিসিয়ার ইসলামি ধারার রাজনীতির উত্থান-পতন ও বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়গুলো উঠে আসে। জামায়াতে রাজনৈতিক সংস্কারের যৌক্তিকতা, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ভূমিকা প্রসঙ্গে আমার সুস্পষ্ট মত ছিল যে জামায়াতে প্রয়োজনীয় সংস্কার না হলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার এরূপ খোলামেলা মত নিয়ে জামায়াতের সম্মানিত নেতৃবৃন্দের মাঝে বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।’
নিজের বরখাস্তের নেপথ্যের কারণ উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, আমি ভেবেছিলাম এই স্পর্ধা ও মতামতের পর নেতৃবৃন্দ আমার উপর চরমভাবে অসন্তুষ্ট হবেন এবং সাংগঠনিক ব্যবস্থা স্বরূপ আমার সদস্যপদ বাতিল করবেন। কিন্তু তারা আমার প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল, উদার ও দরদী আচরণ করেন। তারা আমাকে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় বিশ্বস্ত কাজে সংযুক্তও করেন। সদ্য সমাপ্ত ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে জামায়াতের অংশগ্রহণ নিয়ে আমার দ্বিমত ছিল। তারপরও নির্বাচনের পূর্বে আমি সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে জাতীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়, সংলাপ, বৈঠকসহ একটি নির্বাচনী আসনে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করেছি।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘গত ১৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে জামায়াতের একজন নির্বাহী পরিষদ সদস্যের নেতৃত্বে ৩ জন সম্মানিত দায়িত্বশীল আমার সাথে বৈঠকে মিলিত হন। তারা আবারও আমার বিরুদ্ধে গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বিনয়ের সাথে তাদের জানাই যে আমি জামায়াতের একজন নগন্য সদস্য এবং দেশের নাগরিক। স্বাধীন মত প্রকাশ আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাষ্ট্রীয় অধিকার। আমার মত প্রকাশে জামায়াতের গঠনতন্ত্র বা শৃঙ্খলার কোনো লঙ্ঘন হয় না বলে আমি মনে করি। আমি যা করি তা স্বচ্ছ ও প্রকাশ্য। এখানে ষড়যন্ত্র বা গোপনীয়তার কিছু নেই। আমি তাদের মাধ্যমে জামায়াতের আমীর বরাবর একটি লিখিত বক্তব্য ও ব্যখ্যা প্রদান করি। আমার বিরুদ্ধে জামায়াত ভেঙে নতুন দল গঠনের যে অপপ্রচার তার বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানাই। তারা অসন্তুষ্টচিত্তে আমার আবেদন গ্রহণ করেন এবং জামায়াতের আমিরের নিকট তা উপস্থাপনের আশ্বাস দেন।’
এছাড়া ওই পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘আমার আবেদনের বিষয়ে কোনো তদন্ত না করে গতকাল রাতে আমাকে টেলিফোনে জানানো হয় আমার সদস্যপদ বাতিল করা হয়েছে। মনে ভীষণ ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করলেও আমি সন্তুষ্টচিত্তে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু এই বিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছি যে, এই আন্দোলন আবার ঘুরে দাঁড়াবে। এই সংগঠন কামারুজ্জান, মীর কাসেম আলী ও ব্যরিস্টার আব্দুর রাজ্জাকদের প্রস্তাব একদিন গ্রহণ করবে। শহীদ নিজামী ভাই নেই, মুজাহিদ ভাই, কামারুজ্জামান, মীর কাসেম আলী, মোল্লা ভাইসহ শত শত শহীদের রক্ত একদিন কথা বলবে।’
‘বিদায় হে প্রিয় কাফেলার সাথীরা। যারা আমাকে ভালবাসেন তারা দোয়া করবেন। যারা ঘৃণা করেন তারা ক্ষমা করে দেবেন। বিদায় বেলায় সেই স্মৃতি বিজড়িত গানটি হৃদয়ে বাজছে—- আমি আর নেই সেই মিছিলে,, ভাবতেই বন্ধু বুক ভেঙ্গে যায়….।’