বি এম আলাউদ্দীন, আশাশুনি প্রতিনিধি:
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের বানভাসী মানুষ সবকিছু হারিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যাচ্ছে। প্রতাপনগরের লস্কারী খাজরা চেয়ারম্যান বাড়ির রাস্তার সামনে আবুল কালাম গাজীর সাথে দেখা হলে তিনি বলেন, নদীতে মাছ ধরে সংসার চলে সংসার চলে তার। তার ঘর বাড়ি খুব ঝূর্কিপূণ হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সাইক্লোন সেল্টারে নিয়ে যান। ঝড়ে পরে এসে দেখতে পান তার কষ্টে গড়া সেই ঘরটি সেখানে আর নেই। টিনের চাল উড়ে গেছে মাটির দেয়াল পড়ে গেছে। সব কিছু যেন লন্ড-ভন্ড করে দিয়েছে সর্বনাশী আম্পান। কিন্তু কিছু তো করার নেই। উপকূলে থাকলে এমন প্রাকৃতিক দুযোর্গের সাথে তো যুদ্ধ করতেই হবে। আম্পানের পর সরকারিভাবে পাওয়া টিন-এলভেস্টার এবং একটি সংস্থা থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে আবারো একটি ইটের ঘর তুলেন সেখানে। কিন্তু বিধিবাম। গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণে এবং অমাবস্যার প্রবল জোয়ারে কপোতাক্ষের বাঁধ ভেঙে প্রতাপনগরের কুড়িকাহুনিয়ার লোকালয়ে পানি প্রবেশ করায় বড় ক্লোজার (খাল) তৈরী হয়েছে। এতে আবুল কালামের ঘর বাড়ি ক্লোজারে চলে গেছে। আগে থেকে বুঝতে পেরে কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সে সব জিনিসপত্র নিয়ে নৌকায় করে নিয়ে এসেছেন প্রতাপনগরের লস্কারী খাজরা চেয়ারম্যান বাড়ির রাস্তার সামনে। আবুল কালাম গাজীর স্ত্রী নারগিস বেগম কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, গত চারদিনের মধ্যে মাত্র তিন চার বেলা খাওয়া হয়েছে। রান্না করার জায়গা নেই। আর থাকা গেল না এই এলাকায়। যা ছিলো সব নিয়ে চলে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোথায় যাবো ঠিক নেই। তবে এখানে আর ফিরবো না। ফিরবো কোথায় জায়গা-জমি যা ছিলো সবতো খাল হয়ে গেছে। কষ্ট করে সম্পদ তৈরী করবো আর কিছুদিন পর তা ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসে নিয়ে চলে যাবে। তার চেয়ে অন্য এলাকায় কিছু করতে পারি কিনা দেখি।সেখান থেকে একটু সামনে যেতেই দেখা দেখা হয় একই এলাকার ফিরোজা বেগম (৪৪) সাথে। তাদের সাত কাঠা জমি ক্লোজারে বিলিন হয়েছে। শুধু নিতে পেরেছেন ঘরের কয়েকটি খুটি আর কিছু জ্বালানি। তিনি তার তিন ছেলেকে নিয়ে সাতক্ষীরার ভোমরা যাবেন দুর সম্পর্কের এক আত্মীর বাড়িতে। সেখানে থেকেই খুঁজবেন নতুন আশ্রয়। এই কয়দিন খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো হয়নি বলেই কাঁদতে কাঁদতে ফিরোজা বেগম বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের পর থেকে জোয়ার-ভাটার মধ্যেও বসবাস করছিলাম। যাওয়ার জায়গা নেই। তাই হাজার কষ্ট করে হলেও নিজের বাড়িতে ছিলাম। তিন ছেলে ইট ভাটায় কাজ করে আম্পানের আগে তিনটি ঘর তৈরী করেছিলাম। কিন্তু কপোতাক্ষের ভয়াল গ্রাসে সব নিয়ে গেছে। আম্পানে এতো ক্ষতি হয়নি আমাদের। আমার জীবনে এতো পানি কখন দেখিনি আমি। সব সাগর হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট কিছু নেই। যাদের বাড়িঘর আছে তারা বের হতে পারছে না। বাজার করতে পারছে না। এলাকার অধিকাংশ মানুষের না খেয়ে দিন কাটছে। সরকার এই এলাকায় দ্রুত বাঁধের ব্যবস্থা না করলে এসব এলাকার কিছু থাকবে না। সব নিয়ে যাবে কপোতাক্ষ-খোলপেটুয়া। আবুল কালাম গাজী অথবা ফিরোজা বেগম নয় আরও অনেকে এমনিভাবে বাপ-দাদার ভিটা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর ও শ্রীউলা ইউনিয়নের মানুষ। প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন জানান, একের পর এক দুর্যোগ আমাদের লেগেই আছে। আম্পানের রেশ কাটতে না কাটতেই কপোতাক্ষ-খেলেপেটুয়া বাঁধ ভেঙে পুরো এলাকা পানিতে ভাসছে। এলাকার অনেক মানুষ জোয়ারের পানিতে বড় বড় খালের সৃষ্টি। অনেকের বাড়ি ঘর নদীতে বিলিন হয়ে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেক মানুষ বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কোথায় যাবে কোথায় থাকবে তারা কিন্তু জানেন না। তার পরও একটু বাঁচার আশায় তারা চলে যাচ্ছে। তিনি আরও জানান, এখানকার মানুষ খুবই কষ্টের মধ্যে জীবন যাপন করছে। আমার একটি যাতায়াতের রাস্তা ভালো নেই। একটি মানুষ মারা গেলে তার দাফন করার মতো মতো জায়গা নেই। ইউনিয়নের ২১টি গ্রামের মধ্যে ২০টি সম্পূর্ণ তলিয়ে রয়েছে। খুব দ্রুত যদি বাঁধগুলো সংস্কার করা নায় হয় তাহলে দেশের মানচিত্র থেকে প্রতাপনগর হারিয়ে যাবে। এই ইউনিয়নটি কপোতাক্ষ-খোলপেটুয়া নদীর সঙ্গে মিশে যাবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। সেগুলো আমরা দুর্গত মানুষের মাঝে বিতরণ করেছি। কিন্তু তাদের রান্না করার জায়গা নেই যে রান্না করে খাবে। আমাদের একটাই দাবী। আমার ত্রাণ চাই না, আমরা বাঁধ চাই।