খেলার খবর: ম্যাচ শেষে অধিনায়ক মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সহজ ভাষায় মেনে নেন, ভারতকে হারিয়ে সিরিজটি জেতার সুযোগ ছিল তার দলের সামনে। কিন্তু সেটি হেলায় হারিয়েছেন তারা। অবশ্য সুযোগ হাতছাড়া হবেই বা না কেন? ফিল্ডিংয়ের সময় জোড়া ক্যাচ মিস এবং পরে ব্যাটিংয়ে নেমে জোড়ায় জোড়ায় সাজঘরে ফেরার মিছিলে যোগ দিলে হতাশার পরাজয় সঙ্গী হওয়াই যে স্বাভাবিক।
সিরিজের প্রথম ম্যাচের মতোই শেষ ম্যাচে নিজের প্রথম ওভারে দারুণ এক ইনসুইঙ্গারে ভারতীয় অধিনায়ক রোহিত শর্মাকে সাজঘরে পাঠালেন শফিউল ইসলাম। এক ওভার বিরতি দিয়ে নিজের তৃতীয় ওভারে তুলে নেন শিখর ধাওয়ানের উইকেটও। শফিউলের হাত ধরে উড়ন্ত সূচনা পায় বাংলাদেশ।
সিরিজ নির্ধারণী ম্যাচে প্রথম পাওয়ার প্লে শেষে টস হেরে ব্যাট করতে নামা ভারতের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৪১ রান। অথচ খুব সহজেই উইকেটের ঘরে সংখ্যাটা হতে পারতো ৩। ষষ্ঠ ওভারের দ্বিতীয় বলে ধাওয়ান ফিরে যাওয়ার পর, পঞ্চম বলেই ক্যাচ তুলেছিলেন শ্রেয়াস আইয়ার।
কিন্তু সেটি তালুবন্দী করতে পারেননি পয়েন্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দাঁড়ানো তরুণ তুর্কি আমিনুল ইসলাম বিপ্লব। ভেবেছিলেন, বলটি আসছে আরও গতিতে, যে কারণে ভড়কে যান তিনি, হাত ফসকে ছুটে যায় ক্যাচ। প্রথম স্পেলেই ৩ উইকেট পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন শফিউল, মহামূল্যবান জীবন পান আইয়ার।
তখনও রানের খাতাই খোলেননি এ ডানহাতি মিডলঅর্ডার। দ্বিতীয় বলেই পাওয়া জীবনটির পূর্ণ ফায়দা লুটতে একদমই ভুল করেননি তিনি। ইনিংসের শুরুতেই ক্যাচ ওঠায় সাবধানী ব্যাটিংয়ে থিতু হওয়ার পরিকল্পনা নেন তিনি। আর হাত খুলে মারার জন্য বেছে নেন তার ক্যাচ ছেড়ে দেয়া আমিনুল বিপ্লবের ওভারকেই।
ইনিংসের ১১তম ওভারে নিজের তৃতীয় ওভার নিয়ে আসেন আমিনুল। সে ওভারের চতুর্থ বলে সোজা বোলারের মাথার ওপর দিয়ে বিশাল ছক্কার মাধ্যমে নিজের বাউন্ডারির খাতা খোলেন আইয়ার। পরের বলেই চার মারেন মিডউইকেট অঞ্চল দিয়ে।
সেই যে শুরু আইয়ার ঝড়, এই তাণ্ডব চলে ইনিংসের ১৭তম ওভার পর্যন্ত। সেই ওভারের পঞ্চম বলে বড় শট খেলার উদ্দেশ্যে ব্যাট চালিয়ে মিডঅফে দাঁড়ানো লিটন দাসের হাতে ক্যাচ তুলে দেন আইয়ার। এ দফায় বলটি তালুবন্দী করতে একদমই ভুল করেননি লিটন।
তবে ক্ষতি যা করার তার আগেই করে ফেলেন আইয়ার। ২ বলে ০ রানে জীবন পাওয়ার পর খেলেন আরও ৩১টি ডেলিভারি, যা থেকে দ্বিগুণ রান পায় ভারত। আফিফ হোসেন ধ্রুবর করা ১৫তম ওভারে টানা তিন ছয়সহ মোট ৫টি ছক্কা ও ৩টি চার মারেন আইয়ার। নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টি ফিফটির ইনিংসে করেন ৩৩ বলে ৬২ রান।
এরপর ১৯তম ওভারে দারুণ বোলিং করেন আল আমিন হোসেন। খরচ মাত্র ৬ রান। ওভারের চতুর্থ বলে নিজের দ্বিতীয় উইকেটটাও পেতে পারতেন, মিডউইকেটে শিভাম দুবের সহজ ক্যাচ যদি ড্রপ না হতো। এবারও ক্যাচ ফেলে দেন সেই আমিনুল। দুবে অবশ্য জীবন পেয়েও তেমন কিছু করতে পারেননি। ৮ বলে অপরাজিত থাকেন ৯ রানে।
জোড়া ক্যাচ মিসের পর ভারতের দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ৫ উইকেটে ১৭৪ রান। অথচ নাগপুরের এই মাঠের গড় সংগ্রহের রেকর্ড ছিল ১৪৯ রান। অর্থাৎ গড়পড়তা ২৫ রান বেশি করে স্বাগতিকরা, যা তাদের এগিয়ে দেয় প্রথম ইনিংসেই।
তবু দ্বিতীয় ইনিংসে দারুণ লড়াই করে বাংলাদেশ। বুক চিতিয়ে লড়েন তরুণ ওপেনার নাইম শেখ। তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন অভিজ্ঞ মোহাম্মদ মিঠুন। কিন্তু বাকি ব্যাটসম্যানরা যেন ভারতীয় বোলারদের জন্য সাজিয়ে বসেন ‘একটি কিনলে একটি ফ্রি’ অফার!
যখনই আউট হয়েছেন একজন ব্যাটসম্যান, তার পরের বলেই সাজঘরে ফিরেছেন আরও একজন। দশ উইকেটের ইনিংসে এমন ঘটনা ঘটেছে চারবার, যাতে আউট হয়েছেন বাংলাদেশের ৮ ব্যাটসম্যান। ব্যতিক্রম ছিলো শুধুমাত্র সপ্তম ও অষ্টম উইকেটের বেলায়।
জোড়ায় জোড়ায় আউট হওয়ার ধারাটা শুরু হয় ইনিংসের তৃতীয় ওভার থেকে। যে ওভারে প্রথমবারের মতো আক্রমণে আসেন ম্যাচে মাত্র ৭ রানে ৬ উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়া দ্বীপক চাহার। তার করা চতুর্থ বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে মিড উইকেটে ধরা পড়েন লিটন দাস। পরের বলেই মিডঅফে ক্যাচ তুলে দেন সৌম্য সরকার। প্রথম ওভারে জোড়া চারের মাধ্যমে লিটন দাস ৮ বলে ৯ রান করলেও রানের খাতাই খোলা সম্ভব হয়নি সৌম্য সরকারের।
শুরুতেই এমন ধাক্কা খাওয়ার পর তৃতীয় উইকেটে চাপ সামাল দেন নাইম ও মিঠুন। দুজন মিলে গড়েন ৬১ বলে ৯৮ রানের জুটি। সবকিছু যাচ্ছিল বাংলাদেশের পক্ষেই। ১২ ওভার শেষে সংগ্রহ ছিলো ২ উইকেটে ১০৬ রান, জয়ের জন্য ৪৮ বলে দরকার ছিল ৬৯ রান।
এমতাবস্থায় নিজের দ্বিতীয় ওভারে বোলিং করতে এসে শেষ বলে মিঠুনকে আউট করেন চাহার, ভেঙে দেন বাংলাদেশকে আশা দেখানো জুটিটি। মিঠুন আউট হন ১৩তম ওভারের শেষ বলে আর ১৪তম ওভারের প্রথম বলে সরাসরি বোল্ড হন মুশফিকুর রহীম। সৌম্যর মতো মুশফিকও শিকার হন গোল্ডেন ডাকের। তবে ২৯ বলে ২৭ রান করেন মিঠুন।
দুই বলে দুই উইকেট হারালেও জয়ের আশা টিকে ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু এবার জোড়ায় জোড়ায় শিকারের উৎসবে যোগ দেন শিভাব দুবেও। ইনিংসের ১৬তম ওভারের তৃতীয় বলে তিনি সাজঘরে ফেরত পাঠান ৮১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলা নাইম শেখকে আর পরের বলেই ফিরতি ক্যাচে আউট করেন আফিফ হোসেন ধ্রুবকে। ইনিংসের তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে গোল্ডেন ডাকে আউট হন আফিফ।
টানা ছয় ব্যাটসম্যান ‘একটা নিলে একটা ফ্রি’ অফার দিয়ে সাজঘরে ফেরার পর এই ধারায় হালকা বিরতি আনেন শফিউল ইসলাম। কেননা ইনিংসের ১৭তম ওভারের পঞ্চম বলে মাহমুদউল্লাহ আউট হলেও, শেষ বলে নিজের উইকেট অক্ষত রাখেন শফিউল।
তবে সাজঘরের পথ ধরতে বেশি সময় নেননি তিনি। দ্বিপক চাহারের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে তার চতুর্থ উইকেটে পরিণত হন শফিউল। এর মাধ্যমেই শুরু হয় চাহারের হ্যাটট্রিকের সম্ভাবনা, যা পূর্ণতা পায় শেষ ওভারের প্রথম দুই বলে।
প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের মতো বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ দুই ব্যাটসম্যানও ফিরে যান পরপর দুই বলে। শেষ ওভারের প্রথম বলে ক্যাচ আউট হন মোস্তাফিজ এবং পরের বলে সোজা বোল্ড হয়ে চাহারের হ্যাটট্রিক শিকারে পরিণত হন ফিল্ডিংয়ে দুই ক্যাচ ছেড়ে দেয়া আমিনুল ইসলাম বিপ্লব।
আর এরই মাধ্যমে প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন চাহার। এছাড়া মাত্র ৭ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেট নিয়ে গড়েন সেরা বোলিং ফিগারের বিশ্ব রেকর্ড। তার এমন বোলিংয়ের কারণেই জয় পায় ভারত। আর বাংলাদেশ পুড়তে থাকে ক্যাচ মিস ও ‘একটি নিলে একটি ফ্রি’ অফারের যন্ত্রণায়।