অনলাইন ডেস্ক: মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি করছে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এগুলো দেশের বাজারে বিক্রি করে একদিকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা পকেটে ভরছে, অন্যদিকে অবৈধ পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করা হচ্ছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এনবিআরের শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর এবং বন্দরসংশ্লিষ্ট শুল্ক শাখার কর্মকর্তারা গত বছর এ ধরনের অবৈধ পণ্যের ১৯টি চালান জব্দ করেছেন।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, জব্দ করা এসব চালানের পণ্য আমদানির দাম হিসেবে ৪২ কোটি ৩৬ লাখ ১২ হাজার টাকা বিদেশে পাঠানো হয়েছে। অথচ বাজারমূল্য যাচাই করে এনবিআর নিশ্চিত হয় যে মানসম্মত ও ব্যবহার উপযোগী একই পরিমাণ পণ্য আমদানি করা হলেও ৩০ কোটি টাকার বেশি পরিশোধের প্রয়োজন হতো না। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ ধরনের অবৈধ পণ্য আমদানির নামে অর্থ পাচার করছে।
শুধু এনবিআরই নয়, সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরও প্রতিবছর অভিযান চালিয়ে এ ধরনের অবৈধ ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী উদ্ধার করে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন লেন, ‘যেকোনো ওষুধসামগ্রী আমদানির আগে অবশ্যই ওই ওষুধের বিস্তারিত বিবরণ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানাতে হয়। সেই সঙ্গে আগে ওই ওষুধের রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। এর কোনো রকম ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো ওষুধ বা চিকিৎসাসামগ্রী দেশে আনা হলে তা অবৈধ বলে বিবেচিত হয়। মাঝেমধ্যেই আমরা বাজারে মনিটরিং ও অভিযানের মাধ্যমে এমন অনেক অবৈধ ওষুধ জব্দ করে থাকি।’
বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম বিক্রির তথ্য পাওয়ার পর জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য আমদানি বন্ধে এরই মধ্যে নজরদারি বাড়িয়েছে এনবিআরের শুল্ক শাখা। নজরদারি বাড়াতে সম্প্রতি বিভিন্ন বন্দরের শুল্ক শাখার কর্মকর্তা ও শুল্ক গোয়েন্দাদের সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। এ টাস্কফোর্স শুধু বন্দরে আমদানি করা ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নজরদারি করছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, বাস্তবে অস্তিত্বহীন নামসর্বস্ব ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে এসব অবৈধ পণ্য বেশি আমদানি করা হচ্ছে। কখনো কখনো নামিদামি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করেও জাল কাগজপত্রে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এসব পণ্য আনা হয়। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও মানহীন চিকিৎসা সরঞ্জাম সবচেয়ে বেশি আনা হচ্ছে চীন, কোরিয়া, ভারত, ভিয়েতনাম ও তাইওয়ান থেকে।
এনবিআর কর্মকর্তারা বলছেন, জরুরি চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য আমদানি করা হয়েছে, এমন কারণ দেখিয়ে বন্দর থেকে এসব অবৈধ পণ্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছাড় করার সুবিধা নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বন্দরে ব্যবহৃত স্ক্যানার মেশিনে কার্টনের মধ্যে বা প্যাকেটজাত অবস্থায় মেয়াদোত্তীর্ণ বা মানহীন পণ্য আছে কি না তা অনেক সময়ে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। এ ছাড়া একই চালানে বেশি পরিমাণে পণ্য আনায় সবগুলো আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখা সম্ভব হয় না। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকার নাম থাকলেও ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভারের বিভিন্ন স্থানই বেশি উল্লেখ থাকে। আর এসব পণ্য ছাড় করার ক্ষেত্রে আমদানিকারক নিজে না এসে প্রতিনিধি পাঠায়। ওই প্রতিনিধিরা পর্যন্ত জানে না কার বা কোন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে পণ্য ছাড় করার জন্য তারা বন্দরে এসেছে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, ছাড় হওয়ার পর ভাড়া করা পরিবহনে এসব অবৈধ পণ্য বন্দর থেকে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছানো হয়। অর্থের বিনিময়ে সাময়িকভাবে এসব ব্যক্তি ও পরিবহন অবৈধ পণ্য ছাড় করার ও পরিবহনে কাজে লাগানো হয়। এসব ব্যক্তি বা পরিবহন আটক করা হলেও আমদানিকারকের খোঁজ পাওয়া যায় না। ভিন্ন চালানে ভিন্ন ব্যক্তি ও পরিবহন ব্যবহার করা হয়।
সূত্র আরো জানায়, অবৈধভাবে এসব পণ্যের আমদানিকারক এবং স্থানীয় পর্যায়ের বিক্রেতারা ভিন্ন হয়ে থাকে। আন্তর্জাতিক চক্রের সহায়তায় এসব অবৈধ পণ্য নিয়ে আসছে দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা। এদের কাছ থেকে আরেক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাইকারি কিনে মজুদ রাখে। পরে সুবিধামতো সময়ে এসব অবৈধ পণ্য বাজারে সরবরাহ করা হয়।
সাধারণত ছোটখাটো দোকান ও হাসপাতাল বা ক্লিনিকে অপেক্ষাকৃত কম দামে এসব পণ্য বিক্রি করা হয়। অনেক সময় ব্যবহার উপযোগী ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের সঙ্গে মিশিয়েও বিক্রি করা হয়। অপেক্ষাকৃত কম দামে পাওয়ায় ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা আগ্রহ নিয়েই এগুলো কিনে থাকে। আবার সহজে বিক্রি হওয়ায় ওই ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়ে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান বলেন, ‘বন্দরে পণ্য পৌঁছানোর পর পণ্যের চালান যাচাই করে দেখা হয়। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম দেশে প্রবেশে আটকাতে নজরদারি বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে।’
সূত্র: কালের কণ্ঠ।