বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আমরা সেই বিরল ভাগ্যবান, যারা তাঁকে কাছে থেকে দেখেছি বা তাঁর মতো মহানায়কের সান্নিধ্য পেয়েছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ এবং অনাগত প্রজন্মের পর প্রজন্ম তাঁকে বইপত্র পাঠ করে জানবে। তাতে সম্পূর্ণ মানুষটিকে জানা যাবে না, তাঁর জীবনকথায় থাকবে অপূর্ণতা অথবা থাকবে অপ্রয়োজনীয় অতিকথন।
বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘শেখ পরিবারকে একটা মধ্যবিত্ত পরিবার বলা যেতে পারে।’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন তিনি ছিলেন শুধু প্রধানমন্ত্রী নন রাষ্ট্রপিতা, সমসাময়িক বহু রাষ্ট্রনায়কের মতো তাঁর বিলাসী জীবনযাপন করাই ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু তাঁর খাওয়া-দাওয়া সবই ছিল সাধারণ বাঙালি মধ্যবিত্তসুলভ। দৈনিক পাকিস্তানের বিশেষ প্রতিবেদক হাসিনা আশরাফকে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিনি সকালে নাশতায় কখনও খিচুড়ি আর ডিম ভাজি পছন্দ করেন।
কুড়ি শতকের বাঙালি নেতাদের মধ্যে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিপুল জনপ্রিয় ছিলেন। তাদের কেউ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, কেউ সরকারও পরিচালনা করেছেন। তাঁদের কারও সঙ্গে শেখ মুজিবের রাজনীতি তুলনীয় নয়, যদিও তিনি ছাত্রজীবনে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন, পরে পাকিস্তানি-স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম করেছেন এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকা পালন করেন। তিনি তৃণমূল থেকে রাজনীতি শুরু করে জাতীয় জীবনের শীর্ষে যান। তিনি পূর্ববর্তী কোনো নেতাকে অনুকরণ করে রাজনীতি করেননি। তাঁর রাজনীতির চারিত্র্য ছিল তাঁর নিজস্ব।
সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী উভয়েরই ছিলেন শেখ মুজিব প্রিয়পাত্র, তাঁদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধা, কিন্তু স্বকীয়তা বিসর্জন দেননি। সোহরাওয়ার্দী থেকে নিয়েছেন সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির দীক্ষা এবং ভাসানী থেকে নিপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের অনুপ্রেরণা। কিন্তু যেসব বিষয়ে তাঁদের সঙ্গে তাঁর মতের মিল হয়নি সেসব ক্ষেত্রে তিনি তাঁর অবস্থানে অনড় থেকেছেন।
কৃষিপ্রধান পূর্ব বাংলার মুসলমানদের দুঃখের জায়গাটি শেখ মুজিব শনাক্ত করতে পেরেছিলেন শৈশব-কৈশোরেই। সে জন্যই পাকিস্তান আন্দোলনে তাঁর অংশগ্রহণ। জমিদারি ব্যবস্থায় কৃষককে শোষিত-নিপীড়িত হতে দেখেছেন। সে জন্য আজীবন জমিদারি প্রথা বিলোপের আন্দোলন করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলার সংখ্যালঘু হিন্দুদের সমস্যা ও দুঃখ উপলব্ধি করেছেন। ভারত থেকে আগত অবাঙালি, বিশেষ করে উর্দুভাষী মোহাজেরদের কষ্ট উপলব্ধি করেছেন। বাঙালি মুসলমানের বেদনা, বাঙালি হিন্দুর দুঃখ, অবাঙালি মোহাজেরদের কষ্ট উপলব্ধি করার ফলে তিনি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবিচল প্রবক্তায় পরিণত হন। সাম্প্রদায়িকতাকে শৈশব থেকেই তিনি প্রশ্রয় দেননি, তাতে তাঁর আন্দোলন কখন কার পক্ষে গেছে বা কার বিপক্ষে গেছে, তা নিয়ে ভাবেননি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক নেতা, কিন্তু এক পর্যায়ে তাঁকে সশস্ত্র লড়াইয়ের কথাও ভাবতে হয় কারণ তাঁর শত্রুপক্ষ ছিল হিংস্র। সুতরাং তাঁকে প্রত্যাঘাত করতে হয়েছে। যদিও তিনি ছেয়েছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে বাংলার মানুষের অধিকার অর্জন করতে। তিনি গণতন্ত্রের পথে ছিলেন বলেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বসম্প্রদায় তাঁকে সমর্থন দেয় এবং পাকিস্তানি সামরিক জান্তাকে জানায় ধিক্কার।
পাকিস্তানি শ্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু শুধু সফল হননি, রাষ্ট্র পরিচালনায়ও তাঁর সাফল্য অসামান্য। অতি অল্প সময়ে তিনি পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করেন। বাংলাদেশ তাঁর সময়ই কমনওয়েলথ, ওআইসি এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হয়।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য তিনটি বছরের প্রয়োজন। দেশবাসীকে তিনি সে জন্য ধৈর্য ধারণ করতে বলেছিলেন। জনগণ তাঁর কথামতো ধৈর্য ধারণ করলেও তাঁর দেশি-বিদেশি শত্রুরা বাঙালির জাতীয় জীবনে তাঁর উপস্থিতিতে অধৈর্য হয়ে পড়ে। তাঁকে আমাদের থেকে সরিয়ে দেয়।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাস্তববাদী ও প্র্যাগম্যাটিক বা প্রয়োগবাদী। বাস্তবতাকে কখনও উপেক্ষা করেননি। স্বাধীনতার পর পর তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, আমেরিকাসহ প্রভৃতি দেশ থেকে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণ নেবেন না। বঙ্গবন্ধু বললেন, দেশ পুনর্গঠনে স্বল্প সুদে নিঃশর্ত অনুদান ও ঋণ নিতে আপত্তি নেই। তাঁর সরকারের দুর্নীতির কথা বঙ্গবন্ধু গোপন করেননি। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ও দলীয় নেতাকর্মীদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’ সরকারি কর্মকর্তাদের তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন জনগণের ট্যাক্সের টাকায় তাদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়।
রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি যেমন অনন্য, মানুষ হিসেবেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য সাধারণ। তিনি বলেছেন, ‘আই লাভ মাই পিপল, মাই পিপল লাভ মি’, আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি এবং আমার জনগণ আমাকে ভালোবাসে। এটা কথার কথা ছিল না। নেতাকর্মী ও পরিচিতদের প্রতিও ছিল তাঁর অসামান্য স্নেহ-ভালোবাসা। প্রত্যেকের সুখ-দুঃখের খবর নিতেন। কারও সমস্যা সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন শত ব্যস্ততার মধ্যেও। তাঁর সফরসঙ্গী হয়ে দেখেছি, অন্যরা ঠিকমতো খেয়েছে কিনা, তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা, সে খোঁজ তিনি নিতেন। তিনি ছিলেন তাঁর আব্বা-আম্মার মতোই অতিথিপরায়ণ।
আমরা যতটুকু দেখেছি, বঙ্গবন্ধু ছিলেন মাতৃ-পিতৃভক্ত পুত্র, প্রেমময় স্বামী ও স্নেহশীল পিতা। ভাইবোনদের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালোবাসা। কিন্তু তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খুব কম সময়ই থাকতে পেরেছেন। নিজের ঘরের চেয়ে কারাগারে নিভৃত কক্ষেই কেটেছে তাঁর জীবনের একটি বড় সময়। প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তাঁকে পরিবারের সদস্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে কারাগারে বন্ধী রেখেছে।
বঙ্গবন্ধু সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ও নায়কোচিত শারীরিক সৌষ্ঠবের অধিকারী ছিলেন। তাঁর আব্বা ও আম্মাও দীর্ঘায়ু ছিলেন। তিনি বর্বরোচিতভাবে নিহত না হলে ৮৫-৯০ বছর বাঁচতেন বলে অনুমান করা যায় এবং দেশ পরিচালনার সুযোগ পেতেন, তাতে তিনি নিজে কতটা লাভবান হতেন, তার চেয়ে বড় কথা জাতি লাভবান হতো। তাঁর জন্মশতবর্ষে অনন্য এই মহানায়কের স্মৃতির প্রতি আমাদের গভীরতম শ্রদ্ধা।
লেখক
প্রাবন্ধিক