রোদ বৃষ্টি ঝড়। দুর্যোগ দুর্বিপাক। তা সত্ত্বেও নিত্য সকালে বাসে চড়ে সাতক্ষীরায় আসা আবার সন্ধ্যায় ফিরে যাওয়া। এই রুটিনের ব্যতিক্রম হয়নি কোনদিন। দিনভর এই সময়টা সংবাদ রচনা ও পরিবেশন নিয়েই কেটে যেত তার। এভাবেই কেটেছে কমপক্ষে ৫০ বছর। অবশেষে তিনি ছেড়ে চলে গেছেন আমাদের।
পেছনের স্মৃতিগুলোকে ফেলে রেখে অনন্তলোকে পাড়ি দিয়েছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শেখ আব্দুস সোবহান। কালিগঞ্জের গনপতি গ্রামের বাড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে বাসে চড়ে সাংবাদিক শেখ আব্দুস সোবহানের নৈমিত্তিক আসা যাওয়ার চিত্র অনেকের চোখেই এখনও বাঁধা। বাস শ্রমিকরাও তাকে সম্মান করতেন একজন সাংবাদিক হিসাবে।
অত্যন্ত হাসিখুশী, কিছুটা আত্মভোলা শেখ আব্দুস সোবহান শীত গ্রীষ্ম সবসময়ই গায়ে পরতেন একটি কোট। সেই সাথে নেক টাই। মাঝেমধ্যে তাকে দেখা যেত হাফ সাফারী পরা অবস্থায়ও।
ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি) এবং পরবর্তীতে দৈনিক খবর এর সাতক্ষীরা সংবাদদাতা হিসাবে আব্দুস সোবহান তার পেশাজীবন কাটিয়েছেন। কোন সংবাদ কানে আসবার পরেই কারও না কারও সাথে পরামর্শ করেছেন। সেই রিপোর্টটি তৈরী করার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন।
সাতক্ষীরার পুরাতন আইনজীবী ভবনের একাংশে রোজই বসতো সাংবাদিকদের নির্ধারিত আড্ডা। এই আড্ডায় শেখ আব্দুস সোবহান হাজির করতেন তার ইনফরমেশন। এগুলো নিয়ে অগ্রজ সাংবাদিক এ্যাড. একেএম শহীদুল্লাহ, এ্যাড. এসএম হাসান আওরঙ্গী, আমি নিজে, কল্যান ব্যানার্জী, মিজানুর রহমান, শেখ আব্দুল ওয়াজেদ কচিসহ অনেকেই তা পর্যালোচনা করতাম। পরে সেটি রিপোর্ট হিসাবে ইংরেজী ভাষায় তৈরী করে টেলিগ্রাম অফিসে নিয়ে যাওয়া হতো। আব্দুস সোবহান নিজেই এই দায়িত্বটি পালন করে নিউজ পাঠানো শেষে আবারও আইনজীবী সমিতির মজলিশে এসে চা সিগারেট খেয়ে হাসিমুখে চলে যেতেন। নিতান্তই অর্থনৈতিক টানাপোড়েন না থাকলেও শেখ আব্দুস সোবহান প্রতিদিন সাতক্ষীরায় থাকাকালীন কোর্ট ক্যান্টিনে ৫ থেকে ৭ টাকার মধ্যে দুপুরের খাওয়া সম্পন্ন করতেন। এর ফাকে কোন একবার থানা অথবা অন্য কোন অফিসে যেয়ে নতুন নিউজের সন্ধান করতেন।
শেখ আব্দুস সোবহান বরাবরই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত। তিনি আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কেউ অশোভন কথা বললে তার সাথে তিনি সম্পর্ক রাখতেন না। আব্দুস সোবহান সবসময় পায়ে হেঁটে চলতেন। শহরের মধ্যে কেউ তাকে দেখেনি রিকশায় চড়তে। সবার সাথে সমান এবং শোভন ব্যবহার করতেন শেখ আব্দুস সোবহান।
শেখ আব্দুস সোবহান আওয়ামী লীগ সহ সকল গনতান্ত্রিক আন্দোলনে নিজেকে বিলিয়ে দিতেন। ১৯৬৯ সালে ১১ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলনে অগ্রগামী সৈনিক ছিলেন শেখ আব্দুস সোবহান। এ কারনে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। কমপক্ষে ১৫দিন কারাবন্দী ছিলেন তিনি। অত্যন্ত ছিমছাম চেহারার কৃষ্ণবর্নের আব্দুস সোবহানের হাসি ছিল উজ্জ্বল শে^তশুভ্র স্ফটিকের মত ধবধবে সাদা। সচরাচর রাস্তাঘাটে সিগারেট খেতেন। তার দুই আঙুলের ফাকে অথবা ঠোঁটে লেগেই থাকতো সিগারেট।
শেখ আব্দুস সোবহানের নিউজ সেন্স ছিল প্রখর। ছোট্ট একটু খবরকেও তিনি তুলে নিয়ে আসতেন এবং সেটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে তৃনমূল পর্যায়ের খবর পরিবেশন করতেন।
এমনই একটি খবর ছিল শ্যামনগরের। সেখানে একটি ডাকাতির মামলায় সাজা হয়ে যায় ১২ বছর বয়সের কিশোর নজরুলের। এই তথ্য জানতে পেরে তিনি রিপোর্ট করার প্রস্তুতি নেন এবং আমাদের সংবাদ মজলিশে তা উপস্থাপন করেন। পরে তাকে নিয়ে লেখালেখির এক পর্যায়ে নজরুল বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত হয়।
কালিগঞ্জের মথুরেশপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামে একজন মুজিবর রহমান যার ঘাড়ে ছিল ডাকাতির মামলা, তিনি এই ডাকাতির দায়দায়িত্ব তার বাড়ির কর্মচারী মুজিবর রহমান(২)এর ওপর চাপিয়ে দিয়ে তাকে কৌশলে জেলে ঢুকিয়ে দেন। এই ফাঁকে ডাকাতি মামলার মূল আসামী মুজিবর বিদেশে পালিয়ে যান। এই ঘটনা সম্পর্কে আব্দুস সোবহান জানতে পারেন।
তিনি বিষয়টি সাতক্ষীরা আইনজীবী সমিতির সাংবাদিক মজলিশে তুলে ধরেন। আমরা সকলে মিলে এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করি। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে রিপোর্ট হওয়ায় বাড়ির কর্মচারী নিরীহ যুবক মুজিবর রহমান(২) জেল থেকে মুক্তি পান।
সাতক্ষীরার জর্জ আদালতের একজন বিচারক ঘুষ নিয়ে রায় দিয়েছেন এবং মূল আসামীরা মুক্তি পেয়েছে ও নিরীহ লোকজন জেল খাটছেন, এমন একটি খবরের উৎস্য ছিলেন শেখ আব্দুস সোবহান। তিনি প্রথমে বিষয়টি আমাকে জানান। আমি এবং দৈনিক ইনকিলাবের শেখ আব্দুল ওয়াজেদ কচি সহ কয়েকজন বিষয়টি পর্যালোচনা করে এর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি।
কিছুটা তথ্য পেয়ে আইনজীবি সমিতির তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত এ্যাড. শামসুল হক(২) এবং সাধারন সম্পাদক এ্যাড. এসএম হায়দারের কাছে এই দূর্নীতি সংক্রান্ত কোন ডকুমেন্ট তাদের কাছে আছে কিনা জানতে চাইলে তারা সমিতির এক রেজুলিশনের বরাত দিয়ে জানান, মোট ৪৩টি অভিযোগ তাদের কাছে রয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি ছিল সাব জজের বিরুদ্ধে আর ১৪টি ছিল জেলা জজ নূর উদ্দিন সাহেবের বিরুদ্ধে। এই রিপোর্টটি আমরা ৩ জন শেখ আব্দুস সোবহান, আব্দুল ওয়াজেদ কচি এবং আমি নিজে সংগ্রহের পর
প্রস্তুত করে তা পত্রিকায় পরিবেশন করি। এর পরপরই আমরা তিনজনই প্রশাসনের রোষানলে পড়ি। আব্দুস সোবহান আব্দুল ওয়াজেদ
কচিকে তার বাড়িতে নিয়ে আত্মগোপনে রাখেন। এ ঘটনার শেষ পরিনতি হল সাতক্ষীরার প্রথম জেলা জর্জ নূর উদ্দিন আহমেদ এবং সাব জর্জ মোঃ কামাল উদ্দিন বদলি হয়ে যান। এর আগে উচ্চ পর্যায়ে তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। এই তদন্তে আমি সহ কয়েকজন স্বাক্ষ্য দিয়েছিলেন। শেখ আব্দুস সোবহানের সেদিনকার এই তথ্য উৎস্য আমাদেরকে উৎসাহিত করেছিল। যার ফলে জর্জ আদালতের মত একটি মর্যাদাবান প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের দূর্নীতি বাসা বাঁধতে পারে তা প্রমানিত হয়েছিল এবং যথাযথভাবে তা নিরসনও হয়েছিল। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১৯৭১ সালে শেখ আব্দুস সোবহান তখন গঠিত সংগ্রাম কমিটিরও সদস্য ছিলেন। মানুষকে পাকিস্তান সরকারের শোষন থেকে মুক্ত করার জন্য স্বাধিকার আন্দোলনে উৎসাহিত করেছিলেন।
বছর কয়েক আগে শেখ আব্দুস সোবহান বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হন। তিনি কয়েক দফা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহন করেন। এক পর্যায়ে তিনি প্যারালাইজড হয়ে পড়েন। সেই থেকে শেখ আব্দুস সোবহান আর জনসম্মুখে তেমনটি আসতেন না। মাঝেমধ্যে টেলিফোনে তিনি আমার সঙ্গে তো বটেই, অন্যদের সাথেও কথাবার্তা বলতেন। বিভিন্ন রিপোর্টের ব্যাপারে তথ্য সরবরাহ করতেন এমনকি সামাজিক ও রাজনৈতিক নানা ঘটনার ওপর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতেন। সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব শেখ আব্দুস সোবহানকে সদস্যপদ দিয়ে সম্মানিত করেছিল।
একজন বয়োবৃদ্ধ সাংবাদিক হিসাবে তার কর্মজীবনের ভূয়সী প্রশংসা করে তাকে ক্রেস্ট ও সম্মাননা পদক দেওয়া হয়। সেই আব্দুস সোবহান এখন অনন্তলোকে। ২২ নভেম্বর রোববার ভোরে তিনি তার বাড়ি গনপতি গ্রামে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যু আমাদের সাংবাদিক সমাজকে কাঁদিয়েছে। সাতক্ষীরার রাজনৈতিক মহল, সুধী সমাজ এবং আম জনতাকেও কাঁদিয়েছেন শেখ আব্দুস সোবহান। তার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি, সংবাদ মানসিকতা এ সবই ছিল সবার জানা। তিনি কারও সাথে ঝগড়ায় নামতেন না। শেখ আব্দুস সোবহান অত্যন্ত দরদী মানসিকতার ছিলেন। তার মধ্যে কোন বিলাস ছিল না, অহংকার ছিল না, নিজেকে কখনও খুব বড় করে ভাবতেও জানতেন না। সবার সাথে সমান ব্যবহার করতেন। যতদূর জানি বাড়িতে তার খুব বড় আকারের একটি বাঁশের ঝাড় ছিল। এই ঝাড় থেকে তিনি নিয়মিত বাঁশ কেটে তা বেচাকেনা করে সংসার নির্বাহ করতেন। নিরীহ সেই মানুষটিকে অনেকদিন সাতক্ষীরার বাসে চলাফেরা করতে দেখা যায়নি। সাতক্ষীরার সেই সাংবাদিক মজলিশ বহু আগে ভেঙেও গেছে। শেখ আব্দুস সোবহানকে সাতক্ষীরায় আর আসতে দেখা যায়নি। এমন অবস্থায় নিভৃত গ্রামের সবুজ ছায়াতলে শেখ আব্দুস সোবহান তার শেষ আশ্রয় খুজে নিলেন। তার এই চলে যাওয়া আমাদের হৃদয় থেকে প্রস্ফূটিত গোলাপের অন্তরধান। আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধাবনত।
*সুভাষ চৌধুরী- দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভির সাতক্ষীরা প্রতিনিধি