আসাদুজ্জামান : ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে পড়েছে গোটা সাতক্ষীরা। উপকুলীয় উপজেলা শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটার কমপক্ষে ২২টি স্থানে উপকূল রক্ষা বাঁধ ভেঙে এবং ৩৪ টি স্থানে উপচে পড়া পানিতে চারটি উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ভেসে গেছে ৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ৭ হাজার ৫৬০ টি মৎস্য ঘের। এতে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে কয়েক হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি। সুন্দরবনে নোনা পানিতে মিষ্টি পানির পুকুর তলিয়ে একাকার হয়ে গেছে। এতে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির অভাব। তবে কৃষি ক্ষেত্রে তেমন কোন ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিকে, জেলা প্রশাসন থেকে ঘূর্ণঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত খাবার বরাদ্দের দাবি করা হলেও সে দাবির সত্যতা মেলেনি মাঠ পর্যায়ে। ইয়াস কাভার করতে সাতক্ষীরায় আসা একাত্তর টিভির বিশেষ প্রতিনিধি হাবিব রহমান গতকাল একটি লাইভ অনুষ্ঠানে ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীর ইপস্থিতিতে বলেছেন, তিনি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখেছেন শ্যামনগরের একটি আশ্রয় কেন্দ্রে নারী-শিশুসহ প্রায় ১০০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছিলেন তাদেরকে একমুঠো মুড়ি পর্যন্ত খেতে দেয়া হয়নি। এঘটনায় সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসকের কাছে খোঁজ নেবেন বলে অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী।
জানা যায়, গত বুধবার ভরা পূর্ণিমায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে নদ-নদীগুলোতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পায়। স্বাভাবিকের চেয়ে ৬ থেকে ৭ ফুট বেশি উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়। সাতক্ষীরার উপকুলীয় এলাকায় কমপক্ষে ৪০ টি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পানির অস্বাভাবিক তোড়ে কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও ইছামতি নদীর কমপক্ষে ২২ টি পয়েন্টের বেড়িবাঁধ ভেঙে যায় এবং ৩৪ টি স্থানে উপচে পড়া পানিতে চারটি উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ পানি বন্দী হয়ে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে বেশকিছু স্থানে বেঁড়িবাঁধ সংস্কার করতে সমর্থ হন। এদিকে ত্রাণ তৎপরতা চালানোর কথা বলেছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তবে অনেক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্তরা ত্রাণ পাননি বলে অভিযোগ করেন।
আশাশুনি উপজেলার সুভদ্রাকাটি গ্রামের সিরাজুল ইসলাম জানান, তার বাড়ি ডুবে গেছে। রান্নার কোন ব্যবস্থা নেই। বাইরে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জায়গা নেই। আশ্রয়কেন্দ্রও নেই। আমপানেও কোন ত্রাণ পাইনি। এবার এখনো একমুটো চিড়া-মুড়িও পাইনি।
শ্যমনগরের চাঁদনিমুখা গ্রামের ইবাদত হোসেন জানান, ক্লোজার বাঁধ ভেঙে আমার ৫০ বিঘা জমির তার ঘের ভেসে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে তার ক্ষতি হয়েছিল ২০ লাখ। এবার হলো আরো ২০ লাখ। অথচ প্রমত্তা ও ভয়ঙ্কর খোলপেটুয়া নদীর এই পয়েন্টের ভঙুর বাঁধের বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসওকে বলেছিলাম। তারা কোন কথা শোনেননি।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, গত বুধবার সকাল থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ চলছিল। তবে পরবর্তী জোয়ারে কয়েকটি স্থানে আবারো তা ধ্বসে পড়ে। বেড়িবাঁধ সংস্কারে ৬০ হাজার সিনথ্যাটিক ও ১০ হাজার জিও ব্যাগ সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশিউর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় বাঁধ উপচে ও বাঁধ ভেঙে ভসে গেছে ৬ হাজার ৭০০ হেক্টর জমির ৭ হাজার ৫৬০ টি মৎস্য ঘের। এতে প্রায় ৫৫ কোটি টাকার মাছের ক্ষতি হয়েছে। তিনি আরো জানান, আম্পানের চেয়েও ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। বর্তমানে ঘেরের মাছগুলো সব বিক্রির উপযোগী হয়েছিল। যে কারণে চাষিদের ক্ষতি বেশি হয়েছে।
সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল জানান, প্রাথমিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে আরও একটু সময় লাগবে। তবে এপর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে ধারণা করা হচ্ছে ১০ হাজারেরও বেশি ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ত্রাণ তৎপরতার বিষয়ে জেলা প্রশাসক আরো জানান, শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে আড়াইলাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া আশাশুনি ও শ্যামনগরে ৫০ মে.টন. করে এবং তালা ও কালিগঞ্জে ৫ টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ আরও বাড়বে বলে জানান তিনি।