দেশের খবর: মেয়ের ‘কান ফোঁড়ানো’ অনুষ্ঠানে অঢেল উপঢৌকন পাওয়া নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর মোহাম্মদ (৩৬)। সেই নুর মোহাম্মদ রবিবার টেকনাফে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।
টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, যুবলীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার প্রধান আসামি হিসেবে আটকের পর অস্ত্র উদ্ধারে গেলে নুর মোহাম্মদের লোকদের সঙ্গে গোলাগুলির ঘটনা হয়। এতে নুর মোহাম্মদ মারা যান। এসময় ৪টি এলজি, ১টি থ্রি কোয়াটার, ১৮ রাউন্ড গুলি, ২০ রাউন্ড গুলির খালি খোসা পাওয়া যায়।
এই ঘটনার মাঝেই নুর মোহাম্মদের চ্যাপ্টার শেষ হতে পারত। কিন্তু মরে গিয়েও আলোচনার পথ রেখে গেছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সর্দার নুর মোহাম্মদ। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে তার বাংলাদেশের স্মার্টকার্ড।
ওই স্মার্টকার্ড অনুযায়ী চট্টগ্রামের ষোলশহর এলাকার বাসিন্দা হিসেবে নুর আলম বাংলাদেশের ভোটার হয়েছিলেন। যথারীতি স্মার্টকার্ডও সংগ্রহ করেন তিনি।
স্মার্টকার্ডে উল্লেখ রয়েছে, নুর মোহাম্মদের বাংলাদেশি ভোটার কার্ডটি ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশনের ঠিকানায় ইস্যু করা হয়। কার্ডে তার নাম নুর আলম। পিতা, কালা মিয়া এবং মাতা সরু বেগম। জন্ম তারিখ ১৯৮৩ সালের ২৫ নভেম্বর। জন্মস্থান চট্টগ্রাম। এনআইডি নম্বর-৬০০৪৫৮৯৯৬৩।
স্থায়ী ঠিকানায় লেখা আছে, বাসা/হোল্ডিং- মাস্টারের মার বাড়ি, গ্রাম/রাস্তা-বার্মা কলোনি, হিলভিউ রোড, পশ্চিম ষোলশহর (পার্ট-২), ডাকঘর- আমিন জুট মিলস-৪২১১, পাচঁলাইশ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, ১৯৯২ সালে মিয়ানমারের আকিয়াব এলাকা থেকে বাংলাদেশে এসে রোহিঙ্গা নূর মোহাম্মদ হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের জাদিমুরা এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করেন। পরে জমি কিনে বাড়ির মালিক হন। গড়ে তুলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। আর ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তারে টেকনাফে রোহিঙ্গাদের প্রতিটি ক্যাম্পে বিয়ে করেন নুর মোহাম্মদ। তাই ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধকর্ম তার ইশারায় হতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
প্রচার রয়েছে, নূর মোহাম্মদের মালিকানায় একটি দুতলা, একটি পাকা ভবন, একটি টিনের ঘর এবং অপরটি বাগান বাড়িসহ ৪টি বসতঘর রয়েছে। রয়েছে একাধিক স্ত্রী।
রোহিঙ্গা ঢলের শুরু থেকে কক্সবাজারে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শরণার্থী হিসেবে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের আগে রোহিঙ্গারা যাতে এদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র না পায় সে জন্যই মূলত এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। এ কার্যক্রম চালু থাকায় কক্সবাজার জেলার বাসিন্দারা জন্মনিবন্ধনসহ নানা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
তবে প্রশ্ন উঠছে, মানবিকতার খাতিরে আশ্রয় পাওয়া নূর মোহাম্মদের মতো চিহ্নিত রোহিঙ্গা অপরাধীরা কিভাবে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলো? স্মার্টকার্ড পেলো কিভাবে? ধারনা করা হচ্ছে, নূর মোহাম্মদ তার বাহিনীর সদস্যদের স্মার্টকার্ডের আওতায় এনেছেন।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, এভাবে যদি রোহিঙ্গারা জাতীয় পরিচয়পত্র, স্মার্টকার্ড বা পাসপোর্ট পেতে থাকে তাহলে তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হবে না। দীর্ঘমেয়াদী এর খেসারত বাংলাদেশকেই দিতে হবে। তাই রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং স্মার্টকার্ড পেতে সহযোগিতাকারীদের সনাক্ত করে কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা দরকার।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, যদি এভাবে রোহিঙ্গা অপরাধীদের স্মার্টকার্ড পাওয়া দুঃখজনক। লোভের বসে কিছু অসাধু ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে এবং পাসপোর্ট পেতে সহযোগিতা করছে। এটা যে নিজেদের পায়ে কোঁড়াল মারার চেয়ে ক্ষতি তা বুঝে না লোভী মানুষগুলো। কিন্তু এভাবে আর চলতে পারে না। দরকার এই অপরাধ নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ। আমরা সেই পথে হাঁটছি।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নুর মোহাম্মদের মেয়ের কান ফোঁড়ানো অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে উপহার হিসেবে মিলেছে এক কেজি স্বর্ণালংকার ও নগদ ৪৫ লাখ টাকাসহ আরও নানা উপহার। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ জানান, কান ফোঁড়ানোর অনুষ্ঠানে এ রকম উপহার সামগ্রী উঠার বিষয়টি এলাকাবাসীর কাছ থেকে জেনেছি।
এদিকে গত ২২ আগস্ট রাতে যুবলীগ নেতা ওমর ফারুককে (৩০) গুলি করে হত্যা করা হয়। একদল রোহিঙ্গা ফরুককে বাসার সামনে থেকে তুলে নিয়ে পাশের একটি পাহাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যার আসামি ছিলেন রোহিঙ্গা নুর মোহাম্মদ।