অনলাইন ডেস্ক: প্রশাসনে বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি বৈষম্য দূর হচ্ছে না। পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে। সম্প্রতি যুগ্ম-সচিব এবং অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিতেও অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করায় এ ক্ষোভ আরও বেড়েছে।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়ে পদোন্নতিতে বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে।
যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য পদ না থাকলেও ঢালাও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।
গত ২০ সেপ্টম্বর যুগ্মসচিব পদে ১৫৪ জনের মধ্যে অন্যান্য ক্যাডারের মাত্র ১৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর আগেও গত বছরের ২১ ডিসেম্বর যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতিতে ১৯৩ জনের মধ্যে অন্যান্য ক্যাডারের স্থান পেয়েছেন মাত্র ২১ জন।
প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য পদোন্নতিতে অলিখিত বিশেষ পদ্ধতি অব্যাহত রাখায় অন্যান্য ২৬ ক্যাডার থেকে উপসচিব হওয়া কর্মকর্তাদের যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রশাসন ক্যাডারের ৮/১০ ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তারা ‘বস’ হিসেবে তাদের মাথার ওপর বসছেন। এতে ভেঙে পড়ছে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড।
বঞ্চিত কর্মকর্তারা জানান, উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য শতকরা ৭৫ ভাগ এবং অন্যান্য ২৬ ক্যাডারের জন্য ২৫ ভাগ পদ সংরক্ষিত রাখার ফলে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের সম-ব্যাচের সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না। বরং প্রশাসন ক্যাডারের ৮ থেকে ১০ ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপসচিব করা হচ্ছে।
২০১৭ সালের ২১ ডিসেম্বর যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার আগ পর্যন্ত ২০০২ সালের পদোন্নতি বিধিমালা অনুযায়ী যোগ্যতা অর্জিত হলেই সব ক্যাডারের উপসচিবদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা হতো। তবে ওই বছরের ২১ ডিসেম্বর ও চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে এক অলিখিত নিয়ম চালু করা হয়েছে বলে অভিযোগ বঞ্চিতদের।
প্রশাসন ক্যাডারের যে ব্যাচের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব হয়েছেন সেই ব্যাচের সঙ্গে যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতি বিবেচনা করা হচ্ছে। এতে অন্যান্য ক্যাডার উপসচিবরা আরো পেছনে পড়ছেন।
পদোন্নতি বিধিমালা-২০০২ অনুযায়ী, অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য ২০ বছরের মোট চাকরিসহ উপসচিব পদে ৩ বছরের চাকরি প্রয়োজন। অপরদিকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে ১৫ বছরের মোট চাকরিসহ ৫ বছরের উপসচিব পদে চাকরি দরকার। এ অলিখিত নিয়ম চালু করায় অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতির সব যোগ্যতা অর্জন করার পরেও প্রশাসন ক্যাডারের ৮ থেকে ১০ ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাদের পদোন্নতির যোগ্যতা শর্তপূরণ না হওয়ার কারণে অন্যান্য ক্যাডারের উপসচিবদের পদোন্নতি অযৌক্তিকভাবে আটকে রাখা হচ্ছে।
বঞ্চিত একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এভাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সরকারের যুগ্ম-সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তা শূন্য করে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করা প্রশাসন ক্যাডারের উদ্দেশ্য।
কর্মকর্তারা অভিযোগ করে বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র থেকে বলা হয়, বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের যে ব্যাচের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা উপসচিব হয়েছেন, যুগ্ম-সচিব পদোন্নতি তাদের সঙ্গেই হবে। যদিও এরকম কোনো বিধি-বিধান বিদ্যমান নেই। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিবদের স্বার্থে গত ২০ সেপ্টেম্বরের যুগ্ম-সচিব পদে পদোন্নতিতে তারও ব্যত্যয় করা হয়েছে। ওই পদোন্নতিতে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
পদোন্নতি বিধিমালা-২০০২ অনুযায়ী, যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও অন্যান্য ক্যাডারের ১৩তম, ১১তম, ১০ম, ৯ম, ৮ম ব্যাচের প্রায় শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতির জন্য বিবেচনাই করা হয়নি। অথচ ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল প্রশাসন ক্যাডার থেকে উপসচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ১১তম বিসিএসের ৭ জন, ১৩তম বিসিএসের ৫ জন এবং ১৫তম ব্যাচের ৮ জনসহ মোট ২০ জনকে যুগ্ম-সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর উপসচিব হিসেবে যোগদান দেওয়া ক্যাডাররা এদের চেয়ে জ্যেষ্ঠতার হলেও প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারের ৮ম, ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১৩তম ব্যাচের কোনো কর্মকর্তাকেই পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। প্রশাসন ক্যাডারের ১১তম, ১৩তম ও ১৫তম ব্যাচের উক্ত কর্মকর্তাদের বিবেচনার পূর্বেই অন্যান্য ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ ৮ম, ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১৩তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের বিবেচনা না করে নিজেদের অলিখিত নিয়মও ভঙ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
কর্মকর্তারা বলছেন, এ ধরনের অলিখিত পদ্ধতি চালু থাকায় অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তারা দারুণভাবে বৈষম্যের শিকার ও বঞ্চিত হচ্ছেন। তাদের ৫/৭ ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাদের অধীনে চাকরি করতে হচ্ছে।
অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তারা এ বৈষম্য এবং বঞ্চনাকে জ্যেষ্ঠতার অপমান, পাবলিক সার্ভিস কমিশন গৃহীত পরীক্ষার অবমূল্যায়ন হিসেবে মনে করছেন।
তারা বলছেন, ২২ থেকে ২৮ বছর ধরে দক্ষতা, যোগ্যতা, দায়িত্বশীলতা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করেও পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ায় তারা পারিবারিক, সামাজিক ও দাফতরিকভাবে বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন বঞ্চিত কর্মকর্তারা।