দেশের খবর: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচনী লড়াইয়ে নামলেন। তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তাঁর জন্য দলীয় মনোনয়নপত্র কেনা হয়েছে। ১০ বছরের সাজা থাকায় নির্বাচনে তিনি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হতে পারবেন কি না সে প্রশ্ন আবারও সামনে এলো। তাঁর প্রার্থিতা বৈধ কি না এ সিদ্ধান্ত প্রথমত দেবেন রিটার্নিং অফিসার। যদিও রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের পর আপিল করা এবং আদালতে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিএনপি মনে করছে, আইনি লড়াইয়ে জয়লাভ করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন খালেদা জিয়া। কিন্তু এ বিষয়ে ভিন্নমত দিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ নেই।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আশা করছি আইনি লড়াই চালিয়ে জয়লাভ করব এবং দেশনেত্রী খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন।’ খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা আশাবাদী যে আইনি লড়াইয়ে সফল হব এবং বিএনপি চেয়ারপারসন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আইনে ব্যাখ্যা আছে। তবে যথাসময়ে তা আদালতেই দেওয়া হবে।
পৃথক দুটি মামলায় ১০ ও সাত বছরের কারাদণ্ড হওয়ার পর কারাবন্দি আছেন খালেদা জিয়া। এ অবস্থার মধ্যেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য খালেদা জিয়ার পক্ষ থেকে ফেনী-১ এবং বগুড়া-৬ ও ৭ আসনের জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম তোলা হয়েছে। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারবেন কি না তা নিয়ে জনমনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।
খালেদা জিয়ার প্রার্থিতার বিষয়টিতে সরকারের মনোভাবও বুঝে নিতে চায় বিএনপি। দলটির নেতাদের মতে, সরকারপক্ষ থেকে ‘শক্তভাবে’ আইনি লড়াইয়ের নির্দেশনা না থাকলে তাঁর প্রার্থিতা টিকে থাকবে। আর সরকার কঠোর হলে খালেদার নির্বাচন করা কঠিন। তবে শেষ পর্যন্ত খালেদা জিয়া নির্বাচন না করতে পারলে ওই আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিএনপির কেউ নির্বাচন করবেন এমন আলোচনা আছে বিএনপির মধ্যে।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টে ১০ বছরের কারাদণ্ড হওয়ায় খালেদা জিয়া নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবেন না।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, নিয়ম অনুযায়ী সাজার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করা হবে। এ আপিল গৃহীত হলেই তাঁর আর প্রার্থী হতে আইনগত কোনো বাধা থাকবে না। তিনি বলেন, ‘সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ, বর্তমান মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, সাবেক মন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সাজা হলেও তাঁরা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। এসব উদাহরণ আমাদের সামনে রয়েছে। তাই খালেদা জিয়াও নির্বাচন করতে পারবেন বলে আশা করি।’
নির্বাচনী আইন বিশেষজ্ঞ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদেরও একই মত। তবে তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে যদি বিএনপির সমঝোতা হয় সে ক্ষেত্রে সিআরপিসির ৪০১(১) ধারায় (সরকারের দণ্ড মওকুফের ক্ষমতা) খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে পারে সরকার। এটা দিলে সংবিধানসম্মতভাবেই মুক্তি দেওয়া হবে। কারণ দেশের প্রচলিত এ আইন এখন পর্যন্ত সংবিধানসম্মত বলেই স্বীকৃত।
আরেক নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে যে দণ্ডের কথা বলা হয়েছে সেটা কোন আদালতের দণ্ড তা স্পষ্ট নয়। এটা কি নিম্ন আদালতের, নাকি হাইকোর্টের আপলি বিভাগের তা স্পষ্ট হয়নি আজও। তিনি বলেন, ‘আমার মতে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগে যদি সাজা বহাল থাকে তবেই কেবল একজন ব্যক্তি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার মামলা এখনো সে পর্যন্ত যায়নি। হাইকোর্ট রায় দিয়েছেন। এর বিরুদ্ধে আপিল করা ও রিভিউ আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। তাই তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, সেটা নির্ভর করছে আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ৩০ অক্টোবর এ রায় দেওয়া হয়েছে। নিম্ন আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিলেও হাইকোর্ট তা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছেন। এই রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি এখনো প্রকাশিত হয়নি। চলতি মাসে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। রায়ের কপি না পেলে আপিল বিভাগে আপিলও করতে পারছেন না খালেদা জিয়া। এ ছাড়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালত খালেদা জিয়াকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে এখনো হাইকোর্টে আপিল করেননি তিনি। এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠেছে খালেদা জিয়া নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন কি না।
তবে বেশির ভাগ আইন বিশেষজ্ঞ বলছেন, এরই মধ্যে একটি মামলায় হাইকোর্টে সাজা হয়ে যাওয়ায় তাঁর পক্ষে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই। তবে কেউ কেউ বলছেন, আপিল বিভাগ যদি খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করেন কিংবা রাষ্ট্রপতি যদি তাঁকে ক্ষমা করে মুক্তি দেন তবেই শুধু খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার অনুকূলে আপিল বিভাগ থেকে যদি কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়, তবেই তিনি প্রার্থী হতে পারবেন। অন্যথায় প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
নির্বাচনে অযোগ্যতা প্রসঙ্গে সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোন ফৌজদারী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে;’ দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের এই বিধান অনুযায়ী আপাতত দৃষ্টিতে খালেদা জিয়া আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হয়েছেন। তবে এ রায়ই চূড়ান্ত নয়। আইন অনুযায়ী জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় এখন হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করার সুযোগ রয়েছে।
অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের মামলায় বর্তমান ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ১৩ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এই সাজার বিরুদ্ধে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। তাঁর আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় তিনি নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একইভাবে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহিউদ্দীন খান আলমগীরকেও অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২৬ জুলাই এক রায়ে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। এরপর তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন। হাইকোর্টে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন ও এমপি নির্বাচিত হন। সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের জনতা টাওয়ার মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হলেও তিনি এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন এবং এ আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় পাঁচটি আসনে নির্বাচন করে বিজয়ী হন। এই তিন রাজনীতিকের ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। কিন্তু খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে চিত্র ভিন্ন। কারণ হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার মামলায় রায় হয়ে গেছে। তাঁর সাজা বেড়েছে। তাই আওয়ামী লীগের দুই নেতা বা জাপা চেয়ারম্যানের উদাহরণ এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এর পরও খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তাঁর সে সুযোগ একমাত্র আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। আপিল বিভাগ যদি খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করেন তবেই শুধু তিনি প্রার্থী হতে পারবেন। আইনজীবীরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় প্রকাশ না হওয়ায় এ মুহূর্তে খালেদা জিয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলও করতে পারছেন না। আর আপিল করতে না পারলে নির্বাচনেও প্রার্থী হতে পারবেন না।
এ ছাড়া নির্বাচনে প্রার্থী হলে সাজা থাকার কারণে রিটার্নিং অফিসার মনোনয়নপত্র বাতিল করতে পারবেন। রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া নির্বাচন কমিশনের অ্যাপিলেট ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারবেন। ইসি যদি তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন সে ক্ষেত্রে রিট আবেদন করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন আইনজীবীরা। এ ছাড়া আইনগতভাবে আর কোনো পথ খোলা নেই। সে ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে খালেদা জিয়ার প্রার্থিতা।
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের মনোনয়নের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসারের। তবে রিটার্নিং অফিসারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তিনি আপিল করতে পারবেন।