মোস্তফা কামাল: প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দুরন্ত স্বভাবের চৌদ্দ বছরের শিলা পারভীন ছিল ছয় বোনের মধ্যে সবচেয়ে চঞ্চল, হাস্যেজ্জ্বল, কর্মঠ আর মেধাবী। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে প্রাণের স্পন্দন হারিয়ে সেই উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত শিলা এখন কেবলই অসাড় এক মানুষ্য দেহ। দুরন্তপনায় বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে পাড়া মহল্লায় ছুটে বেড়ানো কিশোরী শিলা এখন চব্বিশ ঘন্টার জন্য তিন হাত লম্বা বিছানার ফ্রেমবন্দী। নিষ্ঠুর নিয়তি তার দুরন্তপনাকে হরণ করে উপহার দিয়েছে বিভিষীকাময় এক অভিশপ্ত জীবন। মাত্র দু’বছর আগের দুরন্ত শিলার দু’টি চোখই এখন শুধু যেন কথা বলে। দৃষ্টি সীমায় হাজির হওয়া মানুষের মুখ পানে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে এমন অসহায়ত্ব থেকে সে যেন মুক্তির দাবি তোলে। অথচ শিলার এমন করুন পরিণতির জন্য দায়ী চক্রটি অদ্যাবধি রয়েছে দিব্যি ধরাছোয়ার বাইরে। ঘটনাটি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়নের ঘোলা গ্রামের। ঘটনার শিকার শিলার জীবনে এখন শুধুই কবরস্থানের নীরবতা। অপেক্ষা কেবলই গন্তব্য দুর পরপারে পাড়ি জমানোর। অপরাধী চক্রটি আইনের আওতায় এলেই কেবল শিলার কষ্ট কমবে বলে দাবি পরিবারের। শিলার পরিবার সুত্রে জানা গেছে মাত্র দু’বছর আগে আদম ব্যবসায়ী ও পাচারকারী এক চক্রের জালে আটকা পড়ে শিলা। প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে কৌশলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে নেয় চক্রটি। পরবর্তীতে নানা হাত ঘুরিয়ে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। অভিশপ্ত সেই জীবন থেকে পালিয়ে আসার পর পুনরায় ঐ চক্রের হাতে আটকে যাওয়া শিলা এখন পিতার গৃহে অপেক্ষমান মৃত্যু পথযাত্রী। শিলার পিতা কাশিমাড়ীর ঘোলা গ্রামের গোলাম হোসেন সরদার জানান, গাজী আব্দুল হামিদ মহিলা মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণিতে লেখাপড়া করত শিলা। ২০১৪ সালের অক্টোবরে শিলা আকস্মিক বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। পরে তারা জানতে পারেন প্রতিবেশী আব্দুর রউফ সরদারের বাড়িতে বেড়াতে আসা তারই স্ত্রী’র নিকটাত্বীয় খুলনার দৌলতপুর এলাকার জনৈক বুলবুল হোসেন ও তার চার সহযোগী তার মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে গেছে। প্রেমের সম্পর্কের জেরে মেয়ে ঘর ছেড়েছে ভেবে দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা রাগে ক্ষোভে শিলার কোন খোঁজ খবর নেয়নি বলে জানান তিনি। প্রায় ৯/১০ মাস পরে সিঙ্গাপুর থেকে মেয়ের একটি ফোন পেয়ে শিলা সংঘবদ্ধ প্রতারক ও পাচার চক্রের ফাঁদে পড়েছে নিশ্চিত হন উল্লেখ করে গোলাম হোসেন জানান, এসময় প্রতিবেশী আব্দুর রউফ ও তার স্ত্রী’র উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু নানা প্রকার টালবাহানার এক পর্যায়ে তারা জানায় শিলা তাদেরই নিকটাত্বীয় বুলবুল হোসেনের সাথে বিয়ে করে ঘর সংসার করছে। এসময় মেয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাইলে আব্দুর রউফ ও তার স্ত্রী ধর্য্য ধরার পরামর্শ দেয় বলেও গোলাম হোসেন ও জাহিদুর জানায়। গোলাম হোসেন আরও জানান, সিঙ্গাপুরে মেয়েকে জীবনে মেরে ফেলার আতংকে তিনি ও তার পরিবার সেখান থেকে মেয়ের ফোন আসার বিষয়টি আব্দুর রউফ ও তার স্ত্রী ইসমত জাহানের কাছে গোপন করেন। এক পর্যায়ে দ্বিতীয় বার শিলার ফোন পেয়ে তাকে সেখান থেকে যে কোন উপায়ে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার পরামর্শ দেয়া হয়। তাদের পরামর্শ মোতাবেক শিলা সিঙ্গাপুরে পাচার হওয়া নাসিমা (ছদ্মনাম) খাতুনের সাথে মিলে পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। শিলার ভাই জাহিদুর রহমান জানান, তার বোনকে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই দালাল চক্রের মাধ্যমে বুলবুল হোসেন সিঙ্গাপুরে পাঠায়। মিথ্যা বিয়ের নাটক সাঁজিয়ে ভিসা জটিলতার কারনে পরে সে নিজে যাবে জানিয়ে প্রথমে শিলাকে সিঙ্গাপুর যেতে বাধ্য করে বলেও জাহিদুরের দাবি। শিলার ভাই অভিযোগ করে বলেন, সিঙ্গাপুরের হোটেলে তাকে ‘নাচনেওয়ালী’ হিসেবে তাকে কাজ করতে বাধ্য হয়। এক পর্র্যায়ে বুলবুলসহ প্রতারক চক্রের মুখোশ উম্মোচিত হলে শিলা পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে এবং পালিয়ে দেশে ফিরে আসে। জাহিদুর আরও জানায় শিলা সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে আসলেও ভয়ে পরিবারের কাছে ফিরতে সাহস পাচ্ছিল না। এসময় তার সাথে পালিয়ে আসা টাঙ্গাইলের অপর একটি মেয়ে নাসিমার বাড়িতে ওঠে শিলা। কিন্তু বুলবুলসহ প্রতারক চক্রটি নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। এসমসয় শিলাকে বিবাহিত স্ত্রী দাবি করে নাসিমার পরিবারের কাছে লিখিত প্রতিশ্রুতিতে তারা শিলাকে নিয়ে যায়।জাহিদুর রহমান ও তার পিতা গোলাম হোসেন আরও জানায় মেয়েকে টাঙ্গাইল থেকে নিয়ে যাওয়ার অল্প দিনের মধ্যে বুলবুল হোসেন শিলার সাথে বিয়ে পরবর্তী সংসার করছে জানিয়ে অটোরিক্সা ক্রয়ের কথা বলে শিলার পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করে। এদিকে একের পর এক মেয়ের ভুল সিদ্ধান্তের কারনে পরিবারের সদস্যরা তার উপর রুষ্ট হলেও মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে তারা বুলবুলকে দুই লাখ বিশ হাজার টাক্ াদেন। গোলাম হোসেন জানান, দেশে ফেরার পরও যে তার মেয়েকে সংঘবদ্ধ চক্রটি আটকে রেখেছে বিষয়টি তখন পর্যন্ত তারা বুঝতে পারেন নি। এক পর্যায়ে গত ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বুলবুল হোসেন তাদের ফোন দিয়ে শিলা আত্মহত্যার চেষ্টায় আহত হয়ে খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আইসিইউ-তে রয়েছে বলে তার পরিবারের কাছে বার্তা পাঠায় বলেও গোলাম হোসেন জানান। শিলার ভাই জাহিদুর জানান, তারা হাসপাতালে যেয়ে শিলাকে সংকটাপন্ন অবস্থায় দেখতে পেয়ে নিশ্চিত হন যে শিলাকে ফুসলিয়ে বাড়ি থেকে নেয়ার পর বিয়ের নাটক সাঁজিয়ে তাকে সিঙ্গাপুরে পাচার করা হয়। এক পর্যায়ে সে পালিয়ে দেশে ফিরলে তাকে দ্বিতীয়বার আটকে দিতেই আগের বিয়ে নাটককে সত্যি পরিনতি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দ্বিতীয়বার আটকে দেয়া হয়। এসময় পরিবারের সাথে দুরত্বের সুযোগে কৌশলে তারা শিলার পরিবারের নিকট থেকে দুই লাখ বিশ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে পালানোর কারনে তাদের ঘটে যাওয়া আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নেয় চক্রটি। জাহিদুর আরও জানান, তার বোন এখন কঙ্কালসার হয়ে বিছানায় পড়ে আছে গত দুই/তিন মাস ধরে। তাদের প্রতিবেশী আব্দুর রউফ সরদারের স্ত্রী ইসমত জাহান ও প্রতিবেশী জামালউদ্দীন সরদারের মেয়ে মাসুকা পারভীন ঐ প্রতারক চক্রের সাথে মিলে তার বোনকে পাচারে সহায়তা করেছিল বলেও অভিযোগ করেন জাহিদুর ও তার বৃদ্ধ পিতা। বুলবুলসহ সংঘবদ্ধ চক্রটির সাথে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে দাবি করে জাহিদুর রহমান বলেন, বারংবার ইসমত জাহানের কাছে বুলবুল ও তার পরিবারের বিষয়ে তথ্য চাওয়া হলেও তারা সেসব কথায় কর্ণপাত পর্যন্ত করছে না। তার বোনের জীবন ধ্বংস করে ইসমত জাহান ও বুলবুলসহ সংশ্লিষ্টরা বহাল তবিয়তে থাকলেও দু’বছর আগের শিলা মৃত্যুর প্রহর গুনছে উল্লেখ করে জাহিদুর অপরাধীদের আইনের আনার দাবি জানিয়েছে। এদিকে শিলার সাথে সিঙ্গাপুর থেকে পালিয়ে আসা নাসিমা (ছদ্মনাম) জানান, সিঙ্গাপুর পরিচয়ের সময় শিলা তাকে বলেছিল যে বিয়ের প্রতিশ্র“তিতে বুলবুল হোসেন তাকে বাড়ি থেকে ফুসলিয়ে নেয়। পরবর্তীতে তাকে কৌশলে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে ‘ড্যান্সারে’র কাজ করতে বাধ্য করে বলেও শিলা তার কাছে অভিযোগ করে পালিয়ে যেতে সাহায্য চেয়েছিল। শিলা দেশে ফিরলে টাঙ্গাইল থেকে তাকে নিয়ে যাওয়ার পর কখনও তাদের সাথে শিলাকে কথা বলতে দেয়া হয়নি উল্লেখ করে নাসিমা বলেন, আসল পরিচয় ফাঁস হওয়ার ভয়ে তাদেরকে শিলার সাথে যোগাযোগ করতে দিত না বুলবুল। যোগাযোগ করা হলে আব্দুর রউফ সরদারের স্ত্রী ইসমত জাহান বলেন, তার ভাইয়ের বন্ধু হিসেবে তাদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল বুলবুলের। প্রেম করে পালিয়ে যেয়ে বিয়ে করার পর শিলার সম্মতিতে তাকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয় বলে দাবি করেন তিনি। বিয়ে করা হলে শিলার এমন অবস্থায় বুলবুল পলাতক কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন “একটা অসুস্থ মেয়েকে কতদিন দেখতে হবে”। কথা বলার জন্য বুলবুল হোসেনের ০১৬৩০৮৩০৭০০ নম্বরে যোগাযোগ করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।
পূর্ববর্তী পোস্ট