সর্বশেষ সংবাদ-
সাতক্ষীরায় গরুর দুধে ভেজাল দেওয়ার অভিযোগে ব্যবসায়ীকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাআশাশুনিতে মাটির পুকুরে গলদা (চিংড়ি) পিএল উৎপাদনে অভাবনীয় সাফল্যসড়কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনেরপোতা এলাকায় মোটরযানের উপর মোবাইল কোর্টশ্যামনগর থেকে ৬ লাখ টাকা ভারতীয় ওষুধসহ এক চোরাকারবারী আটকসাতক্ষীরায় পৃথক সড়ক দূর্ঘটনায় এক কলেজ ছাত্রসহ দুই জনের মৃত্যুশ্যামনগরে ডাম্পার ট্রাকের চাপায় কলেজ ছাত্রের মৃত্যুআশাশুনিতে কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য কমিউনিটি সার্পোট গ্রæপ এর সাথে এক আলোচনা সভাআশাশুনিতে পুলিশী অভিযানে আট আসামী আটকআশাশুনি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ৩ দিনব্যাপী স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ উদ্বোধনআলিপুর এলাকাতে মোটরযানের উপর মোবাইল কোর্ট

আশাশুনিতে বিষপানে বৃদ্ধের আত্মহত্যা

আশাশুনি ব্যুরো: আশাশুনিতে অনন্ত বৈরাগী নামে এক বৃদ্ধা বিষপানে আত্মহত্যা করেছে। অনন্ত বৈরাগী(৭০) কুল্যা ইউনিয়নের কচুয়া (হামকুড়া) গ্রামের মৃতঃ নবীন বৈরাগীর পুত্র। তার পরিবার সূত্রে জানাগেছে, বুধবার বিকালে সবার অজান্তে সে বিষপান করেন। পরিবারের লোকজন বুঝতে পেরে প্রথমে বুধহাটার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করেন। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঐ দিন সন্ধ্যায় তার মৃত্যু হয়। বিষয়টি সাতক্ষীরা সদর থানাকে অবহিত করলে সদর থানা পুলিশ লাশের সুরুতহাল রিপোর্ট শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টার দিকে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। মৃত্যুর সময় তিনি পুত্র, কন্যাসহ অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে গেছেন। তবে তার আত্মহত্যার সঠিক কারন জানা জায়নি। এ ব্যাপারে সদর থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হয়েছে।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
শ্যামনগরে স্বাধীনতা দিবস টি-২০ ম্যাচে গ্লোরিয়াস ক্রিকেট ক্লাব জয়ী

আব্দুল আলিম: মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ী মিতালী সংঘের আয়োজনে গতকাল ০১ লা মার্চ স্থানীয় কলবাড়ী নেকজানিয়া মাধ্যঃ বিদ্যালয় মাঠে এক প্রীতি টি-২০ ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়।
উক্ত খেলায় চির প্রতিদ্বন্দ্বী “গ্লোরিয়াস ক্রিকেট ক্লাব” ও “রয়েল ক্রিকেটারস” এর মধ্যকার জাঁকজমকপূর্ণ ফাইনাল ম্যাচে গ্লোরিয়াস ক্রিকেট ক্লাব ৬০ রানে জয়লাভ করেন।
বেলা ১১ ঘটিকায় অনুষ্ঠিতব্য ম্যাচ শুরুতে টসে জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন গ্লোরিয়াস ক্রিকেট ক্লাবের অধিনায়ক স.ম ওসমান গনী সোহাগ।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২০ ওভারের খেলায় ১৯ তম ওভারে সবকটি উইকেট হারিয়ে ২১২ রান সংগ্রহ করেন।
জবাবে ব্যাট করতে নেমে রয়েল ক্রিকেটারস এর খেলোয়াড়েরা প্রথমে বিপর্যের সম্মুখীন হয়। ২১৩ রানের লক্ষ্য তাড়া করে সবকটি উইকেট হারিয়ে ১৫২ রান করতে সক্ষম হন। উক্ত ম্যাচে সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে রাকেশ মন্ডল ব্যক্তিগত ৮৪ রান এবং সেরা বোলার হিসেবে তানভীর সোহেল ৫ টি উইকেট শিকার করেন।

বিজয়ী দল, সেরা খেলোয়াড়, আম্পায়ার, স্কোরার ও কমেন্টেটরের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের ১০ নং ওয়ার্ডের সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান, পরিচ্ছন্ন তরুণ জননেতা বাবু ডালিম কুমার ঘরামী।
এ সময় অন্যান্যদের মধ্য উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক গৌতম মন্ডল, ইউপি সদস্য কামরুজজামান, শ্যামল কুমার, সমাজসেবক সাবুত আলী, রেজাউল ইসলাম মোল্লা প্রমুখ।

স্কোরারের দায়িত্বে ছিল আল-মামুন ও কমেন্টেটরের দায়িত্বে ছিল গৌতম। সমগ্র খেলাটি পরিচালনা করেন আম্পায়ার দেবদাস বর্ম্মন ও মো. ফারুক হোসেন।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
প্রধানমন্ত্রীর খুলনা আগমন উপলক্ষ্যে খলিষখালী আ. লীগের স্বাগত মিছিল ও প্রস্তুতি সভা

সমীর দাশ,পাটকেলঘাটা: রাত পোয়ালেই খুলনা বাসির কয়েকটি স্বপ্ন পূরাণে আসছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সফল প্রধানমন্ত্রী উপমহাদেশের প্রাচীনতম দল বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। তার আগমনকে কেন্দ্র করে সাজ সাজ রব সমগ্র বিভাগ জুড়ে, তারই অংশ হিসাবে খলিষখালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ প্রস্তুতি সভা ও স্বাগত মিছিল করে।
১ লা মার্চ বিকাল ৫ ঘটিকায় বাংলা দেশ আওয়ামীলীগ ৯ নং খলিষখালী ইউনিয়ন শাখা খলিষখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের হল রুমে শেখ হাসিনার খুলনায় আগমনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুতি সভা করে। সভায় ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সহ- সভাপতি বাবু সুনিলদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পদক বাবু সমীর কুমার দাশ, সদস্য ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোজাফ্ফার রহমান, সহ-সভাপতি আফতাব মোড়ল, যুগ্ম- সম্পদক শরিফুল সরদার, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পদক নজরুল ইসলাম, ওয়ার্ড কমিটি গুলোর সভাপতি/সম্পদক দুলাল দাশ, ভৈরব চন্দ্র সরকার, মোকাম গাজী, সত্যেন্দ্র নাথ বিশ্বাস, টুটুল খাঁ, সন্তোষ চক্রবর্তী, নীলকোমল দাস, তোতা সরদার, শফিকুল মোল্ল্যা, কার্ত্তিক মণ্ডল, শফিকুল সরদার, শেখর কুণ্ড, সুলতান সরদার, ইউনিয়ন কৃষকলীগের আহব্বায়ক বিধান দাশ, যুবলীগনেতা বিপ্লব মুখার্জী (চাঁদু),সুজাত সানা, আব্দুল্লাহ আল মামুন (রনি),ফজলু সরদার, ছাত্রলীগের সভাপতি ফারদ্বীন এহসান দ্বীপ প্রমুখ। সভাশেষে স্বাগত মিছিলটি বাজার প্রদক্ষিণ করে।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
প্রচণ্ড শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর দাবি পুতিনের, যুক্তরাষ্ট্রের বিস্ময়

নির্বাচনের আগে দেওয়া এক ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন অসীম ক্ষমতার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের দাবি করেছেন। তার এ ক্ষেপণাস্ত্র বানানোর দাবিতে মার্কিন কর্মকর্তারা বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছেন এ ধরনের কোনো অস্ত্র পরীক্ষার প্রমাণ তারা পাননি।

বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টের দুই কক্ষের যৌথ অধিবেশনে বার্ষিক ‘স্টেট অব দ্য ন্যাশন’ ভাষণে পুতিন এ ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণের দাবি করেন। তিনি এ সময় অ্যানিমেশন ভিডিও প্রদর্শন করে দাবি করেন, রাশিয়া নতুন কয়েকটি অস্ত্র বানিয়েছে। এগুলো মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করতে সক্ষম বলেও দাবি তার।

পুতিন বলেন, তার দেশ একটি নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, একটি ছোট পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র, পানির নিচে চলাচলে সক্ষম পারমাণবিক ড্রোন, একটি সুপারসনিক অস্ত্র এবং লেজার অস্ত্র তৈরি করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ রাশিয়ার নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটির ব্যাপারে বিস্ময় ও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, রাশিয়া সম্প্রতি খুব কমই ক্ষেপনাস্ত্র পরীক্ষা করেছে। এছাড়া যেগুলো পরীক্ষা করেছে তার সবই ধ্বংস হয়ে গেছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।

হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি সারাহ স্যান্ডার্স এ বিষয়ে বলেন, পুতিন বিষয়ে এতদিন ধরে যে বিষয়গুলো যুক্তরাষ্ট্র  জানত, তাই নিশ্চিত করেছেন তিনি। রাশিয়া প্রায় এক দশক ধরে স্থিতিশীলতা নষ্ট করার মতো অস্ত্র তৈরি করছে, যা পূর্ববর্তী চুক্তিবিরোধী।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
শিগগিরই মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করবো : এরশাদ

শিগগিরই আমি ও আমার পার্টির মন্ত্রীরা মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করবো বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। হঠাৎ করে কেন এই সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে এরশাদ এটিকে রাজনৈতিক কৌশল বলে মন্তব্য করেন।

আজ শুক্রবার সকালে রংপুরে সার্কিট হাউজে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা জানান।

এরশাদ বলেন, বিএনপির সাথে জাতীয় পার্টির জোট করার কোনো সম্ভাবনা নেই। আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসবে কিনা সে ব্যাপারে আমার যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে। তার পরেও সরকার চেষ্টা করছে। আমরাও মনে করি তাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা উচিত।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়ার জামিন পাওয়া নিয়ে হৈচৈ করা হচ্ছে। আমি ৬ বছর ২ মাস কারাগারে ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে সব মামলাই ছিলো জামিন যোগ্য। তার পরেও আমি জামিন পাইনি।

আমার প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে তার কোনো নজির নেই।

এ সময় জাতীয় পার্টির কো চেয়ারম্যান জিএম কাদের, মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা, নির্বাহী সদস্য শাফিউল ইসলাম শাফী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
কুয়ার বাইরে

কুয়ার বাইরে

কর্তৃক Daily Satkhira

স্বকৃত নোমান
কুয়ার বাইরে

মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবী এবার পাকা নিয়ত করলেন ইন্দোনেশিয়া যাবেনই। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশটি দেখার ইচ্ছা তার বহুদিনের। দেশটির রাজধানী জাকার্তায় প্রায় পনের বছর ধরে তার বড়বেটা আবুল হাশেমের বসবাস। বিয়েও করেছে সেখানেই, এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ারকে। চাঁদের মতো দুটি ছেলেমেয়ে। ছেলেটার বয়স আট, মেয়েটার পাঁচ। নাতি-নাতনিকে কখনো চোখের দেখা দেখেননি কাশেম। ছবির দেখাকে কি আর দেখা বলে?

প্রকৌশলবিদ্যায় তিন বছর মেয়াদি মাস্টার্স প্রোগ্রামের স্কলারশিপ নিয়ে ইন্দোনেশিয়া গিয়েছিল আবুল হাশেম। মার্স্টাস শেষ করে ভেবেছিল দেশে ফিরে আসবে, কিন্তু একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে থেকে গেল। বাংলাদেশের তখন যা হাল! সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি টালমাটাল, হরতাল-অবরোধে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী, বেকারত্বের অভিশাপে যুবসমাজ জর্জরিত। কখন কী ঘটে যায় বলা যায় না। দেশে ফিরে করবেটা কী? বেতন কম হলেও থেকে যাওয়াটাই ভালো মনে করল। পরিশ্রম করলে বেতন বাড়তে কদিন।

হাশেমের ইচ্ছে ছিল ইউরোপের কোনো দেশে স্কলারশিপ নিয়ে যাওয়ার। কাগজপত্রও রেডি করেছিল, কিন্তু অনুমতি দিলেন না তার বাবা। কাফের-মুশরিকের দেশে লেখাপড়া করতে গিয়ে ছেলেটাও যদি তাই হয়ে যায়! হচ্ছে না? তার এক বন্ধুর ছেলে বহু দৌড়ঝাঁপ করে বহু টাকা খরচ করে নরওয়ে গেল। তার বাবা কত বড় আলেম, পুরো জেলায় নামডাক, ছেলে কখনো এক ওয়াক্ত নামাজ ক্বাজা করেনি, অথচ সাত বছর পর দেশে ফিরল কিনা আস্ত একটা নাস্তিক হয়ে!

বাবাকে ইন্দোনেশিয়ায় আনতে পারবে কোনোদিন ভাবেনি হাশেম। বিয়ে করেছে দশ বছর হয়ে গেল, অথচ বাবা-মাকে এখনো বউয়ের মুখটা দেখাতে পারেনি। বিয়ের এক বছর বাদেই ছেলেটা জন্মালো। দুধ ছাড়তে না ছাড়তেই নিনিমারইয়ানির পেটে মেয়েটা নড়াচড়া শুরু করে দিল। দুই সন্তানের পেছনেই চলে গেল টানা ছয় বছর। মেয়েটা দুধছাড়ার পর চাকরিতে যোগ দিল নিনিমারইয়ানি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই চাকরি, সরাক্ষণ ব্যস্ত, বাংলাদেশে আসার মতো সময় কই? তবু বউ-বাচ্চা নিয়ে একবার দেশটা ঘুরে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল হাশেম। নিনিমারইয়ানি রাজি হলো না। পেট্টোলবোমায় সারা দেশে তখন যে হারে মানুষ মরছে, ছেলেমেয়ে নিয়ে কেন মরতে আসবে নিনিমারইয়ানি?

পেট্টোলবোমা বন্ধ হওয়ার পর, সরকার যখন মোটামুটি স্থিতিশিল, একদিন হাশেম বলল, ‘চলো এবার যাই।’ চোখ দুটো কমলালেবুর মতো করে নিনিমারইয়ানি বলল, ‘মাথা খারাপ! তোমার দেশে মানবাধিকার বলতে কিছু আছে? লেখক-ব্লগারদের যেভাবে গলা কেটে মারা হচ্ছে, সরকার একটা টুঁ শব্দ করছে? তুমিও তো মাঝেমধ্যে ব্লগে লেখ। তোমার গলাটা না আবার কেটে দেয়! ঐ খুন-খারাপির দেশে বাবা আমি যাব না। যেতে চাইলে তুমি একা যাও।’

মেয়েটার জন্মের পর বাবাকে ইন্দোনেশিয়া বেড়িয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল হাশেম। মাওলানা আবুল কাশেম রাজি হয়ে গেলেন। এক মাসের মধ্যে পাসপোর্টও হয়ে গেল। কিন্তু ভিসার জন্য ঢাকায় যাওয়ার সময় কই তার? কত ব্যস্ত মানুষ তিনি। একটা মাদ্রাসার মুহতামিম। আল জামেয়াতুল আরাবিয়া জগন্নাথপুর। নিজের হাতেগড়া মাদ্রাসা। হাসতম ক্লাস পর্যন্ত। এতিমখানাও আছে একটা। আবাসিক-অনাবাসিক মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন শ তালেবুল এলেম লেখাপড়া করছে। তার উপর তিনি সোহবতে ইসলামের জেলা কমিটির নায়েবে আমির। নাস্তিকদের ফাঁসির দাবিতে ঢাকার শাপলা চত্বরের মহাসমাবেশে নিজের মাদ্রাসা থেকে দেড়’শ তালেবুল এলেম ঢাকায় নিয়েছিলেন তিনি। এত ছাত্র জেলার আর কোনো মাদ্রাসার কোনো মুহতামিম নিতে পারেননি। জেলা আমির খুশি হয়ে নায়েবে আমির পদে ভূষিত করলেন তাকে।

তারপর থেকেই ব্যস্ততার সীমা নেই তার। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মিটিং-মিছিল-সমাবেশ। থাকবে না? দ্বীন-ইসলামের বিরুদ্ধে যা শুরু করেছে সরকার। ভারতের কাছে মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতা দখল করতে না করতেই আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল, নাস্তিকদের আস্কারা দিতে দিতে মাথায় তুলে ফেলল। কয়েক বছর যেতে না যেতেই সম্পূর্ণ ইসলাম-বিরোধী নারী উন্নয়ন নীতি ঘোষণা করল। দেশের ঈমানদার ওলামা-মাশায়েখরা কি আর চুপ করে বসে থাকতে পারে? আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে তারা? বহু ভাগে বিভক্ত আলেম-ওলামারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করলেন সোহবতে ইসলাম সংগঠন।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে নাস্তিকরা যখন ইসলামের অপমান শুরু করল, আলেম-ওলামাদের ফাঁসির দাবিতে যখন শাহবাগে অবস্থান নিল, আবারও কর্মসূচি ঘোষণা করতে হলো সোহবতে ইসলামকে। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক নিয়মে শাপলা চত্বরে জমায়েত হলো সংগঠনের হাজার হাজার মর্দে মুজাহিদ। তাঁবেদার পুলিশ-বাহিনিকে ব্যবহার করে সাউ- গ্রেনেড ফাটিয়ে কী নির্যাতনটাই না করল সরকার! শত শত আলেম-ওলামাকে কান ধরে উঠবস করিয়ে কী অপমান-অপদস্তই না করল!

তবু থামল না জালিম সরকার, একের পর এক ইসলাম-বিরোধী কর্মকা- চালিয়ে যেতেই লাগল। ইসলামের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করল একজন বিধর্মীকে প্রধান বিচারপতির আসনে বসিয়ে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে, যে দেশে হজ্বের পর মুসলমানদের সবচেয়ে বড় জমায়েতটি হয় তুরাগ নদের তীরে, যে দেশের রাজধানীকে বলা হয় মসজিদের নগরী, সে দেশের প্রধান বিচারপতি তো হবেন একজন পাক্কা মুসলমান। অথচ সরকার করলটা কী! এ নিয়ে কর্মসূচি দিতে হলো সোহবতে ইসলামকে। ভারতের তাঁবেদার সরকার দেশের ওলামা-মাশায়েখের দাবিকে পাত্তাই দিল না।

কদিন পর ইসলামকে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেওয়ার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সরকারের এক দালাল হাইকোর্টে রিট করল। আবারও কর্মসূচি দিতে হলো সোহবতে ইসলামকে। তৌহিদি জনতার চাপে পড়ে রিট খারিজ করতে বাধ্য হলো হাইকোর্ট।
আন্দোলনের পর আন্দোলন। একটা গেলে আরেকটা আসে। মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবীর বিশ্রাম নেই। আজ এই মিটিং তো কাল ঐ মিছিল। দ্বীন-ইসলাম হেফাজতের নানা আন্দোলন-সংগ্রামে তার মাস ফুরায়।

দুই
কাগজপত্র সব ঠিকঠাক ছিল। ইন্দোনেশিয়ার ভিসা পেতে মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবীকে বিশেষ কোনো জটিলতা পোহাতে হলো না। নায়েবে মুহতামিমের উপর মাদ্রাসা পরিচালনার ভার দিয়ে, গারুড়া এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে করে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়ে গেলেন তিনি। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে ছেড়ে বিমানটি যখন ভূপৃষ্ঠ থেকে আটাশ হাজার ফুট উপরে উঠল, গেদা শিশুর মতো হাউমাউ করে তিনি কান্না শুরু করলেন। পাশের যাত্রীটি জিজ্ঞেস করল, ‘এনি প্রবলেম?’ তিনি কাঁদতেই লাগলেন। যাত্রীটি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এনি প্রবলেম মি. মাওলানা?’ তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তেরি বাত মেরে চমজ মে নেহি আতা ভাইসাহাব। বাংলা সে বলো, ওয়ারনাহ উর্দু।’ লোকটি কিছু না বুঝে মাওলানার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ভাবল, দেশ ছেড়ে বিদেশ যাচ্ছেন মি. মাওলানা, দেশের জন্য খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।

মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবীর কান্নার কারণ আসলে অন্য। বিমানটা যখন এয়ারপোর্ট থেকে উড়াল দিল, জানালার ফাঁকে তাকিয়ে তিনি তখন ঢাকা শহরটাকে দেখছিলেন। বড় বড় দালান-কোঠা গাছপালা রাস্তা-ঘাট ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষুদ্র থেক ক্ষুদ্র হতে হতে একটা সময় অদৃশ্য হয়ে গেল। চারদিকে শূন্যতা আর শূন্যতা। কেমন ভয় ভয় করতে লাগল তার। দোয়া-কালাম পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন। তাতেও কাজ হলো না। মাথাটা কেমন ঘুরতে লাগল।

হঠাৎ চোখে পড়ল পেজাতুলো মেঘ। মেঘের স্তুপ কোথাও পাহাড়ে মতো, কোথাও মসজিদের মিনারের মতো, কোথাও গম্বুজের মতো, কোথায় মখমলের গালিচার মতো। সারাজীবন মেঘ দেখেছেন নিচ থেকে, এখন দেখছেন উপর থেকে। সুবহানাল্লাহ! রাব্বুল ইজ্জতের কী মহিমা! মেঘ দেখতে দেখতে আধা ঘণ্টা পার করে দিলেন। এয়ারকুলারের ঠাণ্ডায় ঝিমুনি এসে গেল তার। বিমানটা হঠাৎ কেঁপে উঠলে ঝিমুনিটা কেটে গেল। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আকাশটাকে ধু-ধু মরুভূমির মতো মনে হলো। তখন মনে পড়ে গেল জাজিরাতুল আরবের কথা। আরবের মরুভূমি বুঝি দেখতে এমন? এমন মরুভূমি তিনি কত দেখেছেন খোয়াবে! শেষরাতে খোয়াবের মধ্যে হেঁটে হেঁটে কতবার তিনি মক্কা থেকে মদিনায় গেছেন, কত ঘুরেছেন বদর-উহুদ-তায়েফেরে মরুপ্রান্তরে। হাজিরা এমন মরুভূমি পাড়ি দিয়েই বুঝি মক্কা থেকে মদিনায় যায়? আহা পবিত্র রওজার দেশ! মৃত্যুর আগে নিশ্চয়ই তিনি হজ করতে যাবেন। রওজা মোবারক না দেখে তার যেন মৃত্যু না হয়। ছেলের এখন টাকাপয়সা হয়েছে, বাবার ইচ্ছা সে অপূর্ণ রাখবে না।

না, এসবও তার কান্নার কারণ নয়। তিনি কাঁদছিলেন আসলে খোদার কুদরত দেখে। আশরাফুল মাখলুকাতের জেহেনে কী হেকমত দিলেন পাক মাওলা, টন টন লোহাকে আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে মানুষ। বাইরের দুনিয়ায় গরমে মানুষের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, অথচ বিমানের ভেতরে কিনা শীতকাল! কী কুদরত খোদার। জীবনটা প্রায় শেষই হয়ে গেল, অথচ খোদার এমন কুদরত তিনি কখনো দেখলেন না।

‘আল্লাহু আকবার’ বলে দু-হাত তুলে তিনি মোনাজাত ধরলেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, ‘মাবুদ, তোমার দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া, তোমার এই গুনাহগার বান্দাহকে তুমি তোমার কুদরত দেখাচ্ছ। পাক কালামে তুমি ঠিকই বলেছ, কুল সিরু ফিল আরদ…। তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ কর। আমি ভ্রমণে বেরিয়েছি মাবুদ। আমার ভ্রমণ তুমি কবুল করো।’

উত্তেজনার সীমা নেই মাওলানা ফেনবীর। জাকার্তা এয়ারপোর্টে কখন পৌঁছবে বিমান! পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম দেশের মাটিতে কদম রেখে কখন নিজেকে ধন্য করবেন! কখন দেখবেন বড় বড় মিনার ও গম্বুজের বিশাল বিশাল সব মসজিদ! বিমানে ওঠার আগে ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। বিকেল ঠিক পাঁচটায় জাকার্তা এয়ারপোর্টে পৌঁছবে বিমান। হাশেম তার অপেক্ষায় থাকবে ভিআইপি লাউঞ্জের বাইরে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে বিমানটা আকাশে থেমে আছে, ঘড়িটাও থেমে আছে। কেমন অস্বস্তি লাগে তার। বসে থাকতে থাকতে হাতে-পায়ে ঝিঁঝিঁ ধরে যায়।

পাঁচটা বাজার সাত মিনিট আগে জাকার্তা এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করল বিমান। ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে পা রেখে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে প্রভুর শোকরগুজার করলেন মাওলানা কাশেম। চোখ গেল এয়ারপোর্টের বিশাল ভবনটার দিকে। এত বড় ভবন জীবনে কোনোদিন দেখেননি। ভবনের গেটের উপর দেখলেন বিশাল একটা পাখির ছবি। বিমানের গায়েও ঠিক এমন একটি পাখির ছবি দেখেছেন। ঠিক হুদহুদ পাখির মতো। আল্লাহর কালামে কতবার আছে এই পাখির কথা। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে উঠল তার। পাঞ্জাবির হাতায় চোখ মুছে ভিআইপি লাউঞ্জের দিকে হাঁটা ধরলেন।

লাউঞ্জে ঢোকা মাত্রই বাজপড়া মুর্দার মতো থমকে দাঁড়ালেন তিনি। এ কী কা-! গোটা লাউঞ্জজুড়ে দেব-দেবীর ম্যুরাল! ঠিক জগন্নাথপুর দুর্গামন্দিরের মূর্তিগুলোর মতো। ছোটবেলায় যখন চুরি করে মন্দিরে যেতেন ঠিক এরকম দেব-দেবীর মূর্তি দেখতেন। বিচলিত মাওলানা লাগেজ হাতে দেখতে বাঙালির মতো এক লোককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাইসাহেব, ‘এটা কি জাকার্তা এয়ারপোর্ট?’ লোকটি বাঙালিই বটে। হেসে উঠে বলল, ‘ইয়েস আঙ্কেল।’

ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে লাউঞ্জের বাইরে এসে দেখলেন হাশেম তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। বাবাকে কদমবুচি করে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল হাশেম। বহুদিন পর বেটাকে দেখতে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন কাশেম মাওলানা। হাশেমের ছেলে ও মেয়েটা গাড়িতে বসা। ফ্যাল ফ্যাল করে বুড়ো দাদার দিকে তাকিয়ে। হাশেম বলল, ‘তোমাদের দাদা, সালাম দাও।’ সালাম দিল তারা। সালামের উত্তর দিয়ে দুজনকে দুই বগলে চেপে ধরলেন কাশেম।
গাড়ি ছুটছে আশি কিলোমিটার বেগে। কাশেম মাওলানার পলক পড়ে না। কত বিরাট কত ঝকঝকে তকতকে শহর। ঢাকা শহরের মতো জ্যাম নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহর খাস রহমত। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের এমন সুন্দর সুন্দর নগরী উপহার হিসেবে দেন। জানালার ফাঁকে বড় বড় গম্বুজ ও মিনার বিশিষ্ট একটা মসজিদ দেখতে পেয়ে চেহারাটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। বিড়বিড় করে বললেন, ‘সুবহানাল্লাহ। কত সুন্দর মসজিদ! মুসলমানের দেশ বাংলাদেশ, অথচ দেশের কোথাও এমন একটি সুন্দর মসজিদ নেই। বড় আফসোস!’

ট্রাফিক সিগন্যালে থামল গাড়িটা। বাইরে তাকিয়ে রাস্তার মোড়ে খবসুরত দুটি জেনানাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠলেন মাওলানা। পরমুহূর্তে ভুল ভাঙল। বাস্তবের মানুষ নয়, ইট-সিমেন্টে গড়া মূর্তি, অথচ দেখতে কিনা একেবারে জ্যান্ত জেনানার মতো! মাথায় সোনালি মুকুট, গলায় বিচিত্র কারুকার্যখচিত হার, সারা গায়ে নানা নকশা, বুক দুটো উদোম, স্তনগুলো বেলের মতো। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না কাশেম। চোখে ফিরিয়ে মনে মনে তওবা পড়ে বেটাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এগুলো কিসের মূর্তি হাশেম?’

হামেশ বলল, ‘এগুলো মূর্তি নয় আব্বা, এগুলো ভাস্কর্য। ইন্দোনেশিয়ার রাস্তার মোড়ে মোড়ে এরকম অনেক ভাস্কর্য দেখতে পাবেন। সবচেয়ে বেশি ভাস্কর্য বালি দ্বীপে। আপনাকে নিয়ে যাব একদিন। পৃথিবীর সুন্দরতম একটি দ্বীপ। দুনিয়াটাকে আল্লাহ কত সুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন, বালি না গেলে বোঝা যায় যায় না।’

রাস্তা ফাঁকা পেয়ে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল ড্রাইভার। গাড়ি ছুটতে লাগল ঝড়ের বেগে। শাঁই শাঁই। পাঞ্জাবির পকেট থেকে তসবিহটা বের করে গোণা শুরু করলেন কাশেম। চোখেমুখে ফুটে উঠতে থাকে চিন্তার গভীর ছাপ।

তিন
বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেল। হাশেমের ফ্ল্যাটটি তিন তলায়। দরজা খুলল নিনিমারইয়ানি। একলাফে কপালে উঠে গেল মাওলানা কাশেমের দুই চোখ। তার পুত্রবধুর গায়ে কিনা জিন্সের প্যান্ট আর ফুলহাতা গেঞ্জি! দ্রুত চোখ নামালেন তিনি। শ্বশুরকে সালাম দিল নিনিমারইয়ানি। সালামের জবাব দিয়ে নাতি-নাতনির হাত ধরে ভেতরে ঢুকলেন কাশেম।
টেবিলে খাবার প্রস্তুত করে শ্বশুরকে খেতে ডাকল নিনিমারইয়ানি। খেতে বসে প্লেটের ভাতগুলো নাড়াতে নাড়াতে মাওলানা কাশেম বললেন, ‘বাবা হাশেম!’
জি আব্বা।
বউমার নামটা যেন কী?
নিনিমারইয়ানি। ওর নাম নিনিমারইয়ানি, আব্বা।
এই নামের অর্থ কী বাবা?
আমি ঠিক জানি না। আপনার বৌমাকে জিজ্ঞেস করুন না। ডাকব তাকে?
না না, থাক। বৌমা কাজ করছে এখন, পরে কথা বলা যাবে।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আচ্ছা, বউমা কি মুসলমান?
ভাতের লোকমাটা মুখে তুলতে গিয়ে নামিয়ে রেখে হাশেম বলল, এটা কেমন কথা আব্বা! আপনার ছেলে বিধর্মী মেয়েকে বিয়ে করবে? নিনিমারইয়ানি পাক্কা মুসলিম। শরিয়ত মোতাবেক আমাদের বিয়ে হয়েছে।
কিন্তু নামটা যে মুসলমানের বলে মনে হচ্ছে না।
হা হা হা। বুঝতে পেরেছি। এটা তো বাংলাদেশ নয় আব্বা। এটা ইন্দোনেশিয়া। এদেশের মেয়েদের নাম এমনই হয়। মেঘবতী সুকর্ণপুত্রীর নাম শোনেননি? ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট।
তিনিও কি মুসলমান?
কী যে বলেন আব্বা! বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মুসলিম নারী প্রেসিডেন্টদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন।
কিন্তু নামটা তো বাংলা মনে হচ্ছে।
মেঘবতী তো বাংলাই। সুকর্ণ হচ্ছে তার বাবার নাম। সুকর্ণের পুত্রী। হিন্দুপুরাণের একটি চরিত্রের নাম সুকর্ণ। সেই সুকর্ণের নামে তার বাবার নাম।
ঘোলাচোখে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কাশেম। তারপর এক গ্লাস পানি খেয়ে ভাতের লোকমা মুখে দিলেন। কয়েক লোকমা খেয়ে বললেন, আচ্ছা, এয়ারপোর্টের গেটে একটা পাখি আঁকা দেখলাম। বিমানের গায়েও দেখেছি। ওটা কি হুদহুদ পাখি?
হাশেম হাসতে হাসতে বলল, না আব্বা, ওটার নাম গরুড়। গরুড় পাখি। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় প্রতীক গরুড়। জাতীয় বিমান সংস্থার নামও এই পাখির নামে।
ও। আচ্ছা, পাখিটা কি আমাদের দেশেও আছে?
না আব্বা, এই পাখি এখন পৃথিবীর কোথাও নেই। গরুড় হলো হিন্দুপুরাণে উল্লিখিত একটি বৃহদাকার পৌরাণিক পাখি। এই পাখি হিন্দুদেবতা বিষ্ণুর বাহন।
নাউযুবিল্লাহ।
জি আব্বা?
বলছিলাম যে বউমা নাতি-নানতিরা খাবে না?
ওরা পরে খাবে। আর দুটো ভাত দেই আব্বা?
কাশেম মাথা নাড়লেন, না না। এগুলোই তো খেতে পারছি না!

খাওয়ার পর পায়খানার বেগ পেল কাশেমের। ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে দিয়ে হাইকমোডে কীভাবে কী করতে হয় বুঝিয়ে দিল হাশেম। ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে কাশেম যেই না কমোডটায় বসলেন অমনি বেগটা উবে গেল। চেষ্টা করেও পেটটা খালি করা গেল না। শেষে শুধু অজু করে বেরিয়ে এলেন। ড্রইং রুমের এক কোণায় জায়নামাজ বিছিয়ে দিল নিনিমারইয়ানি। নিয়ত বেঁধে সুরা পড়তে পড়তে কাশেমের চোখ গেল জানালার বাইরে বিশাল একটা ব্যানারের উপর। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিলেন তিনি। নিশ্চয় মরদুদ শয়তানের ধোকা। আসতাগফিরুল্লাহ!

নামাজ শেষ করে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ব্যানারটায় ভালো করে চোখ বুলাতে লাগলেন। হাই ভোল্টেজের লাইটের আলোয় ঝকঝক করছে ব্যানারটা। বিচিত্র সাজে সজ্জিত তিনটা পুরুষমূর্তি আঁকা। তিনটার মাথাতেই পালকের মুকুট, একটার হাতে ধনুক, একটার চেহারা হনুমানের মতো। মাওলানা কাশেম ভেবে পান না এসব ছবিঅলা ব্যানার এই দেশে কেন? এসব ব্যানার তো বাংলাদেশে দুর্গাপূজার সময় চোখে পড়ে। হিসাব মিলাতে পারেন না তিনি। সত্যি তিনি ভুল করে অন্য কোনো দেশে এসে পড়লেন না তো! তার বেটা কি সত্যি সত্যি ইন্দোনেশিয়ায় থাকে, নাকি ইউরোপের কোনো অমুসলিম দেশে?

বাবাকে বারান্দায় দেখে পেছনে এসে দাঁড়াল হাশেম ও তার স্ত্রী। আঙুল উঁচিয়ে ব্যানারটা দেখিয়ে কাশেম জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা, ব্যানারটা কিসের?’ হাশেম বলল, ‘এটা একটা নাটকের বিজ্ঞাপন আব্বা। এদেশের জাতীয় গ্রন্থের নাম রামায়ণ।’
হিন্দুদের রামায়ণ?
জি আব্বা।
কদিন আগে রামায়ণের নৃত্যনাট্য হয়েছিল শহরের নাট্যশালায়। এটা সেই নৃত্যনাট্যের বিজ্ঞাপন।

ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কাশেম। অপলক। মেয়েটা কেঁদে উঠায় নিনিমারইয়ানি ভেতরে চলে গেল। হাশেম বলল, ‘রাত হয়েছে আব্বা। শুয়ে পড়–ন। কাল সকালে দেখবেন।’

শুয়ে পড়লেন আবুল কাশেম। চোখ বোজা মাত্রই ভেসে উঠল বিমান থেকে দেখা মেঘপুঞ্জ, ধুধু মরুভূমির মতো সেই দৃশ্য। আবারো মনে পড়ে গেল জাজিরাতুল আরবের কথা। আর কটা দিন যাক, তারপর হাশেমকে হজে যাওয়ার ইচ্ছার কথা বলা যাবে।

চার
দুদিন পর টানা চার দিনের ছুটি পেল হাশেম। নিনিমারইয়ানিরও ছুটি। ছুটিটা বালি দ্বীপে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিল তারা। যেদিন তারা বালির উদ্দেশে রওনা দিল সেদিনই প্রথম ইন্দোনেশিয়ার রুপিহা, মানে টাকা, দেখতে পেলেন মাওলানা আবুল কাশেম। বাবার হাতে এক শ টাকার পাঁচটি নোট দিয়ে হাশেম বলল, ‘এগুলো পকেটে রাখেন আব্বা।’ নোটগুলো হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন কাশেম। আচমকা ভুরু কুঁচকে গেল তার। নোটের গায়ে কিনা মস্ত নাকওয়ালা একটা মূর্তি আঁকা! মূর্তিটা ছোটবেলায় কোথাও যেন দেখেছেন। ঠিক মনে করতে পারেন না। হয়ত জগন্নাথপুর দুর্গামন্দিরে। ছেলের কাছে জানতে চাইলেন, ‘টাকার গায়ে এটা আবার কিসের মূর্তি?’ হাশেম হাসতে হাসতে বলল, ‘এটা গণেশের মূর্তি আব্বা। হিন্দুদেবতা গণেশ।’

নোটগুলো পকেটে না রেখে ছেলের দিকে বাড়িয়ে ধরে কাশেম বললেন, ‘তোর কাছে রাখ বাবা। দরকার হলে আমি চেয়ে নেব।’ নোটগুলো নিয়ে নিনিমারইয়ানির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে হাশেম। নিনিমারইয়ানিও হাতের পিঠে মুখ চেপে হাসে। কাশেমের চোখ এড়ায় না তাদের হাসি।

পর্যটন দ্বীপ বালিতে পৌঁছে মাওলানার চোখ আর কপাল থেকে নামে না। দ্বীপজুড়ে নানা দেব-দেবীর মূর্তি। কোনোটা পুরুষের, কোনোটা নারীর। কেউ নৃত্যরত, কেউ যুদ্ধরত। কোনোটার হাতে তীর-ধনুক, কোনোটার হাতে বংশী। ধাবমান ঘোড়ার একটা রথ থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলেন না তিনি। একটা পুরুষমূর্তির হাতে ঘোড়ার লাগাম, পেছনে একটা নারী মূর্তি।

বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে হাশেম বলল, ‘বালিকে বলা হয় হাজার মন্দিরের দ্বীপ। এখানে মন্দিরের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার। সুন্দর সুন্দর সব মূর্তি ও ভাস্কর্যের সমাহার এই দ্বীপে। কদিন আগে সৌদির বাদশা সালমান বিন আবদুল আজিজ ইন্দোনেশিয়া সফরে এসেছিলেন। তার সম্মানে ভাস্কর্যগুলো ঢেকে দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, কিন্তু বালির স্থানীয় সরকার রাজি হলো না। তারা বলল, ভাস্কর্য ও মূর্তিগুলো যেমন আছে তেমনই থাকবে। কেননা এগুলো তাদের সংস্কৃতি ও কৃষ্টির পরিচয় বহন করে।’
সৌদি বাদশার নাম শুনে মরুভূমির দৃশ্যটা আবারও ভেসে উঠেছিল কাশেমের চোখে। কিন্তু সৌদি বাদশার এই দ্বীপে আসার কথা শুনে দৃশ্যটা হাওয়া হয়ে গেল। চেহরায় যুগপৎ বিস্ময় ও মুগ্ধতা নিয়ে ভাস্কর্যটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

একটা থ্রি স্টার হোটেলে রাত যাপন করল সবাই। পরদিন সকালে গেল গুনুং আগুং পাহাড়ের কাছে। পাহাড়টির কাছেই ইন্দোনেশিয়ার হাজার বছরের ইতিহাসসমৃদ্ধ বেসাকিহ্ মন্দির। দুপুর পর্যন্ত ওখানে থেকে তারপর গেল তানাহ লট মন্দিরে। সমুদ্রের পাশে একটি বিশাল পাথরের ওপর মন্দিরটির অবস্থান। সমুদ্রে তখন জোয়ার। মন্দিরটির ভিত্তিমূল তলিয়ে গেছে পানির নিচে। যেন সমুদ্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মন্দিরটি। চোখ ফেরাতে পারেন না মাওলানা। তার মনে হয় না তিনি চন্দ্র-সূর্যের এই পৃথিবীতে আছেন। যেন শাস্ত্রপ্রোক্ত সেই বেহেশতের সামনে দাঁড়িয়ে, যেখানে পার্থিব দুঃখ-ক্লেশ নেই, আছে অনাবিল প্রশান্তি। পাক মাওলার অপার লীলা দেখে তিনি বিহ্বল।

সূর্য তখন অস্তাচলে। হাশেমের ছেলে ও মেয়েটা খেলছে। স্মার্টফোনের ক্যামেরায় মন্দিরের কয়েকটা ছবি তুলল নিনিমারইয়ানি। লাল সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছেন মাওলানা কাশেম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।

পাঁচ
মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবী এক মাসের সফরে ইন্দোনেশিয়া গেলেও থাকলেন দেড় মাস। আরো একটি মাস থাকার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু মাদ্রাসা ও বাড়ির কথা চিন্তা করে ফিরে এলেন। যেদিন ফিরলেন তার পরদিন সকালে সোহবতে ইসলামের জেলা আমিরের ফোন। কালই জেলাশহরে যেতে হবে। ঢাকার সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করেছে সোহবতে ইসলামের আমির। সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের সামনে গ্রিক দেবী থেমিসের একটা মূর্তি বসিয়েছে জালিম সরকার। ইসলাম রক্ষার্থে ঘেরাও কর্মসূচিতে ওলামা-মাশায়েখদের দলে দলে যোগ দিতে হবে। ঐ মূর্তি না সরানো পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে তৌহিদি জনতা ভেঙে ফেলবে ঐ মূর্তি।

মাওলানা আবুল কাশেম হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। আমীরকে একটা সালাম দিয়ে ফোনটা রেখে দিলেন।

সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাওর জন্য যেদিন ঢাকা রওনা হওয়ার কথা তার তিন দিন আগে সোহবতে ইসলামের জেলা আমীর বরবারে একটা চিঠি লিখলেন মাওলানা আবুল কাশেম ফেনবী। চিঠির উল্লেখযোগ্য কিছু কথা এমন : ‘আমার বয়স হয়েছে। আল্লা-বিল্লাহ করে বাকি জীবন কাটিয়ে দেব ঠিক করেছি। সাংগঠনিক কাজে সময় দেওয়া আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আমি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে সোহবতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করলাম। আমাকে সংগঠনের সকল কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দিতে হুজুরের একান্ত মর্জি কামনা করছি।’

সেদিনই মাদ্রাসার এক তালেবুল এলেমকে দিয়ে পোস্ট অফিসে পাঠিয়ে দিলেন চিঠিখানা।

৩০.০৪.২০১৭

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
ফিরিঙ্গির চরের সে এবং চন্ডিপুরের তারা

মনিরুজ্জামান ছট্টু
ফিরিঙ্গির চরের সে এবং চন্ডিপুরের তারা

সে আবার সচকিত হয়। কান খাড়া করে। বাতাসের গতিমুখে নাক উঁচু করে ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করে। না, কোনো মানুষের গন্ধ নয়। সে আবার খালে নামে। সরু খাল। ফিরিঙ্গির চরের এই সরু খালে আইলার আগেও সে কত মাছ পেয়েছে। দু’চারটে পারশে, কি একটা ভেট্কি, না হয় একটা কাইন। যাহোক একটা কিছু। আজ সাতদিন ধরে তার উপোষ চলছে। অথচ ক’দিন আগেও এমন অবস্থা ছিল না। মাদার ও ফিরিঙ্গি নদীর এই মোহনার চরে ঝাঁকে ঝাঁকে মিলত হরিণ। আহা, কতদিন তার পেটে হরিণের মাংস পড়েনি। হরিণের দরকার নেই। খালে যদি দু’চারটে অন্তত কাকড়া মিলত। সে তার থাবা দিয়ে অনবরত খালের কাদা ঘাটতে থাকে। কিচ্ছু পায় না। খাল থেকে উঠে সে আবার জঙ্গলে ঢোকে। অকারণ খানিক হাঁটাহাঁটি করে। ফিরিঙ্গির চরে বাস তার দীর্ঘদিনের। কত দূরের জঙ্গলেও সে গিয়েছে কিন্তু আবার সে ফিরে এসেছে এই ফিরিঙ্গির চরে। এ চরের কেওড়া বন তাকে যেন টানে।

‘মালে’ উঠে সে ঘাড় উঁচু করে যতদূর দৃষ্টি যায় দেখার চেষ্টা করে কোনো শিকারের। দৃষ্টি সীমার মধ্যে কোনোকিছুই তার নজরে আসে না। সে অকারণ তার নখ দিয়ে কিছু মাটি আঁচড়ায় এবং গলা দিয়ে হুন্ক শব্দ করে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে মাদার নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। জঙ্গল ছেড়ে এত ফাঁকা জায়গায় সচরাচর সে আসে না। মাঝ নদীতে সে চেনা কিছু জেলে-নৌকা দেখতে পায়। তবে সে সাবধান হয়। জেলে নৌকা থেকে মানুষের উৎসুক দৃষ্টি তার ওপর পড়বার আগেই সে দ্রুত জঙ্গলে প্রবেশ করে। জঙ্গলে ঢুকে সে থামে না। হাঁটতে থাকে। ঘন কেওড়া বনে বিশেষ করে এই ফিরিঙ্গির চরের জঙ্গল এতটাই ঘন যে এখানে কখনই সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। সে ছোট ছোট আলো ছায়ায় খানিকটা অলস ভঙ্গিতে হাঁটতে থাকে। খানিকটা পশ্চিমে ঘেঁষে সে সোজা উত্তর দিক বরাবর হাঁটতে থাকে। হঠাৎ তার মাথার উপর দুটো বানর কিচ্ কিচ্ শব্দে ডেকে ওঠে। মট করে একটা ডাল ভাঙার শব্দও তার কানে আসে। সে থমকে দাঁড়ায়। নিজেকে সংকুচিত করে ফেলে। বিপদের গন্ধ পায়। চট করে একটা হেতাল ঝোপের মধ্যে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। বেশ কিছুক্ষণ হেতাল ঝোপের মধ্যে বসে সে আর কোনো বিপদের আলামত বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়ায় এবং আবার হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে সে যখন মরাদুলি চরে এসে পৌঁছায় তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সাতদিন তার উপোষ চলছে। পেটের ক্ষিদে ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। বা দিকের থাবার নীচে বেশ কিছুদিন আগে একটা হেতাল কাঁটা বিঁধেছিল, এতদিন কিছু বুঝতে পারেনি সে। এখন বেশ ব্যথা অনুভব করে। হাঁটতে যেন কষ্ট হয়। শরীরের অন্যসব কষ্ট ছাপিয়ে তীব্র হয় তার জঠর যন্ত্রণা। এখানেও কোনো খাবার মেলে না। শিকারের কোনো সম্ভাবনা সে খুঁজে পায় না। গরাণের ঝোপটা বাঁয়ে রেখে সে আবার উত্তর দিক বরাবর হাঁটতে থাকে। খোবরাখালী নদীর তীরে এসে খানিক বিশ্রাম নেয়। খোবরাখালী অনায়াসেই সাঁতরে পার হয় সে। খোবরাখালী পার হয়ে এসে চুনকুঁড়ি ও মালঞ্চ নদীর মাঝ বরাবর জঙ্গল দিয়ে সে হাঁটতে থাকে। এখানকার জঙ্গল অপেক্ষাকৃত হালকা। মাঝে মাঝে বেশ কিছু জায়গা একেবারেই ফাঁকা। এরকম একটি শুলো বিহীন ফাঁকা জায়গায় অকারণ খানিক গড়াগড়ি খায় সে। তবে সে আবার হাঁটতে থাকে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। মালঞ্চ ও কলাগাছি নদীর মোহনাও সে অনায়াসে পার হয়। হাঁটতে হাঁটতে সে কদমতলা ফরেস্ট অফিসের কাছ দিয়ে লোকালয়ের সীমানার মালঞ্চ নদী পার হয়ে মুন্সিগঞ্জ গ্রামে ঢুকে পড়ে। তখন রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছে। শেষ রাতের ফিঁকে অন্ধকারে সে ঘেরের পথ ধরে মুন্সিগঞ্জ বাজার পার হয়। পার হয় পানখালী গ্রামও। পানখালী গ্রাম পার হয়ে সে যখন চন্ডিপুর গ্রামে পৌঁছায় তখন সকাল হয়ে গেছে। লোকালয় তার কাছে অচেনা অজানা। এখানে জঙ্গল নেই। নিজেকে লুকানোর জায়গা নেই। তবে হঠাৎ সে খাবারের গন্ধ পায়। তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে একটা ছাগল ধরা পড়ে। কি অনায়াস শিকার। কি সহজ শিকার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার মুখ দিয়ে খানিক লালা গড়িয়ে পড়ে মাটিতে। ক্ষুধার যন্ত্রণা তাকে বিপদের কথা ভুলিয়ে দেয়। মানুষের গন্ধও তাকে আর সচকিত করে না। সাবধানী করে না। একটা কুঁড়েঘরকে আড়াল করে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাগলটার উপর। কিন্তু ততক্ষণে গ্রামের মানুষ জেগে উঠেছে। ছাগলের চিৎকার আর মানুষের চিৎকারে পুরো গ্রাম জেগে ওঠে নিমিষেই। ছাগলটিকে সে খেতে পারে না। মুখে করে নিয়ে সে পালাতে চায়। কিন্তু পারে না। আট দিনের উপোষী ক্ষুধার্ত হয়েও সে মুখের খাবার ফেলে দিয়ে দৌঁড়াতে থাকে। কিন্তু দৌঁড়ে পালাবে কোথায় সে? এখানে হেতাল ঝোপ নেই। গোল বাগান নেই, আর চির চেনা ফিরিঙ্গির চরের কেওড়া বন নেই। সে দৌড়াতে থাকে। সে দিগি¦দিক ছোটে। দৌড়াতে দৌড়াতে সে আবার জঙ্গলে ফিরতে চায়। কিন্তু সে পথ পায় না। পুরো গ্রাম এখন জেগে উঠেছে। চারদিকে শুধু মানুষ আর মানুষ। লাঠি হাতে মানুষ, সড়কি হাতে মানুষ, বর্শা হাতে মানুষ। শয়ে শয়ে মানুষ, হাজারে হাজারে মানুষ। সে পালাবার পথ খোঁজে, পায় না।

অকস্মাৎ ভিড় থেকে কিছু সাহসী সশস্ত্র মানুষ তার দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। সে তখন তার ক্ষুধার কথা ভুলে যায়। ভীত হলেও সাহসী হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সবকিছু ভুলে সে কেবল অনুভব করে বেঁচে থাকার তাগিদ। সে খুব দ্রুত একজনকে আঘাত করে। দুই থাবা তার ঘাড়ে তুলে আমূল বিঁধিয়ে দেয় ক্ষুরধার নলি। লোকটি চিৎকার করারও সময় পায় না। রক্তে ভেসে যায় তার সারা দেহ, অকুস্থলের মাটি। তাকে নিয়ে ব্যস্ত কিছু মানুষ। এ সুযোগটি সে হাতছাড়া করে না। মানব প্রাচীর কিছুটা শিথিল দেখেই সে দৌড়ায়। সে কেবল দৌড়ায় আর দৌড়ায়। দৌড়াতে দৌড়াতে যেখানে যেটুকু পালাবার জায়গা পায় সেখানে সে একটু জিরিয়ে নেয়। কখনও কারোর রান্নাঘরে, বসতঘরে কিম্বা গোয়ালঘরে। কিন্তু সেটি বেশিক্ষণের জন্য নয়। উন্মত্ত মানুষের স্রোত কাছে এগিয়ে এলেই আবার সে ছোটে।
দু’জন অতি উৎসাহী বন্দুকধারীও এই জন স্রোতে মিশেছে। আকাশের দিকে বন্দুকের নল উচিয়ে গুড়–ম গুড়–ম করে দুটো ফায়ার করে তাদের সরব উপস্থিতি জানান দেয়। সে কিন্তু এই ‘আগুনে লাঠিকে’ খুব ভয় পায়। এ লাঠির মুখ থেকে আগুন বের হয়। তবে বন্দুকধারীরা কিন্তু এ কম্মটি করবে না। গুলি করার মতো বোকামী তারা করবে না, গণপিটুনি এক জিনিস আর গুলি করে মেরে ফেলা আর এক জিনিস। বাদাবনের ধারে যাদের বাস তারা অন্তত এটুকু বোঝে। কেবল ভয় দেখানোর জন্যই তারা উড়ো ফায়ার করে। তবে যাকে ভয় দেখানোর এই আয়োজন সে কিন্তু সত্যি সত্যি ভয় পায়। ভয়ে সে একটা গোয়ালঘরের মধ্যে যেয়ে আশ্রয় নেয়। আট দিনের উপোষী শরীরটাকে সে আর টানতে পারে না। গোয়াল ঘরের মেঝেতে সামনের দু’পা মেলে দিয়ে বসে পড়ে হাফাতে থাকে। ইতোমধ্যে পুরো গোয়ালঘরটা হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষ ঘিরে ফেলে। সে অবশ্য আর পালাবার চেষ্টাও করে না। তবে গোয়ালঘরের গরাণের বেড়ার ফাঁক দিয়ে যখন সে দূরের জঙ্গলের রেখা দেখতে পায় তখন তার আবার পালাবার ইচ্ছা জাগে। ঐ তো মালঞ্চ নদী। নদীটা পার হলেই জঙ্গল। তার প্রিয় বাদাবন। সে আবার ফিরে যেতে পারে তার প্রিয় ফিরিঙ্গির চরে। সেখানে না মিলুক শিকার, না মিলুক কোনো খাবার। সে জানে তার মুখের গ্রাস কারা কেড়ে নিয়েছে। বাদার হরিণ মেরে খেয়েছে তারাই, খালের মাছ ধরে নিয়ে গেছে তারাই, জঙ্গলের বৃক্ষরাজি কেটে উজাড় করেছে তারাই-যারা তাকে এখন বন্দী করে রেখেছে। সে আর পালাবার চেষ্টা করে না। চেষ্টা করে লাভও নেই। গোয়াল ঘরের চারপাশে সশস্ত্র মানব প্রাচীর তাকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
কিছু অতি উৎসাহী সাহসী যুবক উপায়ন্তর না দেখে গোয়ালঘরের চালে উঠে পড়ে।

গোলপাতার চাল ফাঁক করে একটা ফাঁস আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয় তার মাথা লক্ষ্য করে। প্রথমবার ব্যর্থ হলেও অসহায়, ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত, শ্রান্ত ফিরিঙ্গির চরের প্রতাপশালী সেনাপতির গলায় একসময় ঠিকই আটকে যায় ফাঁসটি। তারপর অতি দ্রুত শত শত ধারালো কুঠোরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয় তার দেহ। গ্রামময় তখন উল্লাস ধ্বনি। পানখালী, কদমতলা আর চন্ডিপুরের হাজার হাজার মানুষ তখন নিষ্ঠুরতার আনন্দে, মৃত্যুর জান্তব উল্লাসে ফেটে পড়ে। হাজারো মানুষের সেই বিজয়ের উল্লাস আর চিৎকার মালঞ্চের তীর ঘেঁষা বাদাবনে বাঁধা পেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে চন্ডিপুর গ্রামে।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest
শুভ্র আহমেদ-এর কবিতা

অনেক দিন আগের গল্প

অনেক দিন আগের গল্প
বাতাস প্রথম ভালোবেসেছিল ফড়িংয়ের ডানা
প্রকৃত কারণ সকলের ছিল অজানা
আমি বামন তবু যখন আকাশ ধরতে যাই
পাখির রাজ্যে পাখি খুঁজতে পাখি নয় ফড়িং হারাই
নিছক গল্প, সত্য না কল্প
মহাবিশ্বে এসবের মূল্য অল্প
তাও জানি। তবু ভয় তবু বিস্ময় কথায় কথা বাড়লে
কী এমন ক্ষতি রতিযাত্রায় সে বা আমি হারলে
বামে ভয় কেনোনা বামেই হৃদয়
‘দাস ক্যাপিটাল’ নামে সেখানে আজো রোদ ওঠে ঝড়
হয়
নটে মুড়োলো গল্প ফুরোলো।

 

 

ডাকবাক্স

প্রতিটি বাদাম ভেঙে দু টুকরো করি
এক টুকরো এবং রাখি তোমার জন্য
পার্কের তাপস বেঞ্চগুলোয় প্রফুল্ল বাতাসের
সাম্যবাদ
আর জোছনার অসহ্য লুটোপুটি চাঁদ।
যৌবনের চোখ ব্যঞ্জনায় গভীর আর নরম অনেক
আমার প্রেম এরও চেয়ে বেশি রঙিন
অর্থময়;
অপেক্ষায় অনেক নিঃসঙ্গ রাত করেছি পার
তোমাকেই ভীষণ দরকার আজ রাতে আমার।

0 মন্তব্য
0 FacebookTwitterGoogle +Pinterest