প্রাথমিক শিক্ষা হলো বুনিয়াদী শিক্ষা। এই শিক্ষা’ই মোটামুটি নির্ধারণ করে দেয় শিশুর ভবিষ্যৎ জীবন। কেননা, প্রাথমিক শিক্ষা’ই শিশুকে পরবর্তী ধাপের শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। ‘প্রাথমিক শিক্ষা চক্রে’ বর্তমানে শিশুর জন্য ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা রয়েছে। যে গুলো অর্জন করা একজন শিশুর জন্য অতীব জরুরী। খাদ্য তৈরীর জন্য গাছের পাতায় ‘ক্লোরোফিল’ যেমন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ঠিক তেমনি আজকের শিশুকে একজন পরিপূর্ণ ‘মানুষ’ হয়ে উঠার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হলো প্রাথমিক শিক্ষা চক্রের জন্য নির্ধারিত এই ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা। কোন শিশু যদি সফলতার সাথে এই যোগ্যতা সমূহ অর্জন করতে পারে তাহলে নি:সন্দেহে পরবর্তী শিক্ষা গ্রহনের জন্য তার ভীত অত্যন্ত মজবুত হবে। একটি মজবুত ফাউন্ডেশনের উপর একজন নির্মাতা/মালিক যেমন বহুতল ভবন করার স্বপ্ন দেখতে পারেন, ঠিক তেমনি ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জনকারী একজন শিশুকে নিয়ে আমরা ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিব -এই স্বপ্ন আমরা দেখতেই পারি। প্রখ্যাত চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াস-এর একটি বহুল প্রচলিত উক্তি–‘‘যদি তোমার পরিকল্পনা হয় ১ বছরের তাহলে ধান লাগাও,যদি পরিকল্পনা হয় ১০ বছরের তাহলে গাছ লাগাও আর যদি পরিকল্পনা হয় ১০০ বছরের তাহলে জাতিকে শিক্ষিত করো।” স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের পুর্ন:গঠনের কাজে হাত দিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধীনায়ক,বাংলাদেশের স্থাপতি ,সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী, তৃতীয় বিশ্বের গণ মানুষের দাবী আদায়ের অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সোনার বাংলা গড়তে তিনি সোনার মানুষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। অনুসরণ করলেন কনফুসিয়াসের বাতলে দেওয়া পথ। ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই জাতীয়করণ করলেন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ৩৬,৭১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে। এর মধ্যদিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আশা, আকাঙ্খা ও প্রত্যাশা-প্রাপ্তির এক জোয়ার এসে জাতিকে বিভোর করে তুললো। শিক্ষা নামক তরীতে যুক্ত হলো বিশাল আকৃতির পাল। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলল বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা। মহান নেতার সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই পালের অবয়ব বৃদ্ধি করলেন ২০১৩ সালে আরো ২৬,১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করার মাধ্যমে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে গ্রহণ করা হলো বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প। শিক্ষকগণের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদী বৃদ্ধি করা হলো, ব্যবস্থা নেওয়া হলো -তাদের জন্য উন্নত ও সময়োপযোগী সব ধরনের প্রশিক্ষণের, বিদ্যালয়ে সরবরাহ করা হলো ল্যাপটপ,মাল্টিমিডিয়া,প্রজেক্টর প্রভৃতি ডিজিটাল ডিভাইস। শিক্ষার্থীদের মধ্যে গনতান্ত্রিক মনোভাব শৈশব থেকেই জাগ্রত করার জন্য ‘স্টুডেন্ট কাউন্সিল’ গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ‘ক্ষুদে ডাক্তারের’ ন্যায় প্রশংসনীয় কার্যক্রম চালু রয়েছে বিদ্যালয়ে, চালু রয়েছে -কাবিং কার্যক্রম। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্ণামেন্ট চালু রয়েছে, ক্রীড়াঙ্গনে যার সুফল বাংলাদেশ ইতোমধ্যে পেয়েছে। শুধু ক্রীড়াঙ্গনে নয়, সমাজের প্রায় ৯৮%শিশুকে বিদ্যালয়ে আনা সম্ভব হয়েছে , সম্ভব হয়েছে ঝরে পড়ার হার উল্লেখযোগ্য পরিমানে হ্রাস করা। এর প্রেক্ষিতে, নির্ধারিত সময়ের পূর্বেইMillennium Development Goals Gi Goal-2 Gi Universal Primary Education অর্জন করে বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা( Sustaiable Development Goals) Gi Goal-4 এ ঘোষিত মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণের জন্য ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। এতদ্বসত্ত্বে ও প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত মান কিন্তু এখনো কাঙ্খিত পর্যায়ের কাছাকাছি ও পৌঁছায়নি। মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের পাশাপাশি ‘মা’ কে তাই রাখতে হবে অগ্রনী ভূমিকা। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়-পৃথিবীতে যত মহামানব এসেছেন,যত মানুষ অন্যের জন্য আলোকবর্তীকা হয়েছেন তাঁদের প্রত্যেকের পিছনে তাঁদের মায়েদের অসমান্য অবদান রয়েছে। বিখ্যাত সূফী সাধক খাঁজা মঈনুদ্দীন চিশতি(রহ.)এক সফর শেষে এসে তাঁর মাকে বলছেন- আম্মাজান এই সফরে লক্ষাধিক মানুষ আমার হাতে বাইয়্যাত গ্রহণ করে মুসলমান হয়েছেন। তাঁর এই কথা শুনে তাঁর আম্মা বলছেন- বাবা এর জন্য তোমার বিশেষ কোন কৃতিত্ব নাই। এই বুর্জগীতো আমার, বিনা ওজুতে আমি তোমাকে কখনো দুধ পান করাই নাই। আমরা যদি বর্তমান সময়ের প্রতি একটু লক্ষ্য করি দেখতে পাবো অধিকাংশ মায়েরা কি পরিমানে বাজে কাজে (বিভিন্ন সিরিয়াল দেখা, ফেসবুক চালানো, অন্যের সাথে অযথা গল্প গুজুব করা প্রভৃতিতে) ব্যস্ত সময় পার করছেন। সন্তানের সাফল্যে নিজেকে অংশীদার বানানোর চিন্তা আজকে আমাদের মায়েদের কল্পনায়’ই আসছেনা না। সাধারণত শিশুর জন্মের পর এবং বিদ্যালয়ে যাওয়ার পূর্বে তার মায়ের কাছেই শিক্ষার হাতে খড়ি হয়ে থাকে। সে সময় মা তাকে যেরুপ শিক্ষা দেয়, পরবর্তী জীবনে তার একটি প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরুপ, আমরা হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) এর জীবনের ২/১টি ঘটনা উল্লেখ করতে পারি। মক্তবের শিক্ষক হযরত আব্দুল কাদের জিলানী(রহ.) কে আউযু বিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ সবক দানের সাথে সাথে আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) কুরআন মাজিদের প্রথম থেকে আঠারো পারা পর্যন্ত মুখুস্ত বলে ফেললেন। মক্তবের শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, হে বৎস! তুমি কিভাবে কুরআন মুখুস্ত করেছো! আজ মক্তবে তোমার প্রথম দিন। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী(রহ.) বলেন, আমার মাতা ১৮ পারা পর্যন্ত কুরআন মুখুস্ত করেছিলেন। আমি গর্ভে থাকা কালীন সময়ে তিনি কুরআন পাঠ করতেন। আমি মায়ের তেলাওয়াত শুনেশুনে ১৮ পারা পর্যন্ত কুরআন মুখুস্ত করে ফেলেছি। আজ আমাদের মায়েদের কাছ থেকে আমাদের সন্তানেরা কী শিখছে?। সন্তান গর্ভে থাকলে আজকে অধিকাংশ মায়েদের অবসর যেন কাটতেই চায় না। অলস সময় তারা যে কিভাবে পার করেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। সত্যবাদিতা ,নৈতিকতা বই পড়ে অর্জনের কোন বিষয় না,এটি পরিবার থেকে চর্চার বিষয়। যার সূচনা হয় মায়ের হাত ধরেই, কারণ-শিশু যে তার মাকেই সবচেয়ে বেশি অনুসরণ করে। পড়াশুনার উদ্দেশ্যে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী(রহ.) ব্যবসায়িক কাফেলার সাথে বাগদাদ যাওয়ার পথে ডাকাতের কবলে পড়লেন। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী(রহ.)কে ডাকাত সর্দার জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার সাথে কি আছে? তিনি বললেন আমার নিকট ৪০টি স্বর্ণ মুদ্রা আছে। ডাকাত সর্দার আশ্চার্যন্বিত হয়ে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন,হে যুবক! তুমি তো মিথ্যা কথা বলে আমার নিকট থেকে স্বর্ণ মুদ্রা লুকাতে পারতে। হযরত আব্দুল কাদের জিলানী(রহ.) বললেন-মিথ্যা কথা বলতে আমার ‘মা’ নিষেধ করেছেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঐ ডাকাত সর্দার সহ আরো ৬০ জন অশ্বারোহী ডাকাত নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অন্ধকার জগত থেকে আলোর পথে ফিরে আসল। আজ সমাজে এ রকম মায়ের খুবই অভাব। বাড়িতে সন্তানের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কোন রকমে দায়সারাভাবে অধিকাংশ ‘মা’ তার সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছে। যখন তার সন্তানের পড়ালেখার জন্য বিদ্যালয়ে মা সমাবেশের আয়োজন করা হচ্ছে, হাতে গোনা কয়েকজন মা আসছেন। মিড-ডে মিল বাস্তবায়নে বিদ্যালয়কে সহায়তার পরিবর্তে পরিবারের অন্যান্য সদস্য নিয়ে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন, অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সব দায় যেন সরকার বাহাদুরের। যা গুণগত মানের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অন্যতম প্রধান অন্তরায়। তারা ভুলে গেছেন(অনেক ‘মা’ হয়ত জানেন ই না) মাতৃগর্ভ থেকে অন্ধ হয়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন ইমাম বুখারী(রহ.)। তাঁর মায়ের একান্ত সাধনায় চোখের জ্যোতি ফিরে পান ইমাম বুখারী(রহ.)। আল্লামা আসকালানী ইমাম বুখারী(রহ.) এঁর বাল্যকালীন শিক্ষা সর্ম্পকে লিখেছেন যে, মায়ের কোল থেকেই ইমাম বুখারী (রহ.) শিক্ষা লাভ করেন। শৈশবে পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মা তাঁকে লালন-পালন করেন। মাত্র ৬ বছর বয়েসে তিনি কুরআন মুখুস্ত করেন। ২০টির অধিক গ্রন্থ তিনি রচনা করেন। ইমাম বুখারী(রহ.) যে মানুষের জন্য আলোর দিশারী হলেন এটি সম্ভব হয়েছে তাঁর মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। আমরা কি আমাদের সকল মায়েদের কাছে এটা প্রত্যাশা করতে পারিনা , ‘তাঁদের মতো আপনি ও আপনার সন্তানের শিক্ষার প্রতি আন্তরিক হবেন।’ কেননা- উন্নত বাংলাদেশের হ্নদস্পন্দন যে আজ আপনার কোলে। সরকারের গৃহীত কার্যক্রমকে (মান সম্মত প্রাথমিক শিক্ষা)বাস্তবায়নের জন্য আপনার আন্তরিকতাপূর্ণ সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন। “শিক্ষিত মা এক সুরভিত ফুল, প্রত্যেকটি ঘর হবে এক একটি স্কুল” –আসুন, আমরা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এই স্লোগানের সাথে একত্ত্বতা ঘোষণা করে প্রিয় স্বদেশ ভূমিকে উন্নত দেশে রুপান্তরিত করতে কাধে কাধ মিলিয়ে গুণগতমানের প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসি।
মো: মনজুরুল আলম
সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার
দেবহাটা, সাতক্ষীরা।
মোবাইল নং:০১৭৮৭-৪১৮৫৫৩