অনলাইন ডেস্ক: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বলতে আপাত দৃষ্টিতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিষয়টি সামনে আসলেও এর প্রভাবের পরিধি আরও বিস্তৃত। এবার নতুন এক অনুসন্ধান নিয়ে হাজির হয়েছেন গবেষকরা। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে বলে দাবি তাদের। জলবায়ু পরিবর্তনে বাড়ছে মাটির লবণাক্ততা। উপকূলীয় অঞ্চলে কমে যচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সেই পানি পানের কারণেই বাড়ছে রোগ আর গর্ভের সন্তান পড়ছে ঝুঁকিতে। এছাড়া এর প্রভাব পড়ছে স্বাভাবিক জীবন যাত্রায়ও। ফসল নষ্ট হচ্ছে। মিঠা পানির মাছের মৃত্যু হচ্ছে। জমির উর্বরতা হারানোর ফলে উপকূলীয় গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছেন অনেকে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় একটি ছোট গ্রামে গর্ভের সন্তান নষ্ট হয়ে যাওয়ার পরিমাণ বেশি হওয়ায় সন্দিহান হয়ে পড়েন গবেষকরা। শুরু করেন অনুসন্ধান। একটা সময় সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে এর জন্য দায়ী মূলত জলবায়ু পরিবর্তন। এরপর আবারও সেখানে অনুসন্ধানে যান ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির সাংবাদিক সুজানাহ স্যাভেজও।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের পূর্ব উপকূলে ছোট একটি গ্রামে বসবাস আল-মুন্নাহারের। তার তিন ছেলে। তবু কন্যাসন্তানের আশায় আবারও গর্ভধারণ করেছিলো। কিন্তু গর্ভেই মারা যায় শিশুটি। তবে গ্রামটিতে এমন ঘটনা নতুন নয়। বিজ্ঞানীরা খেয়াল করেন পাশ্ববর্তী অন্যান্য গ্রামের চেয়ে গর্ভে সন্তান নষ্ট হওয়ার বিষয়টি এখানে অনেক বেশি। আর এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন তারা।
ঘটনা অনুসন্ধানে ফাইলা পাড়া নামের ওই গ্রামটিতে যান বিজ্ঞানীরা। বিবিসি জানায়, শুষ্ক মৌসুমে সরু পথ ধরে একটি ডোবায় যান তারা। আর বৃষ্টি মৌসুমে সেটাই যেন হয়ে ওঠে সমুদ্র। গ্রামের পুরোটাই যেন কাঁদামাটির তৈরি। শুধু কয়েকটি কুঁড়ে ঘর ও মুরগির খোয়ার চোখে পড়ে।
মুন্নাহার বলেন, এখানে আর কিছু্ই জন্মায় না। অথচ আগে এমন ছিলো না। ১৯৯০ এর দশকের আগেও এই জমিতে ধান হতো। তিনি বলেন, তখন ধান উৎপাদন হয়তো লাভজনক ছিলো না। কিন্তু ভালো ছিলো। আর এখন পানি বেড়ে যাওয়া মাটিতে লবন বেড়ে গেছে। যারা একটু বিত্তশালী ছিলেন তারা চিংড়ি চাষ শুরু করেন। আর ধান উৎপাদন খুবই কমে যায়।
আইসিডিবিআরবি এর বিজ্ঞানী ড. মানজুর হানিফি বলেন, এটা জলবায়ু পরিবর্তনেরই প্রভাব। জমিতে এর পরিবর্তন দেখা যায়, কিন্তু মানবদেহে এর প্রভাব দৃশ্যমান না।
বিগত ৩০ বছর ধরে কক্সবাজারের নিকটবর্তী চকরিয়ায় বেশকয়েকটি এলাকায় স্বাস্থ্য কার্যক্রম ও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে আইসিডিডিআরবি। ফলে একদম ছোটখাটো পরিবর্তনও তাদের নজরে এসেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেক পরিবারই এই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। বেশিরভাগই গেছে একটু উঁচু বনাঞ্চলে। যাদের কাছে ঘুষ দেওয়ার মতো টাকা ছিলো তাদেরই ঠাঁই মিলেছে।
কাজল রেখা নামে এক নারী জানান, ‘আমরা এখানে বাড়ি বানানোর জন্য ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি।’ তিন বছর আগেই সেখানে চলে যাওয়া কাজল রেখা বলেন, মূলত পানির সমস্যার কারণে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন তিনি। উপকূলবর্তী অঞ্চলের পানির কারণে প্রায়ই তার ছেলেদের জ্বর আসতো। এখন তার জীবন অনেক সহজ বলেও জানান রেখা।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এই অভিবাসীরা আসলেই ভালো আছেন। নতুন স্থানে তারা ফসল উৎপাদন করতে পারছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো। আছে চাকরি ও শিক্ষার নিশ্চয়তাও। যারা থেকে গেছে তাদের চেয়ে শারীরিকভাবে সুস্থও আছেন গ্রাম ছেড়ে আসা এসব মানুষ।
আরও নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে যার সমুদ্র থেকে দূরে থাকেন তাদের বাচ্চা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পাহাড় ও সমতল অঞ্চলের ১২ হাজার ৮৬৭ জন গর্ভবতী নারীকে পর্যবেক্ষণ করেছে আইসিডিডিআরবি।
অনুসন্ধানে তারা দেখতে পান, যারা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে কিংবা ৭ মিটার উচ্চতায় থাকে, দূরবর্তী অঞ্চল থেকে তাদের গর্ভে সন্তান মারা যাওয়ার হার ১.৩ গুণ বেশি।
ড. হানিফি বলেন, পার্থক্য হয়তো খুব বেশি না। কিন্তু এই সন্তান মৃত্যুর হার বেড়েই চলেছে।
এছাড়া চকরিয়া থেকে মতলব অঞ্চল পর্যন্ত আইসিডিডিআরবির পর্যবেক্ষনে থাকা এলাকাগুলোতেও এই পার্থক্য স্পষ্ট। গর্ভে থাকা শিশু মৃত্যুর হার চকরিয়ায় ১১ শতাংশ আর মতলবে ৮।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই পার্থক্যের মূল কারণ হচ্ছে লবণাক্ত পানি। আর সেটার জন্য দায়ী জলবায়ু পরিবর্তন।
বৈশ্বিক উষ্ণতায় বরফ গলতে থাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়াও তাপমাত্র বৃদ্ধি ও চাপের প্রভাবেও বাড়ছে পৃষ্ঠের উচ্চতা। ড. হানিফি বলেন, বায়ুচাপ এক মিলিবার কমে গেলে সমুদ্রের উচ্চতা ১০ মিলিমিটার বেড়ে যায়। এতে করে উচ্চতা বেড়েই চলেছে। সমুদ্রের উচ্চতা বাড়লে লবণাক্ত পানি মিঠা পানির সাথে মিশে যায়। মিশে যায় মাটিতেও। বিশুদ্ধ পানি হয়ে পড়ে লবণাক্ত। আর গ্রামের মানুষ সেই পানি পানেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ে।
ফাইলাপাড়া গ্রামের পানিরপাম্প থেকে বের হওয়ার পানির রং কিছুটা লালচে। এটির স্বাদও লবণাক্ত। কিন্তু এরপরও এখান থেকেই পানি পান করছেন তারা, গোসল ও রান্নার কাজও চলছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দিনে ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু চকরিয়ায় একজন গ্রামবাসী প্রতিদিন ১৬ গ্রাম লবণ গ্রহণ করছে। সমতল কিংবা পাহাড়ি এলাকার চেয়ে যা তিন গুণেরও বেশি।
যুক্তরাজ্যে অনেক দিন ধরেই বেশি লবণ খাওয়ানো কমাতে প্রচারণা চলছে। এতে করে উচ্চচাপ, হৃদরোগ, হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে। আর গর্ভবতী নারীদের সন্তান নষ্ট হওয়ারও ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন কোনও প্রচারণা নেই। তারা জানেও না লবণাক্ত পানি পান করলে কি ক্ষতি হতে পারে।
ফাইলা পাড়ায় জন্ম নেওয়া ৫০ বছর বয়সী জনতারা বলেন, ফসলের জন্য লবণ খারাপ। কিন্তু তারপরও এই গ্রাম ছেড়ে যাবেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি হেসে বলেন, ‘আমি সারাজীবন এখানে থেকেছি। কোথায় যাবো আর। আমরা অনেক গরীব। যাওয়ার জায়গা নেই।
তবে তার ২৩ বছর বয়সী প্রতিবেশী শারমিন বলেন, তিনি এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে যান। কারণ তার দুই ছেলের এখানে কোনও ভবিষ্যত আছে কি না তা নিয়ে নিশ্চিত নন তিনি। আরেকটি সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনাও রয়েছে তার।
বর্তমানে শারমিন কিংবা আল-মুন্নাহারের মতো নারীদের সন্তান নষ্ট হওয়ার বিষয়টি হয়তো সেভাবে চোখে পড়ছে না। কিন্তু কিছু করা না হলে এটি আরও প্রকট আকার ধারণ করবে বলে মন্তব্য ড. হানিফির। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এর প্রভাব আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ নিচু এলাকায় হওয়ার কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতায় সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এখানে প্রায়ই বন্যা হয়। তবে অন্যান্য দেশও নিরাপদ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সব দেশেই পড়বে।
২০০৫ সালের সুনামির পর অনেক এলাকায় কৃষি জমি ও পরিষ্কার পানি নষ্ট হয়ে গেছে, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে ফ্লোরিডায় পরিষ্কার পান দূষিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু চকোরিয়ায় মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব দেখা যাচ্ছে, তা বিরল
আর কোথাও এমন কোন নিদর্শন দেখা যায়নি। ড. হানাফি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অনেক অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু গবেষণায় তেমন ব্যয় হয় না। জনস্বাস্থে প্রভাব রাখতে পারে তেমন কোথাও ব্যয় হয় না। সবাই শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য নিয়ে কেউ চিন্তা করছে না।