একের ওপর অপরের আধিপত্যবাদ কায়েমের জন্য মানুষের নিষ্ঠুরতার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বিরুদ্ধমতের মানুষের প্রতি মানবতাবিরোধী পাশবিক আচরণটা মানুষের আদিমতম অভ্যাস। আধুনিক কালে ভয়াল সেই অভ্যাস রহিত তো হয়নি বরং তার ব্যাপ্তি বেড়েছে বহুমাত্রায় বহুগুণে। মানবীয় ক্ষমতা বা সক্ষমতা ক্ষণস্থায়ী জেনেও মানুষ হাজার বছর ধরে নিজের অস্তিত্বকে পাকাপোক্ত করতে ভয়ানক যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হয়ে আসছে। মানুষ তার বেশির ভাগ জ্ঞান, উদ্ভাবন, শক্তি বা সম্পদ খরচ করে চলেছে তার প্রতিপক্ষকে হারাতে। প্রাগৈতিহাসিক পাথুরে যুদ্ধ থেকে হালের পরমাণু যুদ্ধের ধরন সবক্ষেত্রে একই : মানুষকে মেরে নিশ্চিহ্ন করে দাও। ঘটাও গণহত্যা আর শিশু বৃদ্ধা নির্বিশেষে নারীর সম্ভ্রম লুটে মায়ের জাতিকে দাও চরম অসম্মান। একাত্তরে ইতিহাসের নিরিখে ফেলে আসা সেইসব নিপীড়কের যথার্থ প্রতিভূ হয়ে ওঠেছিল পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী। একাত্তরে যাদের নোংরা রূপ দেখেছে সারাবিশ্ব।
আদিম গণহত্যা হতো অসচেতনভাবে। দাবি করা হয়, এসময়ের মানুষেরা খুব সচেতন। তারপরও একালে বেলজিয়ামের রাজা দ্বিতীয় লিওপোন্ডের হাতে আফ্রিকান কঙ্গোর এক কোটি মানুষ নৃশংসভাবে প্রাণ দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকাময় হলোকাস্ট; পৃথিবীর ইতিহাসে ভয়ানক ও জঘন্যতম গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত। যেখানে একনায়ক এডলফ হিটলারে নেতৃত্বে সোভিয়েত যুদ্ধবন্দি, কমিউনিস্ট এবং ভিন্ন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মতাদর্শীসহ প্রায় অর্ধকোটি ইহুদি প্রাণ হারান। ত্রিশের দশকে জাপানি সৈন্য কর্তৃক চীনা নানকিং ট্র্যাজেডি; যেখানে চারলাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়। এ ছাড়া আর্মেনীয়া, কম্বোডিয়ার খেমাররুজ, রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার গণহত্যা ইতিহাস স্বীকৃত।
সবকিছু ছাড়িয়ে বাঙালির কাছে স্মরণকালের সবচে বড় লোমহর্ষক ট্র্যাজেডি হলো একাত্তরের গণহত্যা। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন দমাতে যার শুরুটা হয়েছিল ২৫ মার্চ। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এই ২৫ মার্চ সরকারি সিদ্ধান্তে এবার থেকে গণহত্যা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় পালিত হচ্ছে।
একাত্তরের সেই ভয়াল কালরাতে বাঙালি জাতির ওপর নিষ্ঠুর, নির্মম ও নৃশংসতম গণহত্যা চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাংলাভূমিতে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল বীভৎস অভিশাপ। অকাতরে প্রাণ হারিয়েছিলেন বিভিন্ন পেশাজীবীসহ বিপুল সাধারণ বীরজনতা। দিনটি মানবসভ্যতার ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। বেদনাদায়ক সেই দিনটিকে বাঙালি মাত্রই মুষড়ে পড়া হৃদয় নিয়ে চোখের জলে স্মরণ করে থাকে।
স্বাধীনতা ঘোষণার প্রাক্কালে অসভ্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই হামলার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রারম্ভেই বিনষ্ট করা আর দেশের নেতৃস্থানীয় শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।
সেই সময়কার মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চের রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে সাত হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় আরো তিন হাজার লোককে। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শিয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সরা বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’
অথচ ১৬ ডিসেম্বর নাকে খত দিয়ে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করা সে হানাদার পাকিস্তান স্বাধীনতার ৪৫ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর তাদের ঘৃণ্যতম অপকর্মকে ঢেকে দিয়ে বিশ্বস্বীকৃত গণহত্যাকে অস্বীকার করবার প্রয়াস পাচ্ছে। তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা দূরে থাকুক উপরন্তু সম্প্রতি তাদের দেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জুনায়েদ আহমেদ নামের এক লেখক ‘ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, মিথস এক্সপ্লোডেড’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন। সে বই আবার বাংলাদেশ সরকারের কাছে পৌঁছেও দেওয়া হয়েছে। বইটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণহত্যা, ৩০ লাখ শহীদ, লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানি, সবকিছুর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। একে পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক একাত্তরের গণহত্যাকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার সচেতন প্রয়াস বলেই ধারণা করা যায়।
একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত কোনো গ্রন্থ এখনো রচনা করতে পারেননি বাংলাদেশি কোনো গবেষক। যদিও গণহত্যার বিষয়টি যে ধ্রুবসত্য তা প্রমাণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক এবং প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের অধ্যাপক গ্যারি জে ব্যাস। ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগটেন জেনোসাইড’ শিরোনামের বইটিতে লেখক হোয়াইট হাউজের নানা গোপন দলিল হাতড়ে বের করে এনেছেন আমেরিকা ও পাকিস্তানের যৌথ প্রযোজনায় মঞ্চস্থ গণহত্যার আসল ইতিহাস।
এই বইয়েই প্রথম কোনো পশ্চিমা গবেষক ১৯৭১-এ সংঘটিত বাংলাদেশের গণহত্যাকে ‘প্রমাণিত গণহত্যা’ হিসেবে বিশ্বের সামনে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। গ্যারি জে ব্যাস তাঁর বইয়ে স্পষ্টতই দাবি করছেন যে, ১৯৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছে, পাকিস্তানি সেনাদের চালানো সেই গণহত্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে, আর গণহত্যাকারীদের সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন নিক্সন-কিসিঞ্জার জুটি। বইটি বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতবার পাশাপাশি পশ্চিমা চিন্তাশীলদের মাঝে বাংলাদেশের একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে নতুন করে ভাবনা ও গবেষণার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই সঙ্গে দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের জন্য জাতিসংঘেও প্রস্তাবনা পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। গেল ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে গণহত্যা দিবস পালনের এই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় এবং সচিবালয়ে ১৩ মার্চ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণার বিষয়টি সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালনের জন্য ২৫ মার্চকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত একটি দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও মন্ত্রিসভার অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ায় এখন থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হবে। একাত্তরে লাখো প্রাণ আর সম্ভ্রমের দামে পাওয়া বাংলাদেশের কারুণ্যের ইতিহাসকে মানুষের মনে চির জাগরুক রাখতে সরকারের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। পাকিস্তানকে স্বীকার করতেই হবে যে, তারা একাত্তরে বাংলাদেশে চরম নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা চালিয়েছে। নিজেদের দোষ না ঢেকে পাকিস্তানকে তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতেই হবে।
আজ গণহত্যা দিবসে স্মরণ করি, ৩০ লাখ শহীদ ও জীবনের সর্বস্ব হারানো মা-বোনদের যাদের অমূল্য প্রাণ ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি লাল সবুজ পতাকা; পেয়েছি বাংলা নামের দেশমাতৃকা। পাকিস্তানিদের মতো বর্বরতার সাক্ষী না হোক আর কোনো মানবজাতি। আন্তর্জাতিকভাবে গণহত্যা দিবস পালনের মূল প্রতিপাদ্যই হোক- আর নয় গণহত্যা, মানুষের ভালোবাসায় সমুন্নত থাকুক বিশ্বমানুষের অধিকার।
লেখক : সংবাদকর্মী