বিশ^ব্যাপী করোনা সংক্রমনের মহামারী আকার ধারন, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরোধের সর্বাত্মক চেষ্টা, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসনের অব্যাহত অভিযান এবং নিজের ব্যক্তিগত অসুস্থতার মধ্যেও সুখস্বপ্ন অনুভব করে মুজিববর্ষে আজকের এই প্রবন্ধে হাত দেওয়া।
ভোরের আঁধার ভেদ করে পূব আকাশে রক্তিম সূর্যের উদয়নে বনমোরগের ডাক নিদ্রা ভাঙ্গায় জেলে বাওয়ালি মৌয়ালের।তারপর ভয়ংকর বাঘের আনাগোনা, হরিণের ক্ষিপ্রগতি দৌড়, বানরের বাঁদরামি, নোনা পানিতে ছাপিয়ে ওঠা শুলোবন, তবু থামেনা কর্মব্যস্ত জেলে বাওয়ালির জীবন সংগ্রাম।এই তো প্রকৃতির দেওয়া শ্যামল সবুজমাখা অনিন্দ্যসুন্দর বিশ^সেরা ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। পাখির অবিরাম কোলাহল। বেলা শেষে লাল সূর্যের আভা ছড়িয়ে প্রকৃতিকে মাতিয়ে তুলে সন্ধ্যার আঁধার শয্যাক্রোড়ে আত্মসমর্পন।
বাংলাদেশের রক্ষাপ্রাচীর দক্ষিণের সুন্দরবনের এই চিরায়ত চিত্র এখন অনেকটাই বিরল। মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির বোঝা মাথায় নিয়ে সুন্দরবন হারাতে বসেছে তার সৌষ্ঠব,সৌন্দর্য,সম্পদ। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো ঘোষিত বিশ^ ঐতিহ্য সুন্দরবনের এই দশা বাংলাদেশের জন্য এক বড় হুমকি।
১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকা রেস কোর্স ময়দানে বৃক্ষরোপন সপ্তাহ উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন ‘সুন্দরবনকে রক্ষা করেন।না হলে বাংলাদেশ থাকবে না।বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে । আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবনকে পয়দা করি নাই,স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটা করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য।এইটা হলো বেরিয়ার।এটা যদি রক্ষা করা না যায় তাহলে আমাদের সমস্ত এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং হাতিয়া সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে’।
প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে বঙ্গবন্ধুর এই সতর্কবাণী আমরা যথাযথভাবে পালন করলে সুন্দরবনের এই দুর্দশা দেখতে হতো না। এখন বিজ্ঞানীরা বলছেন আগামি কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূল পানিতে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু উদ্বাস্তু হবে কয়েক কোটি মানুষ। বাংলাদেশের জন্য এ খবর ভয়ংকর বিপজ্জনক এক অশনি সংকেত। ‘সুন্দরবনকে বাঁচান’ মুজিববর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ভবিষ্যত বাণীর বাস্তবায়নই হতে পারে সুন্দরবনের রক্ষা কবচ।
কোনো একদিন বিলুপ্ত প্রায় ব্যাঘ্রকুলকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও সুন্দরবনের বাঘের চেয়েও ভয়ংকর বিশ^খ্যাত বাঘ শিকারী পচাব্দী গাজি আর ফিরবেন না কোনোদিন। ১৯৯৭ সালের ১৩ অক্টোবর গাবুরা ইউনিয়নের সোরায় নিজ বাড়িতে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ৭৩ বছর বয়সে মারা যান ৫৬ টি বাঘ শিকার করে বিশ^ রেকর্ড সৃষ্টিকারী পচাব্দী গাজি। নতুন করে আবারও শোনা যেতে পারে বাঘের হুংকার, বনে দেখা যেতে পারে ব্যাঘ্র্র পদচিহ্ন। হারিয়ে যাওয়া জীব বৈচিত্র্য, প্রাণি সম্পদ নতুন জীবন পেতে পারে। হারিয়ে যাওয়া সুন্দরী বৃক্ষসহ সব বৃক্ষরাজি ফিরতে পারে নতুন বনভূমি হয়ে।
দক্ষিনের বঙ্গোপসাগরের তীর জুড়ে ধ্যানী মুনির মতো দন্ডায়মান শ্যামল সবুজ শোভার চোখ জুড়ানো সুন্দরবন। বাংলাদেশের প্রাচীর খ্যাত এই বনরাশি বারবার সব প্রাকৃতিক আঘাত সয়েও রক্ষা করেছে বাংলার মাটি জনপদ জীবন কৃষ্টি সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে। মুজিববর্ষে এই বিশাল লবণাম্ভু বনররাজিকে আবারও প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী হতে হবে। তবেই সুন্দরবন প্রতিভাত হবে ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমির গাছে সাপ এর হৃত ছবিতে।
১৯৪৭ এ ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের বৃহদাংশ ৬০১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬২ শতাংশ) বাংলাদেশের ভাগে পড়ে। এর ৪১৪৩ বর্গ কিলোমিটার ভূমি এবং ১৮৪৭ বর্গ কিলোমিটার জলাধার। ব্যাঘ্র ছাড়াও চিত্রল হরিণ,কুমির ,সাপ,বানর, শত প্রকারের পাখি এবং সহস্র প্রকারের উদ্ভিদ ও হেতাল শন গোলপাতা নল খাগড়া সুন্দরী গরাণ গেওয়া পশর কেওড়া কাঁকড়া বাইন বৃক্ষ সজ্জিত সুন্দরবন ২৪ ঘন্টায় বার কয়েক নোনা পানিতে ¯œাত হয়। দুই আড়াই ফুট পর্যন্ত উঠা জোয়ারের পানিতে শুলোবন তলিয়ে থাকে। আবার তা নেমে যায়। দৈনিক গড়ে ৫০ হাজার ভাসমান জনগোষ্ঠী সুন্দরবনে শ্রম দেয়। মৎস্য আহরণে নদী খালে ভেসে বেড়ায় শত শত জেলে মাঝি।
এক সময় সুন্দরবনের প্রাণি নিধন নিষিদ্ধ ছিল না। প্রাণি সম্পদ এবং জীব বৈচিত্র্য সুরক্ষার লক্ষ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৪ সালে প্রণীত হয় বন্য প্রাণি নিধন আইন। এই আইন প্রণয়নের পর থেকে কার্যতঃ বন্য প্রানি নিধন নিষিদ্ধ হওয়ায় বনভূমি জুড়ে নতুন প্রাণের সঞ্চর হয় প্রাণিকুলের জীবনচক্রে। কিন্তু এর বিপরীতে বন জুড়ে গড়ে ওঠে চোর শিকারীদের গোপন সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট প্রাাণি সম্পদ ধংসের কাজে এখনও নিয়োজিত রয়েছে। এরপর ২০১২ সালে প্রণীত হয়েছে বন্য প্রাণি সংরক্ষণ আইন। তবু চোর শিকারীরা বাঘ হরিণ শিকার ও কুমির নিধন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বনের মূল্যবান বৃক্ষসম্পদ চুরি করে পাচার করে আসছে। আর এ কারণেই বন হয়ে পড়ছে শীর্ণকায়। হারাচ্ছে তার সম্পদ সম্ভার। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সুুদুর প্রসারী ক্ষয় ক্ষতি। আর এজন্য বিশে^র ধনী শিল্পোন্নত দেশগুলির কাছে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে জলবায়ূ ক্ষতিপূরণ দাবি করে আসছে বালাদেশ। মুজিববর্ষে এই দাবি আরও বেগবান করা জরুরি।
সুন্দরবনের ৪৫০ টি নদ নদীতে এবং মাকড়সার জালের মতো বিস্তারিত খালে এখন নানা কারণে জেগে উঠেছে অসংখ্য ডুবো চর। বনভূমির মধ্যে কোথাও কোথাও দৃশ্যমান হচ্ছে ধু ধু বালু চর। কমে গেছে বৃক্ষ সম্পদ, বাড়ছে না গাছ গাছালি, পাখ পাখালি,গোলপাতার উৎপাদন। এই গোলপাতা এক সময় দেশের দক্ষিণ উপকূলের জেলাগুলিতে নি¤œ থেকে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারও ব্যবহার করতো তাদের বসত ঘরের ছাউনি হিসাবে। এ দৃশ্য এখন হারিয়ে গেছে। মুজিববর্ষে এই দিনটি ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।
হাজার জাতের মৎস্য সম্পদের আকর এই সুন্দরবন। সেখানেও থাবা পড়েছে অশুভ শক্তির। নদনদীর পানি থেকে মাছের রেণু আহরন করে মাছের জীবনচক্রে ভাটা পড়েছে। মধু মৌচাক ,মোম, জোংড়া , শামুক ,ঝিনুকে ভরা সুন্দরবনকে সম্পদশালী করে তুলেছে। ভাটা পড়েছে সেখানেও । সুন্দরবন উপকূলের দশ লক্ষাধিক মানুষের জীবন ও জীবিকার কেন্দ্রস্থল সুন্দরবন। বনজ ফলজ জলজ ও সামুদ্রিক সম্পদ সংগ্রহ করে সরকার সুন্দরবন থেকে অর্জন করছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। এই অর্জনকে ধরে রাখতে উদ্যোগী হতে হবে এখনই।
সুন্দরবনের নদ নদীতে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে লবণাক্ততা। এর বিরুপ প্রভাব পড়ছে বনভূমির মৃত্তিকায়ও। মারা যাচ্ছে বৃক্ষ সম্পদ। রোগাক্রান্ত বৃক্ষ হয়ে পড়ছে আরও শীর্ণ। মিষ্টি পানি না পেয়ে বাঘ খাচ্ছে তীব্র নোনা পানি। এতে বাঘ আক্রান্ত হচ্ছে লিভার সিরোসিসসহ নানা ব্যাধিতে। ফলে বাঘের জীবন হয়ে পড়ছে বিপন্ন।মিষ্টি পানির খোঁজে লোকালয়ে এসে মারা পড়ছে বাঘ। বনে ঢুকে বিভিন্ন কৌশলে ব্যাঘ্র হত্যা করে চোরাশিকারীরা বাঘের মাংস চামড়া, দাঁত হাড়গোড়, নখর,পশম বিক্রি করছে কালোবাজারে। গত দুই দশকে খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাট অঞ্চলে দৃশ্যমান কমপক্ষে ৩০ টি ব্যাঘ্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ফাঁদে আটকে গণপিটুনি দিয়ে নৃশংসভাবে ব্যাঘ্র হত্যা করে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে উঠতে দেখা গেছে।্ এ ছাড়া এ অঞ্চলে একই সময়ের ব্যবধানে ২৫ টিরও বেশি বাঘের চামড়া আটকের ঘটনা ঘটেছে। সে সময় সুন্দরবনে বাঘের আনাগোনা এতো বেশি ছিল যে কেবলমাত্র ২০১২ সালে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে ১৮ জন মৌয়াল জেলে বাওয়ালিকে বাঘে খেয়েছে। একই সময়ে বাঘের হামলায় আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে গেছে অগণিত বনজীবী। চোরাশিকারীরা ফাঁদ পেতে অথবা গুলি করে হরিণ শিকার করে বিক্রি করছে চামড়া। এর মাংস খেয়ে মেটাচ্ছে লোভ লালসা। এসব কারণে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যাও হ্রাস পাচ্ছে। বেসরকারি হিসাব মতে ২০০৪ সালে বনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৬০ টি। বর্তমান সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ১০৬ টিতে। ব্যাঘ্র সংখ্যা হ্রাসের কারণ বনভূমির ঘনত্ব হ্রাস, চোরাশিকারীদের নৃশংসতা ও বনে মিষ্টি পানির অভাব। এসব কারণে বনের রাজা বাঘেরাই এখন নিরাপত্তাহীনতায়। বনের বাঘের এই নিরাপত্তা দিতে মুজিববর্ষ হতে পারে শ্রেষ্ঠ সময়।
বাদাবনের রাজা বাঘ তাড়িয়ে সেখানে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ভয়ংকর জলদস্যুরা। অস্ত্রধারী এসব দস্যু মুক্তিপণ আদায়ে নিরীহ জেলে বাওয়ালিদের জিম্মি করে নির্যাতন চালায় । নগদ টাকা দিয়ে তাদের উদ্ধার করতে হয়। জলদস্যুরা বনে লুটপাট এমনকি খুন খারাবির মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। জলদস্যুদের কারণে সুন্দরবনে জেলে বাওয়ালির প্রবেশ সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সুন্দরবনের এই দস্যু সন্ত্রাস রুখতে হবে। মুজিববর্ষে কঠোর অবস্থানে থেকে জলদস্যুদের মূলোৎপাটন করতে হবে।
সুন্দরবনে আগুন লাগার মতো ঘটনাও ঘটছে। দাবানল বা প্রকৃতিগত কারণে নয়, মনুষ্য সৃষ্ট কারণে ঘটছে এই বিপর্যয়।২০০২ সাল থেকে এ পর্যন্ত সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগে ১৩ টিরও বেশি ছোট বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। রুখে দিতে হবে এই দুর্বৃত্তায়ন।
ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাস বারবার হানা দিলেও সুন্দরবন উপকূলে সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির ঘটনা অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভয়াল ভয়াল ঝড় জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানলেও সুন্দরবন প্রাচীরের কারণে সেই থাবা বহুলাংশে ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশ ভারতে কয়েক বছরের দুর্যোগচিত্র
০১. সুপার সাইক্লোন (গোর্কি), ১২.১১.৭০ ———নিহত ৩০০০০০ (তিন লাখ)
০২. হ্যারিকেন ২৯.১১.৮৮ ——————নিহত ৫৭০৪ জন।
০৩. বন্যা ১৯৮৮ নিহত ২৩৭৩ জন।
০৪. সুপার সাইক্লোন ২৯.০৪.৯১———————-নিহত ১,৩৮,৮৮৬ জন।
০৫. টর্নেডো ১৯৯৬ ———————–নিহত ৫৪৫ জন।
০৬. সাইক্লোন ১৯৯৭ ————————–নিহত ৫৫০ জন।
০৭. বন্যা ১৯৯৮ ————————————নিহত ৯১৮ জন।
০৮. বন্যা ২০০৪ ————————————নিহত ৭৪৭ জন।
০৯. বন্যা ২০০৭ ———————— নিহত ১০৭১ জন।
১০.ভূমিধ্বস ২০০৭ —————————– নিহত ১২৯ জন।
১১. সিডর ১৫.১১.২০০৭—————————–নিহত ৩৪০৬ জন।
১২. আইলা ২৫.০৫.২০০৯ ————————–নিহত ১৯০ জন
১৩. ভূমিধ্বস ২০১২ —————————- নিহত ১১৯ জন।
১৪. নিলম
১৫ লহর ২৯.১১.২০১৩
১৬ হেলেন ২৭.১১.১৩
১৭. ঘূর্ণিঝড় ফাইলিন, ১২ থেকে ১৩ অক্টোবর, ২০১৩
১৮. মহাসেন, ১৫-১৬ মে, ২০১৪ ———————নিহত ১৬ জন।
১৯. হুদহুদ ১১.১০.১৪ থেকে ১৩.১০.১৪
২০. নিলুফার ২৮.১০.১৪
২১. কোমেন ২৯.০১৫ থেকে ৩০.০৭.১৫ ——-নিহত ০১ জন।
২২. ঘূর্ণিঝড় স্কার্ট, ১৮.০৫.১৬
২৩.ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু, ২১.০৫.১৬ ——————–নিহত ০০।
২৪. ঘূর্ণিঝড় কায়ান্ট, ২৫.১০.১৬
২৫. ঘুর্নিঝড় মোরা ২৯.০৫.১৭। ————————–নিহত ০০।
২৬. ঘূর্ণিঝড় ফনি ০৪.০৫.২০১৯————————–নিহত ০০
২৭. ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ০৯.১১.২০১৯————————-নিহত ০০
১৯৭১ এ মহান স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ উপকূলে ১৪৯ টি সাইক্লোন জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানে। এর মধ্যে সুন্দরবন উপকূলে ১৯৮৮ এর ঘূর্ণিঝড় হ্যারিকেন , ২০০৭ এর সিডর এবং ২০০৯ এর আইলায় মোট নিহতের সংখ্যা ৯৩০০ জন। এর পরে যেসব ঝড় জলোচ্ছ্বাসের আঘাত এসেছে তা আগাম অতিমাত্রায় সতর্কতা , জেলা প্রশাসনের সর্বোত্তম চেষ্টা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির কারণে প্রাণহানি হ্রাস পেয়েছে। এমনকি কোনো কোনো সময় তা শুন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।
দেশের দক্ষিন পশ্চিমাঞ্চলে জলাবদ্ধতার চিত্র পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৮০ সালে এ অঞ্চলে ৩৫ % , ১৯৮৯ সালে ৪০% , ২০০১ সালে ৫০% এবং ২০১০ সালে প্রায় ৬০% কৃষি ও বসতি জমি স্বল্প অথবা দীর্ঘ মেয়াদি জলাবদ্ধতার শিকার হয়েছে। একই সাথে মরে যাচ্ছে এ অঞ্চলের ছোট বড় সব নদী। প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনেও । সুন্দরবনের পানিতে লবনাক্ততা বৃদ্ধি এবং নদ নদীতে চর পড়ে পানিপ্রবাহ ও নাব্য বাধার মুখে পড়েছে। জলবায়ূ পরিবর্তন জনিত এই ক্ষতি পূরণ দাবিতে মুজিববর্ষে আরও সোচ্চার হতে হবে।
এর পাশাপাশি বিজ্ঞানীরা বলছেন ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১৮ থেকে ৩৮ সেন্টিমিটার এবং এমনকি তা ২৬ থেকে ৫৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিনত হবে। গড় তাপ , তাপদাহ ও তীব্র বৃষ্টিপাত বাড়বে ব্যাপক হারে। খরা , সাইক্লোন , টাইফুন হ্যারিকেনসহ মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের ব্যাপকতা এবং উঁচু জোয়ারের প্রচন্ডতা বাড়বে । জলাবদ্ধতার বিস্তার রোধে মুজিববর্ষে মৃতপ্রায় নদ নদী পুনঃখনন জরুরি হয়ে পড়েছে।
সুন্দরবনে বাঘের হুউম, বানরের খ্যাক খ্যাক আর ডোরা কাটা চোখ চঞ্চলা হরিণের টাই টাই করে দ্রুত বেগে ছুটে যাওয়ার দৃশ্য না দেখলে বিশ^াস করা কঠিন। অথচ এই তিনই হারিয়ে যেতে বসেছে। নয়নাভিরাম সুন্দরবনে এপ্রিলে মৌয়ালদের মৌচাক কেটে মধু আহরন, গোলপাতা ছেদন করে বড় বড় নৌকায় উপকূলে নিয়ে আসা , নানা জাতের কাঠ কেটে নিউজপ্রিন্ট মিলসে ব্যবহার করা, সারা বছরই মাছ ধরার সেই পরিচিত দৃশ্য আজ অনেকটাই অপসারিত। রোজ জোয়ার ভাটার খেলা, ভাটার টানে বনের নগ্নরূপ ধারন, আবার ভরা জোয়ারে গাঙের দুই কুলে থাপ থাপ করে তালি বাজতে থাকা, নির্মল বাতাস আর অমল আলোয় হাসিখুশী সবুজ সুন্দরবন আবার ভেসে ওঠে পানির ওপর। মুজিববর্ষে ডাক এসেছে বিপর্যয়ের হাত থেকে বিশে^র সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে সুরক্ষা দেওয়ার।
ভারতের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের ম্যানগ্রোভ ২০০৪ এর ২৬ ডিসেম্বরের সুনামির অতিমাত্রার ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছিল নিকটস্থ কয়েকটি দেশকে । আর সুন্দরবন আমাদের প্রকৃতি পরিবেশ জীবন ও সভ্যতার রক্ষাকবচ হিসাবে সেই সুরক্ষা দিতে সক্ষম। এ কথা মনে রেখেই অফুরন্ত সম্পদের ভান্ডার বাঘ হরিণের অভয়ারণ্য চিরহরিৎ সুন্দরবনের সৌন্দর্য, সৌষ্ঠব ও সম্পদের নিরাপত্তা দিতে কাজ করতে হবে ।
হয়তো একদিন সুন্দরবনে আবারও শোনা যাবে ‘মাটিরও মাটি,এই মাটি দুনিয়ার কাঠি, এই মাটিতে আমি হাঁটি,আর আমার লাইয়া বাওয়ালি হাঁটে,ঘোর অন্ধকার,লাগ লাগ দোপাইয়া থুুইয়া চৌপাইয়া লাগ, আমার এই কথা যদি নড়ে, মা বনবিবির সের কেটে জমিনেতে পড়ে’। শোনা যায় শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জের গুনিন মন্তাজ আলির এই মন্ত্র কোনোদিন ব্যর্থ হয়নি। বাওয়ালিরা লাল কাপড় কিংবা বনবিবিতলার মাটির সাথে মনে মনে ধারন করেছেন গুনিনের এই মন্ত্র। বাঘ তাদের ষ্পর্শ করেনি। আজ তাই সময় এসেছে । একই বনে বাঘ বাওয়ালির বসবাস নিশ্চিত করে ডাঙ্গায় বাঘ জলে কুমির গাছে সাপ এর চিরায়ত পরিবেশ ফিরিয়ে আনাই হবে মুজিববর্ষে বাঙ্গালির দায়িত্ব।
মুজিব বর্ষে নিশ্চয়ই আবারও সেদিন ফিরে আসবে এমন প্রত্যাশা আমার । বনে ফের রাজত্ব করবে বনবিবির কাছে মাথানত করা বাংলার গৌরব রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সাতক্ষীরার আকর্ষণ সড়কপথে সুন্দরবন এর সাথে যুক্ত হোক সাতক্ষীরার আকর্ষণ মুজিববর্ষে সুন্দরবন।
মুজিব বর্ষে সেটাই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।
—-সুভাষ চৌধুরী, দৈনিক যুগান্তর ও এনটিভির সাতক্ষীরা প্রতিনিধি ও সাবেক সভাপতি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাব।
১৫.০২.২০২০ email chowdhury.ntv@gmail.com, ফোন ০১৭১১১৭০১০০