অনলাইন ডেস্ক : রাখাইনের আকাশে এখন ঘন ঘন চক্কর দেয় না সামরিক হেলিকপ্টার। সেনারা যত্রতত্র গুলিবর্ষণ করছে না।
রোহিঙ্গা বসতি লক্ষ্য করে ছুড়ছে না রকেট লঞ্চার ও বোমা। রোহিঙ্গাদের দেখলে আগে যেমন সেনারা হামলে পড়ত, সে রকম ভয়ংকর দৃশ্যও নেই। নির্যাতন-নিপীড়নের ধরন পাল্টে গেছে। সেনারা এখন দৃশ্যমান নির্যাতনের পথ পরিহার করে নীরব নির্যাতন চালাচ্ছে। ২৫ আগস্টের পর রোহিঙ্গা বসতিতে ঘরে ঘরে গিয়ে সেনারা নারীদের গণধর্ষণ করত। এখন সেনা ক্যাম্পেই সুন্দরী নারীদের সরবরাহ করতে অলিখিত ফরমান জারি করা হয়েছে। আদেশ অমান্য করলে পরিণতির জন্য রোহিঙ্গাদের প্রস্তুত থাকতে বলার পর থেকেই আবারও সীমান্তে রোহিঙ্গার ঢল নেমেছে। গতকাল মঙ্গলবার সীমান্ত এলাকা ঘুরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে এসব।
রাখাইনের বুচিদং টাউনশিপের কুয়াইনডাইং রোয়াজি নামের গ্রামের বাসিন্দা আবদুস সালাম (৪৪) ও তাঁর স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৪০) দম্পতি তাঁদের আট সন্তান নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকালে উখিয়ার পালংখালী এসে পৌঁছেন।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের গয়ালমারা এলাকায় কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের পাশের একটি গাছের ছায়ায় আরো বেশ কিছু দেশত্যাগী রোহিঙ্গার সঙ্গে বসে ছিলেন এই দম্পতি। সবেমাত্র নাফ নদের আঞ্জুমান প্যারা ঘাট এলাকা থেকে হেঁটে মহাসড়কে উঠেছেন। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। এ প্রতিবেদক যখন রোহিঙ্গা পরিবারটির সঙ্গে আলাপ করছিলেন তখনই একজন সেনা সদস্য এগিয়ে এসে নাম-পরিচয় জেনে নিচ্ছিলেন। সেনা সদস্য দেখে রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যরা প্রথমে হতবিহ্বল হলেও পরে বুঝতে পারে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত।
এত দিন ধরে জ্বালাও-পোড়াও চলেছে, কিন্তু তখন আসা হয়নি। আর এখন রাখাইনে এক ধরনের শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে, এখন কেন এলেন? এমন প্রশ্ন শুনেই রোহিঙ্গা আবদুস সালামের স্ত্রী রোকেয়া জানান—‘বদ্দারে, এই মাইয়াগুন যদি ন থাইত তইলে আঁই মরি গেইলও এডে ন আইতাম। মাইয়াগুনর ইজ্জত বাঁচাইবাল্লাই এডে আস্যিদে। ’ অর্থাৎ ‘বড় ভাইরে, আমার এসব মেয়ে যদি না থাকত তাহলে আমি মারা গেলেও এখানে আসতাম না। মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাতেই এখানে আসা। ’ সালাম-রোকেয়া দম্পতির আট সন্তানের মধ্যে সাতজনই মেয়ে। বড় মেয়ের বয়স ২২ বছর এবং কনিষ্ঠ যমজ এক মেয়ে ও এক ছেলের বয়স মাত্র ১১ মাস। ১৯৯১ সালে প্রথমবার পালিয়ে আসার পর ১৯৯৪ সালে ঘুমধুম ২ নম্বর রোহিঙ্গা শিবিরে দুজন বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৯৬ সালে ফিরে যান। বিয়ের ২৩ বছরের মাথায় এই দম্পতি আটটি সন্তান নিয়ে গতকাল আবারও এসেছেন বাংলাদেশে।
রোকেয়া বলেন, ‘আমাদের পার্শ্ববর্তী আর্মি টেরাং (সেনা ক্যাম্প) থেকে নতুন ফরমান জারি করা হয়েছে। তারা বলেছে, প্রতি পাড়া থেকেই ৫০ জন করে সুন্দরী নারী ক্যাম্পে সরবরাহ করতে হবে। গ্রামের চেয়ারম্যান (ওকাট্টা) রফিউল কাদেরকে সেনা ক্যাম্পে ডাকা হয়েছিল। সেনা ক্যাম্প থেকে চেয়ারম্যানকে এমন ফরমান জারি করা হয়। চেয়ারম্যান ক্যাম্প থেকে ফিরে গ্রামের যে ঘরে তরুণী মেয়ে রয়েছে তাদের গৃহকর্তাকে গোপনে ডেকে সেনা ক্যাম্পের ফরমানের কথাটি জানিয়ে দেন। গত ২ অক্টোবর রাতে চেয়ারম্যান সেনা ক্যাম্পের ফরমানের গোপন কথাটি জানানোর পরের দিন ভোরেই সালাম-রোকেয়া দম্পতি বাংলাদেশের দিকে রওনা হন। রোকেয়া বেগম বলেন, ‘এমন খবর শুনে রাতে আর ঘুমাতে পারিনি। ’ তিনি জানান, কমপক্ষে সাত-আট দিন রাস্তায় থাকতে হবে অনুমান করে এমনভাবেই খাবারদাবারের ব্যবস্থা করছিলেন সারা রাত ধরে।
ভাত রান্না করে সেসব যাতে গন্ধ না হয় সে জন্য তেলে ভেজে নেন তিনি। কোরবানির যে গরুর মাংস ছিল সেসব কালো ভুনা করে নেওয়া হয়। প্রচুর পরিমাণ স্যালাইন নেওয়া হয় সঙ্গে। দুগ্ধপোষ্য যমজ সন্তানদের জন্যও দুধের বিকল্প নেওয়া হয়। নাশতাও নেওয়া হয় প্রচুর। রোকেয়া বলেন, তিনি অত্যন্ত পরিকল্পনামাফিক বের হয়েছিলেন ঘর থেকে। টানা সাত দিনের হাঁটাপথের সীমানা নাফ নদের তীরে এসে পৌঁঁছার সঙ্গে সঙ্গে খাবারও শেষ হয়ে যায়, বলেন রোকেয়া।
মিয়ানমার সেনাদের নীরব নির্যাতনের কাহিনি জানাতে গিয়ে রোকেয়া বলেন, তাঁর স্বামীর এক বড় ভাইয়ের শিশুসন্তান ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। তার জন্য ওষুধ আনা হচ্ছিল বাজার থেকে। পথে তল্লাশি করতে গিয়ে সিরাপের বোতল পেয়ে সেনারা বোতলটি বুটের তলায় পিষ্ট করে, আর বলে ওষুধ সেবনের কোনো দরকার নেই। এখন দরকার মৃত্যু। রোকেয়া জানান, মিয়ানমারের সেনারা প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গাদের মৃত্যু কামনা করে থাকে।
রাখাইনের মংডুর বালুখালী থেকে পালিয়ে এসেছেন মোস্তফা খাতুন ও সোনা মিয়া দম্পতি। তাঁদের তিন কন্যা। সোমবার রাতে নাফ নদ পাড়ি দেন তাঁরা। নিজেদের মৃত্যুর ভয় অনেক আগেই কেটে গেছে। এসেছেন কেবল তাঁদের তিন কন্যার ইজ্জত বাঁচাতে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেনা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নারী সরবরাহের ফরমানটি রাখাইনে নতুন করে আতঙ্ক ছড়ায়। এত দিন যারা সাহসের সঙ্গে রাখাইনের ঘরদুয়ারে বা বন-জঙ্গলে লুকিয়ে ছিল তারা খবরটি শোনার পর পালিয়ে আসতে শুরু করেছে।
সেনাদের ভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে আরো আছেন বুচিদং লইংচং গ্রামের নবদম্পতি জিয়াউর রহমান (১৮) ও আয়েশা বেগম (১৫)। তাঁরা ১০ দিন ধরে দুর্গম পাহাড়ের ফাতেহার ঢালা নামের একটি গহিন জঙ্গলে অবস্থান নিয়েছিলেন। নিরাপত্তা বাড়াতে পরে একসঙ্গে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা একত্র হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে আসে। নতুন আসা রোহিঙ্গারা জানায়, পথে পথে তারা অনেক স্থানে সেনা সদস্যদের মুখে পড়েছে কিন্তু কেউ তাদের তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। উল্টো অনেকেই নাকি আবার জানতে চেয়েছে, তোমাদের তো কিছু করা হচ্ছে না—কেন পালিয়ে যাচ্ছ? রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, এখনো অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পথে রয়েছে।