নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে মোট অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে ডাক্তারি সনদে জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের অফিস সহকারি আক্তার হোসেনের বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার সিভিল সার্জনের কাছে অভিযোগ করে প্রতিকার না পাওয়ায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও দুদকের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা থানার এনায়েতপুর শানতলা গ্রামের শাহাবাজ হোসেনের মেয়ে বেবী নাজমিম এর অভিযোগপত্র থেকে জানা যায়, গত ২৮ মে দুপুর দেড়টার দিকে পল্লী বিদ্যুতের লোকজন তাদের বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে এলে বাধা দেয় প্রতিবেশী আব্দুর রহমান ফকির, আনারুল ফকির ও আলম ফকিরসহ তাদের পরিবারের মহিলা সদস্যরা। প্রতিবাদ করায় তাকে মাথায় কোপ মেরে ও বোন মারুফাকে মাথায় লোহার রড দিয়ে আঘাত করে জখম করা হয়। স্থানীয়রা তাদেরকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে।
বেবি নাজমিম আরো জানান, তারা ভর্তি হওয়ার আগেই হাসপাতাল গেটে অবস্থান করা অফিস সহকারি কাম ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ড মাষ্টার আক্তার হোসেনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় হাসপাতালের মাষ্টার রোলে কর্মরত তাদেরই গ্রামের রুবেল ওরফে শামীম। ভাল চিকিৎসা পাওয়ার জন্য তারাসহ মা সাবিনা পারভিন কয়েক দফায় আক্তার হোসেনের সঙ্গে দেখা করেন। তবে ২৯ মে ডাঃ শরিফুল ইসলাম তাদের দু’ বোনকে ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বললে তারা আপত্তি জানায়। তার মাথায় ছয়টি সেলাই ও বোন মারুফার মাথায় গভীর ক্ষতের ফলে চারটি সেলাই দেওয়া অবস্থায় ২৪ ঘণ্টা পার না হতেই ছাড়পত্র দেওয়ার কথা বলায় তারা অসহায় হয়ে পড়েন। পরদিন একজন নার্স এসে তাদেরকে এক্স-রে করার জন্য দু’টি স্লিপ ধরিয়ে দিলে তারা আক্তার হোসেনের কাছে চলে যান। আক্তার হোসেন একজন নার্স বা আয়াকে ডেকে তাদেরকে নিয়ে ১২৫ নং কক্ষে এক্স-রে করে আসতে বলেন। আক্তার হোসেনের কথামত দু’জনের এক্স-রে বাবদ ৭০০ টাকাতাদের সঙ্গে থাকা নার্সকে দিয়ে দেয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ওই নার্স তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ১২৫ নং কক্ষে যেয়ে তাকে ও মারুফাকে পর্যায়ক্রমে এক্সরে ট্রলীতে তোলেন। কয়েকটি স্লুইজে চেপে আলো জ্বেলে এক্স-রে হয়ে গেছে, প্লেট বিকেলে তিনি নিয়ে যাবেন বলে ওয়ার্ডে যেতে বলেন। বিকেল ৬টার দিকে ওই নারী দু’টি প্লেট নিয়ে তাদের কাছে রেখে দেন। ৩১ মে সকালে ছাড়পত্র দেওয়ার পর তারা এক্স-রে প্লেট, এক্স-রে স্লিপ ও ছাড়পত্র নিয়ে আক্তার হোসেনের অফিসে যান। আক্তার হোসেন এক্স-রে প্লেট ও স্লিপ টি নিয়ে এমসি দেওয়ার সময় তা আদালতে পাঠিয়ে দেবেন বলে জানান। এ সময় আক্তার হোসেন ছাড়পত্রে লেখা ডাঃ শরিফুল ইসলামের স্বাক্ষরের নীচে থাকা তারিখটি কাটাকাটি করে ৩০ মে লিখে তাকে দেন। ওই দিন শামীম তাকে জানায় যে, হামলাকারি আব্দুর রহমান ফকিরের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে সে আক্তার হোসেনকে দিয়েছে। যে কারণে তাদেরকে তড়িঘড়ি করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে আক্তার হোসেনের নির্দেশে। এমনকি এমসি দুর্বল করে তাদেরকে জামিনে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন আক্তার হোসেন। কয়েকদিন না যেতেই থানা থেকে মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা উপপরিদর্শক শাহাদাতুল আলম আবেদন করার আগেই তড়িঘড়ি করে আক্তার হোসেন ২৩ জুন এমসি পাঠিয়ে দেন। দু’ বোনের মাথায় গভীর ক্ষত হওয়ার কারণে কয়েকটি সেলাই দেওয়ার পরও এমসিতে ছেলা জখম বলে উল্লেখ করায় তারা অবাক হন। হাসপতালে তারা ডাঃ শরিফুল ইসলামের কাছে চিকিৎসা নিলেও তাকে বাদ দিয়ে এমসিতে মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসক হিসেবে ডাঃ পরিমল কুমার বিশ্বাস, ডাঃ মোঃ মাহাবুবর রহমান ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফরহাদ জামিল সাক্ষর করেছেন। এমসিতে এক্স-রে করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়। একপর্যায়ে তারা সোমবার একজন আইনজীবী ও একজন সাংবাদিককে নিয়ে সিভিল সার্জনের কাছে গেলে মঙ্গলবার সকাল ৯টায় তিনি সংশ্লিষ্ট ডাঃ শরিফুল ইসলামকে নিয়ে পর্যালোচনায় বসবেন বলে জানিয়ে তাদেরকেও ওই সময়ে আসতে বলেন।
বেবী অভিযোগ করে বলেন, মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে তারা হাসপাতালে গেলে আক্তার হোসেন ও আবাসিক মেডিকেল অফিসারের সামনে তাদের কাছে বিস্তারিত জানতে চান সিভিল সার্জন ডাঃ তওহিদুর রহমান। এ সময় ডাঃ শরিফফুল ইসলামকে থাকার জন্য বললে তিনি তাতে কর্ণপাত করেননি। উপরন্তু আক্তারকে ভাল লোক হিসেবে চিহ্নিত করে তাদেরকে মিথ্যাবাদি বলে প্রমাণ করানোর চেষ্টা করেন সিভিল সার্জন ও আরএমও। ৩০ মে সকাল ১০ টার দিকে ওই ওয়ার্ডে যে নার্স ডিউটি করেছে তাদেরকে আনলে চিনতে পারবো বলার পরও মাত্র একজনকে ডেকে আনা হয়।একপর্যায়ে হাসপাতালে রক্ষিত তাদের চিকিৎসা ফাইলে তারা এক্স-রে করবে না বলে তাদের দু’টি টিপসহি ও তাদের মায়ের টিপ সহি ও মোবাইল নম্বর দেখানো হয়। মারুফা মাষ্টার্স পড়ছে ও সে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার পর কিভাবে তাদের টিপসহি দিয়েছে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন তাদেরকে মামলা করে টিপ সহি চ্যালেঞ্জ করতে বলেন।
এদিকে কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, গত বছরের আশাশুনি উপজেলার সুভদ্রকাটি গ্রামের অষ্টম শ্রেণীর এক মাদ্রাসা ছাত্রীকে শহরতলীর এল্লারচরে এনে গণধর্ষণ করা হয়। তাকে পুলিশ উদ্ধার করে পরদিনওই সদর হাসপাতালে ডাক্তারি পরীক্ষা করায়। সদর হাসপাতালে পাঠানো এমসিতে ধর্ষণের কোন আলামত মেলেনি। অথচ মহাখালির ভিসেরা রিপোর্টে ধর্ষণের আলামত পাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। সদর হাসপাতালের প্রতিবেদন পরিবর্তণ করতে প্রভাবশালী আসামী সোহরাব হোসেনের কাছ থেকে আক্তার হোসেন এক লাখ টাকা গ্রহণ করে বলে একধিক সূত্রে জানা যায়। এ ছাড়াও দুর্বল এমসি দেওয়ার জন্য ও এমসি গ্রিভিয়াস করার জন্য সদর হাসপাতালের সবচেয়ে বড় ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আক্তার হোসেন পরিচিতি লাভ করেছেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্বাস্থ্য কর্মী জানান।
আর্থিক সুবিধা নিয়ে বেবী, মারুফা ও সুভদ্রাকাটির অষ্টম শ্রেণীর মাদ্রাসা ছাত্রীর ডাক্তারি সনদসহ যে কোন ডাক্তারি সনদ জালিয়াতির অভিযোগ অস্বীকার করে সদর হাসপাতালের অফিস সহকারি আক্তার হোসেন বলেন, তাকে অহেতুক জড়ানো হচ্ছে। কারণ কোন ডাক্তারি সনদে তার সাক্ষর থাকে না।
তবে সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন ডাক্তার তওহিদুর রহমান ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ ফরহাদ জামিল জানান, বেবী ও মারুফার অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই। তবে তারা এক্স-রে করবে না বলে যে টিপসহি দিয়েছে তা তাদেরই না হলে মামলা করতে পারে। কেবলমাত্র কেবিন পাওয়ার জন্য আক্তার হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা লাগে বলে উল্লেখ করে তারা বলেন, শিক্ষিত মেয়েরা এধরণের ভুল করলে বিশ্বাস করবেন কিভাবে।
সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের অফিস সহকারি আক্তারের বিরুদ্ধে ডাক্তারি সনদ জালিয়াতির অভিযোগ
পূর্ববর্তী পোস্ট